শাহাবুদ্দিনের আলো সুরসঙ্গী

দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী সংগীতশিল্পী শাহাবুদ্দিন আহমেদ দোলন। ছবি: সংগৃহীত
দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী সংগীতশিল্পী শাহাবুদ্দিন আহমেদ দোলন। ছবি: সংগৃহীত

দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী সংগীতশিল্পী শাহাবুদ্দিন আহমেদ দোলন। তিনি তিতাস গ্যাস আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় ডেমরা, সারুলিয়া, ঢাকায় সংগীতের সহকারী শিক্ষক হিসেবে কর্মরত। একই সঙ্গে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিল্পীদের নিয়ে একটি সংগঠন গড়ে তুলেছেন।

বাংলাদেশে বিভিন্ন জেলার প্রতিভাবান শিল্পীরা এই সংগঠনের সদস্য। সুরসঙ্গী সংগীতায়ন নামের সংগঠনটি গড়ে ওঠে ২০১৪ সালে।

শাহাবুদ্দিনের ছোটবেলা থেকেই রাতে চোখে সমস্যা ছিল। তবে দিনের বেলায় তেমন কোনো সমস্যা ছিল না। ফুটবল, ব্যাডমিন্টনসহ বিভিন্ন খেলাধুলার চর্চা ছিল নিয়মিত। লেখাপড়ার পাশাপাশি সবই করতে পারতেন। চোখের এই সমস্যা তখনো এত কঠিন হবে বুঝতে পারেননি।

ঢাকায় স্কুলের বন্ধুরা শাহাবুদ্দিনকে বিভিন্নভাবে সাহায্য করতেন। বোর্ডের লেখা দেখতে পারতেন না। শিক্ষক হাফিজা রহমান খান শাহাবুদ্দিনকে একজন চোখের চিকিৎসকের কাছে আসাদ গেটে নিয়ে যান। সেখানে পরীক্ষার পর চিকিৎসক তাঁকে একটি চশমা দেন।

ধীরে ধীরে শাহাবুদ্দিনের চোখের জ্যোতি কমতে থাকে। স্কুলে বন্ধুদের মাঝে গান করতেন তিনি। বন্ধুরা তাঁকে গান শিখতে উৎসাহ দেন।

শাহাবুদ্দিন টিউশন করাতেন। টাকা জমিয়ে বন্ধু মিজানের সঙ্গে আলাপ করে নিজের জন্য একটি হারমোনিয়াম কেনেন। মিজানের বাসায় রেখে সংগীতচর্চা শুরু করেন। এভাবে সংগীত শেখা শুরু হয়।

প্রথম ওস্তাদ ছিলেন সঞ্জীব বাবু। তারপর বুলবুল ললিতকলা একাডেমিতে ভর্তি হন। কিন্তু কোথাও জীবনের নিশ্চয়তা পাচ্ছিলেন না। এইচএসসি পাস করার পর আগারগাঁওয়ে সরকারি সংগীত কলেজে ভর্তি হন। পাশাপাশি বিভিন্ন স্কুলে খণ্ডকালীন সংগীত শিক্ষক হিসেবে কাজ শুরু করেন।

নারায়ণগঞ্জের সানারপাড় শেখ মোরতোজা আলী স্কুলে ১৯৯৮ সালে শাহাবুদ্দিন সংগীত শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। সেখানকার মনি আপা তাঁকে উচ্চশিক্ষার প্রেরণা দেন। সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন। শাহাবুদ্দিন সংগীতে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। বন্ধু ও সংগীতশিল্পী প্রদীপ কুমার নন্দীর সহায়তায় শান্তা মারিয়াম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সংগীতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন শাহাবুদ্দিন। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের মধ্যে তিনিই প্রথম সংগীতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন।

শাহাবুদ্দিন এরপর ২০১৪ সালে সুরসঙ্গী সংগীতায়ন নামের সংগঠন গড়ে তোলেন। সুরসংগীতের নিজস্ব কোনো ভবন নেই। দুজন শিক্ষক প্রশিক্ষণকাজ চালান। প্রশিক্ষকদের বেতনভাতা সংগঠন থেকে বহন করা হয়।

সুরসংগীত কোথাও থেকে এখনো কোনো অর্থ বা সহযোগিতা পায়নি। বাংলা একাডেমিতে একুশে বইমেলা, সোনারগাঁওয়ে লোকমেলাসহ দেশের নানা জায়গায় তাদের এই সংগঠন সংগীত পরিবেশন করছে।

সুরসংগীতের মূল কার্যক্রম পরিচালিত হয় ১০/৭, সায়েদাবাদে অবস্থিত সভাপতির নিজ বাড়িতে। শাহাবুদ্দিনের বিশ্বাস, বাংলাদেশে যত প্রতিবন্ধী সংগীতশিল্পী রয়েছেন, তাঁরা যদি উপযুক্ত পরিবেশ ও সহযোগিতা পান, তাহলে নিজেদের স্বাবলম্বী করে গড়ে তুলতে সক্ষম হবেন। সমাজের বোঝা হবেন না, বরং নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারবেন।

প্রতিভা ও সদিচ্ছা থাকলে প্রতিবন্ধকতা থাকা সত্ত্বেও একজন প্রতিবন্ধী সমাজে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেন।

নাজিয়া হোসেন: প্রথম আলোর দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী সাংবাদিক