তাঁরা শুধুই একেকটি সংখ্যা

সম্প্রতি সৌদি আরব থেকে বোন আবিরন বেগম ফিরেছেন লাশ হয়ে। বোনের ছবি ও ভোটার আইডি কার্ড হাতে বসে আছেন রেশমা খাতুন।  ছবি: মানসুরা হোসাইন
সম্প্রতি সৌদি আরব থেকে বোন আবিরন বেগম ফিরেছেন লাশ হয়ে। বোনের ছবি ও ভোটার আইডি কার্ড হাতে বসে আছেন রেশমা খাতুন। ছবি: মানসুরা হোসাইন

‘ওরা আমারে মাইরা ফালাইব। আমারে দেশে ফিরাইয়া নিয়া যান। আমি আমার সন্তান ও পরিবারের কাছে ফিরতে চাই। আমাকে আমার পরিবারের কাছে নিয়ে যান। আর কিছুদিন থাকলে আমি মরে যাব।’ সুমি আক্তারের এমন আকুতির একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছিল। সরকারের উদ্যোগে গত শুক্রবার অত্যন্ত গোপনীয়তার মাধ্যমে (বিমানবন্দরে গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে কথা বলতে দেওয়া হয়নি) পরিবারের কাছে ফিরেছেন সুমি। 

সুমি জীবিত ফিরলেও নাজমা ফিরেছেন লাশ হয়ে। নাজমা বেগমও ভাইরাল হওয়া অডিও ক্লিপে পরিবারকে বলেছিলেন, ‘আমি জায়গায় মরে যামু। আমি আর কুলাতে পারছি না। আমি মরে গেলে তো আমার পোলা-মাইয়ার চেহারাও দেখতে পামু না। আল্লাহ আমি এখন কী করমু?’  গত ২৫ অক্টোবর নাজমা কফিনবন্দী হয়ে দেশে ফিরেছেন।

গত ২৪ অক্টোবর ৪০ বছরের বেশি বয়সী আবিরন বেগম দেশে ফিরেছেন কাফনে মোড়ানো লাশ হয়ে। লাশ হয়ে দেশে ফিরতেও সময় লেগেছে সাত মাস। আবিরনের মৃত্যুসনদে মৃত্যুর কারণের জায়গায় লেখা ছিল ‘মার্ডার’ বা হত্যা।

আর গত ৩১ অক্টোবর গৃহকর্মী পারভিন আক্তারের লাশ দেশে আসে। তাঁর মৃত্যুসনদে লেখা ছিল ‘আত্মহত্যা’। তাঁর পরিবারের সদস্যদের দাবি, সৌদি আরবে যাওয়ার পর থেকে তিনি অসংখ্যবার ফোনে নির্যাতনের অভিযোগ করেছিলেন।

নির্যাতন ও লাশ হয়ে দেশে ফেরার এই ঘটনাগুলো আলাদা হলেও বিচ্ছিন্ন নয়। এই নারীরা সৌদি আরবে গৃহকর্মীর কাজে গিয়েছিলেন। নির্যাতনের শিকার নারীরা দেশে ফিরে গণমাধ্যমের কাছে অভিযোগ করছেন, সৌদির ঘরে ঘরে নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন নারীরা। তবে সরকারের কাছে এই নারী শ্রমিকদের নির্যাতন বা লাশ হয়ে ফেরার ঘটনা একেকটি সংখ্যা ছাড়া আর কিছু নয়।

সরকারের জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত সৌদি আরবে গৃহকর্মীর কাজে যাওয়া নারী শ্রমিকের সংখ্যা ৪৭ হাজার ২৮৩ জন, যা বছরটিতে বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন দেশে যাওয়া মোট নারী শ্রমিকের ৬০ শতাংশের বেশি।  সরকারের কাছে ফেরত আসা নারীদের সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই।

বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচির প্রধান শরিফুল ইসলাম জানালেন, সৌদি আরবে বাংলাদেশ দূতাবাসের রাষ্ট্রদূতের পক্ষ থেকে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত চার বছরে সৌদি আরব থেকে শুধু লাশ হয়ে ফিরেছেন ১৫২ জন। ব্র্যাকের সংরক্ষিত হিসাব বলছে, শুধু চলতি বছরই দেশটি থেকে ফেরা লাশের সংখ্যা ৫৩। এঁদের ২১ জনই আত্মহত্যা করেছেন বলে মৃত্যুসনদে উল্লেখ করা হয়েছে।

তবে সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন বলেছেন, ‘সৌদি আরবে ২ লাখ ৭০ হাজার নারী কাজের জন্য গেছেন। এঁদের মধ্যে ৫৩ জন (মরদেহ) ফিরে এসেছে। এর মধ্যে ৮ হাজারের মতো ওখানের কাজ থেকে ফিরে এসেছেন। শতকরা হিসাবে সংখ্যাটা খুবই সামান্য। ৯৯ শতাংশ নারী ‘ম্যানেজ’ করে নিয়েছেন, দেশে তাঁরাও টাকাও পাঠাচ্ছেন।’

শুধু পররাষ্ট্রমন্ত্রী নন,  জার্মানির গণমাধ্যম ডয়চে ভেলেকে ‘সৌদিতে নারী নির্যাতন অতিরঞ্জিত’ বলে আখ্যা দিয়েছেন সৌদি আরবে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত গোলাম মসিহ। তিনি ওই গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘এখানে নারীদের যতটা নির্যাতনের কথা বলা হয় বাস্তবে ততটা নয়৷ নারীরা দেশে ফিরে যাওয়ার একটি বড় কারণ তাঁরা হোমসিক৷ তবে কিছু কিছু ঘটনা যে ঘটছে না, তা নয়৷’

ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচির প্রধান শরিফুল ইসলাম বললেন, ‘সরকারের পক্ষ থেকে নির্যাতনের শিকার ও লাশ হয়ে ফেরত আসা নারী শ্রমিকদের দেখা হচ্ছে একেকটি ‘সংখ্যা’ হিসেবে, যা খুবই আপত্তিজনক। আর সংখ্যাটি কত হলে সরকার পরিস্থিতি ভয়াবহ বলবে তা-ও সরকারের পক্ষ থেকে জানিয়ে দিলে ভালো হতো।’

বিভিন্ন নির্যাতনের অভিযোগে ইন্দোনেশিয়া ও ফিলিপাইন গৃহকর্মী পাঠানো বন্ধ করে দিলে ২০১৫ সালে বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তি করে সৌদি আরব। এরপর এখন পর্যন্ত প্রায় তিন লাখ নারী সৌদি আরবে গেছেন। 

 গত ২৬ সেপ্টেম্বর প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে প্রবাসী মন্ত্রণালয়ের উপস্থাপন করা এক প্রতিবেদন বলছে, সৌদি আরব থেকে গত ২৬ আগস্ট দেশে ফেরা নারী গৃহকর্মীদের প্রায় ৩৫ শতাংশ সেখানে শারীরিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। আর ৪৪ শতাংশ নারীকে নিয়মিত বেতন-ভাতা দেওয়া হতো না।

 গত সেপ্টেম্বরে প্রবাসী মন্ত্রণালয়কে সৌদি আরবে কর্মরত বাংলাদেশি নারী শ্রমিকদের বিষয়ে একটি প্রতিবেদন দিয়েছে জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা অধিদপ্তর। তাদের অনুসন্ধান বলছে, সমস্যাগ্রস্ত ও নির্যাতনের শিকার হয়ে বাংলাদেশ মিশনের মাধ্যমে গত বছর ২ হাজার ৮৬৬ ও এ বছরের জুন পর্যন্ত ৯৬১ জন নারী ফিরে এসেছেন। এ ছাড়া কফিলের (নিয়োগকর্তা) সহায়তায় ও পুলিশের হাতে নিজ থেকে ধরা দিয়ে সমসংখ্যক নারী ফিরে এসেছেন বলে উল্লেখ করা হয় প্রতিবেদনে। এ সংস্থাটির অনুসন্ধান বলছে, ২০১৮ ও ২০১৯ সালে ৮ থেকে ১০ শতাংশ গৃহকর্মী বিভিন্ন সমস্যার কারণে ফিরে এসেছেন।

 সম্প্রতি সৌদি আরবে নারীদের গৃহকর্মীর কাজে না পাঠানোর দাবি সোচ্চার হয়েছে। এ দাবিতে সাধারণ নাগরিকদের পক্ষ থেকে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ে স্মারকলিপি দেওয়া হয়েছে। জাতীয় সংসদেও  প্রশ্নোত্তর পর্বে সম্পূরক প্রশ্ন করতে গিয়ে তিনজন সাংসদ কাজী ফিরোজ রশীদ, মুজিবুল হক ও সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমেদ নিরাপত্তা নিশ্চিত না করে নারী শ্রমিকদের না পাঠানোর একই দাবি জানিয়েছেন। সাংসদদের প্রশ্নের উত্তরে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী ইমরান আহমেদ সংসদে বলেন, ‘আমাদের চেষ্টা থাকবে নারীরা যেন সম্মানজনকভাবে চাকরি করতে পারেন। আর একেবারেই যদি সম্ভব না হয়, তাহলে আমরা না পাঠানোর চিন্তা করব।’

অভিবাসন নিয়ে কর্মরত বিভিন্ন বেসরকারি সংগঠনের কর্মকর্তারা বলছেন, শুধু নারী শ্রমিক বিদেশে পাঠানোর জন্য রিক্রুটিং এজেন্সির সংখ্যা বাড়তে বাড়তে ৬২১টিতে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু নারী শ্রমিকেরা বিদেশে কোনো নির্যাতনের শিকার হলে বা মারা গেলে তখন আর এজেন্সি তার দায়দায়িত্ব নিচ্ছে না। অভিযুক্ত কোনো এজেন্সিকে সরকার আইনের আওতায় এনে কঠোর শাস্তি কার্যকর করেছে, তারও নজির নেই। তবে বিএমইটির পরিচালক (কর্মসংস্থান) ডি এম আতিকুর রহমান বললেন, নির্যাতনের অভিযোগ পেলেই নারীদের দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করা হয়। দায়ী রিক্রুটিং এজেন্সির কাছ থেকে ক্ষতিপূরণও আদায় করে দেওয়া হয়।

 অভিবাসী নারী শ্রমিকদের সুরক্ষায় কাজ করা বাংলাদেশ নারী শ্রমিক কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক সুমাইয়া ইসলাম বললেন, নির্যাতনের শিকার বা লাশ হয়ে ফেরার পর শুধু সামান্য ক্ষতিপূরণ আদায় নয়, নিরাপত্তা ও সুরক্ষা নিশ্চিত না করে কোনো নারী শ্রমিককেই বিদেশে পাঠানো যাবে না।