ভাবো নিজেকে ছাড়িয়ে : বান কি মুন

>
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনের মঞ্চে বান কি মুন। ছবি: সংগৃহীত
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনের মঞ্চে বান কি মুন। ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশ আর্মি স্টেডিয়ামে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৩তম সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হলো ২৩ নভেম্বর। অনুষ্ঠানে সমাবর্তন বক্তা ছিলেন জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব বান কি মুন

উষ্ণ অভ্যর্থনার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ।

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের মহামান্য রাষ্ট্রপতি ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর মো. আবদুল হামিদ, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন, শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি, ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির বোর্ড অব ট্রাস্টিজের সভাপতি তামারা হাসান আবেদ, শিক্ষার্থী ও শিক্ষকমণ্ডলী এবং উপস্থিত সম্মানিত অতিথি, এই সুন্দর ঢাকা শহরে এসে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৩তম সমাবর্তন অনুষ্ঠানের মতো এমন তাৎপর্যপূর্ণ একটি উপলক্ষে আপনাদের সামনে কথা বলতে পারা আমার জন্য দারুণ এক ব্যাপার।

এই সম্মানের জন্য আমি অত্যন্ত কৃতজ্ঞ। তরুণদের জন্য, আমাদের পৃথিবীর জন্য, সামষ্টিক ভবিষ্যতের জন্য এমন গুরুত্বপূর্ণ একটি মিলনমেলায় কথা বলার সুযোগ পাওয়া অবশ্যই ভীষণ অর্থবহ।

আমি বিশেষভাবে সম্মান জানাচ্ছি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের মহামান্য রাষ্ট্রপতি ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর মো. আবদুল হামিদকে, তাঁর নেতৃত্বের জন্য এবং এই বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক সম্পদকে বৈশ্বিক যোগাযোগ ও সেবায় নিয়োজিত করার জন্য।

আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বর্তমানে বিশ্বে এমন একটি নতুন প্রজন্মের দরকার, যারা ভাবতে পারে, কিছু করে দেখাতে পারে।

বান কি মুন। ছবি: সংগৃহীত
বান কি মুন। ছবি: সংগৃহীত

আমাদের এখন এমন চিন্তাশীল কিছু মানুষের প্রয়োজন, যারা আগামী দিনের বৈশ্বিক প্রতিবন্ধকতাগুলোর ব্যাপ্তি ও গভীরতা উপলব্ধি করতে পারবে এবং সবার সামনে তা তুলে ধরবে। আমাদের প্রয়োজন এমন কর্মীরও, যারা সাহস নিয়ে এই প্রতিবন্ধকতাগুলো মোকাবিলায় এগিয়ে আসতে দ্বিধা করবে না।

বর্তমানের এই বিভেদ ও অনিশ্চয়তার যুগে, শিক্ষার যে দিনবদলের শক্তি, তা সর্বস্তরে পৌঁছে দিতে হবে। এ ছাড়া শিক্ষার্থী ও স্নাতক সম্পন্ন করা তরুণদের ক্ষমতায়নের জন্য আমাদের প্রচেষ্টা আরও বাড়াতে হবে এবং তাদের কর্মসংস্থানের জন্য অর্থপূর্ণ পথ প্রদর্শন করতে হবে।

তাহলেই প্রতিহত করা যাবে অসমতা, সাংস্কৃতিক বোঝাপড়া হবে আরও সুগভীর, জোরদার হবে শান্তি ও সম্প্রীতির বন্ধন এবং জীবনের চলার পথে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের ক্ষেত্র তৈরি হবে।

বর্তমানে সংঘাত ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বিভিন্ন রাষ্ট্র এবং ব্যাহত হচ্ছে উন্নয়ন। ৭ কোটি শরণার্থী ও জোরপূর্বক দেশ থেকে বিতাড়িত মানুষের আজ সাহায্য, সংহতি এবং সমস্যার টেকসই সমাধান দরকার। ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া মিথ্যাচার ও গুজব সমাজে সংঘাতের বীজ বপন করছে। এমন ভয়াবহ কিছু সমস্যা মোকাবিলার পরেও আমরা আজ ঐতিহাসিক বৈশ্বিক উন্নয়নের যুগে বাস করছি।

এখন মানুষ দীর্ঘদিন বেঁচে থাকছে, স্বাস্থ্যকর জীবন যাপন করছে। শিশুরা এখন মানসম্মত শিক্ষা গ্রহণ করতে পারছে। এ ছাড়া প্রযুক্তি, বাণিজ্য ও পর্যটনের কল্যাণে আমরা আগের চেয়ে কাছাকাছি এসেছি, যা বিশাল দূরত্ব ও বিস্তর সাংস্কৃতিক ফারাক থাকা সত্ত্বেও আমাদের এক করেছে।

জাতিসংঘের প্রচেষ্টা

জাতিসংঘের মহাসচিব থাকাকালীন আমি শিক্ষার উন্নয়ন, নারীর ক্ষমতায়ন, বৈশ্বিক নাগরিকত্ব ও অংশীদারত্বের ভাবনাকে ছড়িয়ে দিতে চেষ্টা করেছি।

জাতিসংঘের ২০৩০ অ্যাজেন্ডা এবং এর টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি) ব্যাপারে সমগ্র বিশ্বকে একমত করা কষ্টসাধ্য ছিল, প্যারিস জলবায়ু চুক্তির বেলায়ও তাই বলতে হয়। এ দুই উদ্যোগ আমার সবচেয়ে বড় অর্জন। কারণ, এর মধ্য দিয়ে নিশ্চিত হয়েছে মানবতা এবং আমাদের পৃথিবীর জন্য কাঙ্ক্ষিত ভবিষ্যতের সমন্বিত পদরেখা।

কিন্তু এসডিজির লক্ষ্যমাত্রা পূরণ, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা এবং শান্তিপূর্ণ সমাজ গঠনের জন্য জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টা সফল করতে হলে তরুণ ও নারীদের অংশগ্রহণ অত্যন্ত জরুরি। কারণ, বিশ্বের জনসংখ্যার ৭৫ শতাংশই তরুণ ও নারী।

নিঃসন্দেহে তোমরাই সেই সত্যিকারের শক্তি; যারা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ও জলবায়ু লক্ষ্যমাত্রা পূরণকে ত্বরান্বিত করবে এবং তোমরা হয়ে উঠবে আগামী দিনের বিশ্বনাগরিক।

এখন যদি আমরা বিশ্বের অর্ধেক জনগোষ্ঠীকে আটকে রাখি, তাহলে আমাদের পূর্ণ সক্ষমতা ও সম্ভাবনা কাজে লাগানো অসম্ভব হয়ে পড়বে। মূল কথা হলো, আজ পর্যন্ত পৃথিবীর কোনো দেশই সত্যিকার অর্থে নারী-পুরুষের সমতা নিশ্চিত করতে পারেনি এবং এখনো নারীর প্রতি সহিংসতার হার পুরো বিশ্বের সব ধরনের আর্থসামাজিক অবস্থাতেই উদ্বেগজনকভাবে বেশি।

তাই, এই অবস্থা থেকে উত্তরণে আর নারীর ক্ষমতায়নের জন্য আমাদের আরও সক্রিয় হতে হবে। তাই আমাদের সবচেয়ে কঠিন প্রতিবন্ধকতাগুলো মোকাবিলায় ও আন্তর্জাতিক লক্ষ্যমাত্রাগুলো অর্জনের একটি অনন্য উপায় হতে পারে বৈশ্বিক নাগরিকত্ব। একজন বিশ্বনাগরিক নিজেকে শুধু একটি নির্দিষ্ট রাষ্ট্রের প্রতিনিধি নয়, বরং তিনি নিজেকে সমগ্র মানবজাতির অংশ মনে করবেন।

বিশ্বনাগরিকেরা ভিন্ন জাতিগোষ্ঠী, সংস্কৃতি ও ভিন্ন ধর্মের মানুষের প্রতি সহনশীল ও শ্রদ্ধাভাজন হবেন। তাঁরা নারী-পুরুষের সমতা, পৃথিবীর সুরক্ষা ও মানবাধিকার রক্ষার জন্য সংগ্রাম করবেন।

শরণার্থী ও অভিবাসীনির্বিশেষে তাঁরা সবার সেবা ও সাহায্যের জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ থাকবেন। বিশ্বনাগরিক হিসেবে তাঁরা মানুষে মানুষে সেতুবন্ধ গড়বেন, দেয়াল নয়।

তাই এসব কারণেই, বৈশ্বিক নাগরিকত্বকে বিশ্বের তরুণদের কাছে একটি উজ্জীবনীমূলক লক্ষ্য হিসেবে তুলে ধরার জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছি। আমার বিশ্বাস, এটা তরুণসমাজ ও নারীদের জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণের পরিধিকে আরও বিস্তৃত করবে, সেই সঙ্গে তাদের আত্মমর্যাদার সঙ্গে এটি যুক্ত করবে আরও দায়িত্ববোধ।

তরুণদের প্রতি আহ্বান

প্রিয় শিক্ষার্থীরা, আমাদের প্রতিবন্ধকতাগুলোর ব্যাপ্তি এতই বিশাল যে এর সমাধানের দায়িত্ব কয়েকজন নেতার হাতে ছেড়ে দিলে হবে না। একটি সমতাপূর্ণ পৃথিবী গড়তে হলে আমাদের সবাইকে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে।

বর্তমানের তরুণ প্রজন্মের ওপর আমার অগাধ আস্থা। তোমাদের ভূমিকা এখন অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি তাৎপর্যপূর্ণ। যতটা অধিকারের ধারক হিসেবে, ততটাই ভবিষ্যৎ নেতা হিসেবে। দিনবদলের প্রতিনিধি এবং আগামী দিনের প্রগতিশীল বিশ্বনাগরিক হিসেবে সাহসের সঙ্গে নিজের ভবিষ্যৎ এবং এই বিশ্বের ভবিষ্যতের জন্য আওয়াজ তুলতে আমি তোমাদের আহ্বান জানাই।

বৈশ্বিক বিষয়ে সক্রিয় থাকার জন্য তোমরা নিজেদের লক্ষ্য, ভবিষ্যৎ কাজ ও বর্তমান পড়াশোনাকে আরও জোরদার করো। নিজের চারপাশ, নিজের শহর ও দেশের বাইরে গিয়ে দৃষ্টিসীমাকে প্রসারিত করো। ভাবো নিজেকে ছাড়িয়ে।

জাতিসংঘের বৈশ্বিক লক্ষ্যমাত্রা যেন স্থানীয়দের কাছে পৌঁছায়, এটা নিশ্চিত করা খুব জরুরি। আমাদের পৃথিবী একটাই, আর একে টিকিয়ে রাখার প্রচেষ্টাই আমাদের সামগ্রিক ভবিষ্যৎকে নিরাপদ করবে।

তোমাদের হাতেই টেকসই, শান্তিপূর্ণ ও সমৃদ্ধ পৃথিবী গড়ার চাবিকাঠি। তোমাদের কণ্ঠের কতটা শক্তি, তা তোমরা জানো না।

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৯ সালের স্নাতকেরা; তোমরা আমাদের সবার জন্য একটি সুন্দর ভবিষ্যতের দ্বার খুলে দেবে, এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই।

অভিনন্দন! তোমাদের সময়ের জন্য ধন্যবাদ।

ইংরেজি থেকে অনুবাদ: তাবাস্‌সুম ইসলাম