বিশ্বমঞ্চে আমরা আমাদের দেশ

এ বছর যুক্তরাজ্যে অনুষ্ঠিত বিশ্বের সবচেয়ে বড় তরুণদের সম্মেলন—ওয়ান ইয়ং ওয়ার্ল্ডে অংশ নিয়েছিল বাংলাদেশি তরুণদের কয়েকজন। ছবি: সংগৃহীত
এ বছর যুক্তরাজ্যে অনুষ্ঠিত বিশ্বের সবচেয়ে বড় তরুণদের সম্মেলন—ওয়ান ইয়ং ওয়ার্ল্ডে অংশ নিয়েছিল বাংলাদেশি তরুণদের কয়েকজন। ছবি: সংগৃহীত

বিশ্বের নানা প্রান্তে অনুষ্ঠিত হচ্ছে বিভিন্ন রকম সভা, সম্মেলন, উৎসব, কর্মশালা, প্রতিযোগিতা। ভিনদেশে গিয়ে আয়োজনের অংশ হওয়া যায়, আবার দেশে বসেও আন্তর্জাতিক মঞ্চে লাল-সবুজের প্রতিনিধিত্ব করা সম্ভব। বৈশ্বিক আয়োজনগুলোতে কীভাবে ও কেন অংশগ্রহণ করবেন, এ প্রসঙ্গে লিখেছেন ইয়ুথ অপরচুনিটিজের প্রতিষ্ঠাতা ওসামা বিন নূর

হোক তরুণদের সম্মেলন কিংবা উদ্যোক্তাদের সভা, রচনা লেখার প্রতিযোগিতা অথবা উদ্ভাবনী ভাবনা উপস্থাপনের মঞ্চ—আজকাল এসব জায়গাতেই প্রতিনিধিত্ব করছেন বাংলাদেশের তরুণেরা। কেউ পুরস্কার পাচ্ছেন, কারও একটা ভালো নেটওয়ার্ক তৈরির সুযোগ হচ্ছে, কেউবা এই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে সফলতা পাচ্ছেন পেশাজীবনে। 

তোমরা অনেকে হয়তো পত্রপত্রিকা, ফেসবুক বা অনলাইন পোর্টালে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সম্মেলনের খবর দেখেছ। তোমার ক্যাম্পাসে হয়তো তোমার পরিচিত কোনো বন্ধুই সম্মেলনে অংশগ্রহণ করতে গিয়ে ঘুরে এসেছে ভারত, তুরস্ক কিংবা যুক্তরাজ্য। তুমি ভাবছ—আমি কি অংশগ্রহণ করতে পারব? এসব আয়োজনে অংশ নিতে হলে কি অনেক টাকা লাগে? আন্তর্জাতিক মঞ্চে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করার মতো যোগ্যতা বা আত্মবিশ্বাস কি আমার আছে? এসবে অংশগ্রহণ করার প্রয়োজনই–বা কী? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর যারা খুঁজছ, লেখাটি তাদের জন্যই।

কেন অংশগ্রহণ করব 

পড়ালেখার পাশাপাশি সহশিক্ষা কার্যক্রমে অংশগ্রহণের গুরুত্ব এখন আর নতুন করে বলার কিছু নেই। আন্তর্জাতিক মঞ্চগুলোতে নিজের দেশের প্রতিনিধিত্ব করার একটা আনন্দ আছে। পুরস্কার বা কোনো সনদ যদি না-ও পাও, তবু তোমার প্রাপ্তির খাতায় যোগ হতে পারে নানা কিছু। কেন আন্তর্জাতিক সভা-সম্মেলন-কর্মশালায় অংশ নেওয়া জরুরি, সেটা একটু ভেবে দেখা যাক।

১. দক্ষতা বৃদ্ধি

শিক্ষাজীবনেই তোমাকে এমন কিছু দক্ষতা অর্জন করে ফেলতে হবে, যেটা ভবিষ্যৎ জীবনে কাজে লাগবে। আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অংশগ্রহণের সুবিধা হলো, এই অভিজ্ঞতা তোমাকে এক ধাক্কায় অনেক কিছু শিখিয়ে দেবে। নেতৃত্বের গুণাবলি, পারস্পরিক যোগাযোগ, সমস্যা সমাধান, বক্তৃতা দেওয়া, নিজের ভাবনা উপস্থাপন করা থেকে শুরু করে ঠিকঠাকভাবে ই–মেইল লেখা পর্যন্ত অনেক গুণাবলির চর্চা হতে পারে বিভিন্ন সম্মেলনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে। এই গুণাবলি কিন্তু এখন যেকোনো কর্মক্ষেত্রেই ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। 

২. গবেষণা প্রকাশ করা 

শিক্ষাজীবনে গবেষণা করা ও গবেষণা নিবন্ধ প্রকাশ করা শিক্ষার্থীর জন্য একটু কঠিন। তবে আন্তর্জাতিক অনেক সম্মেলন আছে, যেখানে শিক্ষার্থীরা তাদের গবেষণা প্রকাশ ও উপস্থাপন করার সুযোগ পায় অন্যান্য দেশের শিক্ষক ও গবেষকদের সামনে। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে অনেক শিক্ষার্থী কোনো অধ্যাপকের অধীনে বৃত্তি নিয়ে স্নাতকোত্তর বা পিএইচডি করার সুযোগও পেয়ে যায়। তবে সবচেয়ে বড় পাওয়া হলো, ভুলগুলো জানা যায়, গবেষণাটি এগিয়ে নেওয়ার দিকনির্দেশনা পাওয়া যায়।

৩. সমমনাদের সঙ্গে পরিচয়

শিক্ষার্থী থাকাকালীন আমরা অনেকেই নানা উদ্যোগ নিই—সামাজিক বা ব্যবসায়িক। উদ্যোগগুলো বাস্তবায়ন করতে বা এগিয়ে নিতে সমমনা মানুষদের সঙ্গে একযোগে কাজ করতে পারলে বেশ ভালো ফল পাওয়া যায়। কেউ হয়তো কাজ করছ টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) নিয়ে, কেউ হয়তো তথ্যপ্রযুক্তি নিয়ে, আবার কেউ হয়তো স্বাস্থ্য নিয়ে। প্রতিটি ক্ষেত্রেই রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন আয়োজন, যেখানে বিশ্বের নানান প্রান্ত থেকে আসা সমমনাদের সঙ্গে জ্ঞান বিনিময়ের সুযোগ হয়। পরিচিত হওয়া যায় বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে। দেশে বা দেশের বাইরে তুমি হয়তো এমন কাউকে বা কয়েকজনকে পেয়ে যাবে, যে বা যারা ঠিক তোমার মতো করেই একটা সমস্যা সমাধানের কথা ভাবছে। একসঙ্গে তোমরা হয়তো দারুণ কোনো উদ্যোগ নিতে পারো। অন্তত নিজেদের ভাবনাগুলো ভাগাভাগি করে নিতে পারবে।

৪. নতুন কিছু শেখা

আন্তর্জাতিক কোনো সম্মেলনে অংশগ্রহণের ফলে সেই সুযোগে ঘুরেফিরে দেখা যায় ওই দেশটিও, জানা যায় তাদের সংস্কৃতি, খাবার, ভাষা, ঐতিহ্য সম্পর্কে। তৈরি হয় নতুন কিছু বন্ধু। আর বন্ধুদের নিয়ে চিন্তা, গবেষণা, কাজের পরিধি ছড়িয়ে পড়ে দেশ ছাড়িয়ে বিশ্বব্যাপী। হয়তো এ সুযোগে নতুন কোনো ভাষা শেখার শুরু হতে পারে। কিংবা তুমি হয়তো এমন কোনো সৃজনশীল কাজের খোঁজ পেয়ে যেতে পারো, যে কাজে তোমার দক্ষতার কথা তুমি নিজেও জানতে না! 

সুযোগের কত ধরন 

কত রকম চমকপ্রদ, বিচিত্র সুযোগ যে আছে, একবার খোঁজ করা শুরু করলে নিশ্চয়ই তুমি বিস্মিত হবে। আমাদের ওয়েবসাইটে (www.youthop.com) সাম্প্রতিক সময়ের নানা সভা, সম্মেলন, কর্মশালা, প্রতিযোগিতার খোঁজ তো আছেই, চাইলে পছন্দ অনুযায়ী গুগলে সার্চ করেও জানতে পারো। 

কয়েকজনের উদাহরণ দিলে হয়তো বুঝতে সুবিধা হবে। যেমন বাংলাদেশের গুলনাহার মাহবুব নারী বাস্কেটবল খেলোয়াড়দের ক্ষমতায়ন নিয়ে কাজ করছেন। ‘দেশি বলারস’ নামে একটি সংগঠনের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা তিনি। দেশে নারী শিক্ষার্থীদের বাস্কেটবল খেলায় উদ্বুদ্ধ করা ও তাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে যাচ্ছে এই সংগঠন। তাঁর এই কাজের সুবাদে যুক্তরাজ্যের লন্ডনে অনুষ্ঠিত ‘ওয়ান ইয়ং ওয়ার্ল্ড’ সম্মেলনে আমন্ত্রিত হয়েছিলেন তিনি, যেটি সারা বিশ্বের তরুণদের নিয়ে সবচেয়ে বড় সম্মেলন। কুইন্স কমনওয়েলথ ট্রাস্টের বৃত্তি পেয়ে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন গুলনাহার মাহবুব। ট্রাস্টের প্রেসিডেন্ট প্রিন্স হ্যারি ও ভাইস প্রেসিডেন্ট, ডাচেস অব সাসেক্স মেগান মারকেলের সঙ্গে বিশেষ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করার সুযোগ পেয়েছিলেন তিনি। 

আইনুল ইসলাম সাকিবও দারুণ একটা সুযোগ পেয়েছিল। বিশ্বের সবচেয়ে বড় ক্রীড়া আসর অলিম্পিক গেমস নিয়ে কে না আগ্রহী। স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে যদি এই বিশাল মহাযজ্ঞে খেলোয়াড়দের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ পাওয়া যায়, তাহলে তো কথাই নেই! ইয়ুথ অপরচুনিটিজের মাধ্যমে এই সুযোগের খবর পেয়ে আইনুল ইসলাম সঙ্গে সঙ্গে আবেদন করেছিল, নির্বাচিত হয়ে অলিম্পিকে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করার সুযোগ পায় সে। আরও নানা দেশের স্বেচ্ছাসেবকদের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে তার, অনেক গল্প আর অভিজ্ঞতা জমা হয়েছে ঝুলিতে।

কীভাবে অংশগ্রহণ করব

তরুণদের জন্য দেশে বা দেশের বাইরে বছরজুড়ে বিষয়ভিত্তিক নানা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। একেকটিতে অংশগ্রহণের জন্য নিজস্ব কিছু আবেদন ও নির্বাচন–প্রক্রিয়া আছে। তবে কিছু কিছু বিষয় প্রায় সব আবেদন–প্রক্রিয়াতেই থাকে, যেমন একটি বৈধ পাসপোর্ট থাকা, আবেদন–প্রক্রিয়ায় কিছু প্রশ্নের উত্তর দেওয়া। কেন তুমি সম্মেলনে আবেদন করেছ, কেন তোমাকে তারা নির্বাচিত করবে, এসব প্রশ্নের উত্তর লিখতে হবে। এ ছাড়া অনেক সময় সহশিক্ষামূলক বা সামাজিক কার্যক্রম, গবেষণার অভিজ্ঞতা, কোনো বিশেষ দক্ষতা বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভালো ফল ও কিছু সনদও কাজে আসে। কোনো কোনো আয়োজনে ভাষা দক্ষতার প্রমাণ দিতে হয়। 

শিক্ষার্থী থাকাকালীন নিজের টাকায় আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অংশগ্রহণ করা অনেকের জন্যই কষ্টসাধ্য। কিন্তু আনন্দের বিষয় হচ্ছে, এমন অনেক আয়োজন আছে, যেখানে অংশগ্রহণকারীর বিমান ভাড়া, থাকা-খাওয়া থেকে শুরু করে সব রকম খরচই আয়োজকেরা বহন করে বা অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান বৃত্তি দিয়ে থাকে, যেগুলোকে বলা হয় ফুললি ফান্ডেড প্রোগ্রাম। আবার কিছু আয়োজন আছে, যেখানে আংশিক খরচ (পারশিয়ালি ফান্ডেড) দিতে হয়। 

প্রথম কথা হলো, তোমার আগ্রহ আছে কি না। আগ্রহ, দক্ষতা ও সামর্থ্যের সঙ্গে সমন্বয় করে কোনো না কোনো আয়োজনের খোঁজ তুমি নিশ্চয়ই পাবে। হয়তো প্রথমবারেই সুযোগ পাবে না। এমন অনেককে আমি দেখেছি, একবার সুযোগ না পেয়েও তারা বারবার চেষ্টা করে যাচ্ছে। লেগে থাকলে নিশ্চয়ই একদিন সুফল পাওয়া যাবে। 

লেখক: ইয়ুথ অপরচুনিটিজের প্রতিষ্ঠাতা