দেশে পাঁচ বছরে ৫৭ খুন

অলংকরণ: আরাফাত করিম
অলংকরণ: আরাফাত করিম

যৌন হয়রানির ঘটনার প্রতিবাদ করায় গত প্রায় পাঁচ বছরে বখাটেদের হাতে প্রাণ হারিয়েছেন ৫৭ জন নারী-পুরুষ। খুন হওয়া ব্যক্তিদের তালিকায় যৌন হয়রানির শিকার মেয়ে ও নারী, ওই মেয়ে ও নারীর বাবা, মা, মামাসহ বিভিন্নজন রয়েছেন।

বেসরকারি সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের দেওয়া তথ্য বলছে, প্রতিবাদ করে খুন হওয়া ৫৭ জনের মধ্যে পুরুষ ৩৫ জন আর নারী ২২ জন। এ সংগঠন নয়টি জাতীয় দৈনিক এবং আসকের সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে এ পরিসংখ্যান দিয়েছে। তথ্য বলছে, ২০১৫ সালে প্রতিবাদ করে খুন হন ৬ জন। এরপর চলতি বছরের অক্টোবর মাস পর্যন্ত প্রতিবছর ১০ জনেরও বেশি খুন হয়েছেন শুধু যৌন হয়রানির প্রতিবাদ করে। চলতি বছরেই অক্টোবর পর্যন্ত সংখ্যাটি দাঁড়িয়েছে ১২, এর মধ্যে ৮ জনই পুরুষ।

আসকের দেওয়া পরিসংখ্যান বলছে, যৌন হয়রানির কারণে ২০১৫ সাল থেকে চলতি বছরের অক্টোবর মাস পর্যন্ত আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছেন ৪৮ জন। যৌন হয়রানির প্রতিবাদ করতে গিয়ে বিভিন্নভাবে লাঞ্ছিত হওয়া মানুষের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৮৭০। যৌন হয়রানির ঘটনাকে কেন্দ্র করে আহত হয়েছেন ২৪১ জন। তবে নারী ও মানবাধিকার নিয়ে কর্মরতরা বলছেন, বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যগুলো বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের পরিসংখ্যানে তুলে ধরা হচ্ছে। তবে সামাজিকতাসহ বিভিন্ন দিক বিবেচনায় যৌন হয়রানির বেশির ভাগ ঘটনা গণমাধ্যমে প্রকাশিতই হচ্ছে না। আর যৌন হয়রানির ঘটনায় খুন বা গুরুতর আহত না হলে সেভাবে আইনের আশ্রয় নেওয়ার হারও এখনো কম।

তবে যৌন হয়রানির ঘটনায় একেবারে চুপ করে থাকার সংস্কৃতিতে পরিবর্তন ঘটেছে। যৌন হয়রানির শিকার ব্যক্তিদের অনেকেই পরিবারকে জানানোর পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকেও তা প্রকাশ করছেন। ফেসবুকের স্ট্যাটাস দেখে পুলিশের পক্ষ থেকে ওই ঘটনায় পদক্ষেপ নেওয়ারও নজির আছে। পুলিশের পক্ষ থেকে নারীদের যৌন হয়রানি থেকে বাঁচতে বা প্রতিরোধে করণীয় নিয়ে বিভিন্ন প্রচার বেড়েছে।

মানবাধিকার আইনজীবী সালমা আলী বললেন, যৌন হয়রানির প্রতিবাদ করতে গিয়ে এত মানুষের খুন হওয়া বিষয়টি খুবই ভয়াবহ। অপরাধী চক্র প্রভাবশালী। অন্যদিকে, বিচারহীনতার সংস্কৃতিতে অপরাধীরা ভেবেই নিচ্ছে, তাদের কিছু হবে না। তাই অপরাধীদের প্রতিহত করতে হলে সামাজিক আন্দোলন জোরদার করতে হবে। খুন হওয়ার ব্যক্তির পরিবারের সদস্যরা সুবিচার পেলেন কি না, তাও নজরদারি করতে হবে।

 যৌন নিপীড়ন প্রতিরোধে কেন রাষ্ট্রীয় কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে না—এই মর্মে ২০০৮ সালে সুপ্রিম কোর্টে একটি রিট মামলা করেছিলেন আইনজীবী সালমা আলী। ২০০৯ সালের হাইকোর্টের ওই রায়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সরকারি–বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, গণমাধ্যমসহ সব প্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে ‘যৌন হয়রানি প্রতিরোধ কমিটি’ নামে একটি কমিটি গঠনের আদেশ দেওয়া হয়। এ নির্দেশনা সংবিধানের ১১১ অনুচ্ছেদ, যেখানে সুপ্রিম কোর্টের রায়ের বাধ্যতামূলক কার্যকরতা সম্পর্কে বলা হয়েছে, সে অনুযায়ী কার্যকর হওয়ার কথা ছিল। তা হয়নি। ২০১০ সাল থেকে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে আইন প্রণয়ন করা হবে। আইনটি চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত আইনটি আলোর মুখ দেখেনি। সালমা আলীর মতে, সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে আইন প্রণয়নে বিলম্ব হচ্ছে।

প্রথম আলোর খবর অনুযায়ী, চলতি বছরের ২২ নভেম্বর মেয়ের যৌন হয়রানির প্রতিবাদ করায় যশোরে বখাটের লাথিতে মেয়েটির বাবা আবদুর রাজ্জাক (৪৫) মারা যান। মেয়ের গোসল করার দৃশ্য ভিডিও করে ব্ল্যাকমেল করেছিল বখাটেরা।

 চলতি বছরের জুন মাসে ঠাকুরগাঁও এলাকার বিভিন্ন মেয়েকে উত্ত্যক্ত করার প্রতিবাদ করায় হাসপাতালে যাওয়ার পথে বখাটে দূরসম্পর্কের ভাতিজার ছুরিকাঘাতে প্রাণ হারান তানজিনা আক্তার নামের এক নার্স।

গত বছরের শুরুর ঘটনা। কলেজে যাওয়া-আসার পথে এক ছাত্রীকে উত্ত্যক্ত করত বখাটেরা। এর প্রতিবাদ করায় ছাত্রীটির ফুপাতো ভাইকে লাঠি ও রড দিয়ে পিটিয়ে আহত করে বখাটেরা। পরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ভাইয়ের মৃত্যু হয়। নারায়ণগঞ্জের এ মৃত্যুর খবর জানাজানি হলে স্থানীয় লোকজন বখাটেদের বাড়িঘর আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দেন।

প্রাণে বাঁচলেও...

যৌন হয়রানির প্রতিবাদ করতে গিয়ে খুন না হলেও যৌন হয়রানির শিকার বা প্রেমের প্রস্তাবে রাজি না হওয়া নারীর পাশাপাশি পরিবারের সদস্যদের মরণাপন্ন অবস্থা হওয়ার ঘটনাও ঘটছে।

চলতি বছরের এপ্রিল মাসে বাসের চালক ও তাঁর সহকারীর ‘যৌন হয়রানি’ থেকে বাঁচতে চলন্ত বাস থেকে লাফ দেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের প্রথম বর্ষের এক ছাত্রী। পরে ছাত্রী নিজে বাদী হয়ে মামলা করলে জড়িত বাসচালককে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

চলতি বছরের আগস্ট মাসে স্ত্রীকে যৌন হয়রানি করায় প্রতিবাদ করেছিলেন, এ কারণে মারধরের শিকার হয়েছিলেন রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং (ইইই) বিভাগের শিক্ষক রাশিদুল ইসলাম। তিনি বিষয়টি নিয়ে ফেসবুকেও পোস্ট দিয়েছিলেন।

২০১৫ সালে পয়লা বৈশাখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ফটকে নিপীড়নকারীদের ঠেকাতে গিয়ে ছাত্র ইউনিয়নের তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি লিটন নন্দীর হাত ভাঙে।

বর্তমানে কমিউনিস্ট পার্টির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত লিটন নন্দী বললেন, সমাজে নারী ও পুরুষের মধ্যে যে স্বাভাবিক সম্পর্ক থাকার কথা, তাতে অবনতি ঘটেছে। মূল্যবোধের অবক্ষয়সহ বিভিন্ন কারণে নারী ও শিশু নির্যাতন বেড়েছে। এখনো অনেকেই মনে করেন, নারীরা উৎসবে বা বাইরে বের হলে এক–আধটু যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটতেই পারে। এ ধরনের মানসিকতা নির্যাতনের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। তাই মনমানসিকতা পরিবর্তনের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে এ ধরনের নির্যাতনের সমাধান করতে হবে, যাতে তা টেকসই হয়।

দুটি আলোচিত মামলা...

গত ২৭ মার্চ সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলা নিজ কক্ষে ডেকে নিয়ে মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে যৌন হয়রানি করেন। এ ঘটনায় তাঁর মা শিরিনা আক্তার বাদী হয়ে সোনাগাজী মডেল থানায় মামলা করেন। মামলা তুলে না নেওয়ায় গত ৬ এপ্রিল পরীক্ষাকেন্দ্রের ভেতরে সিরাজ উদদৌলার অনুসারী বোরকা পরা পাঁচজন ছাদে ডেকে নিয়ে হাত-পা বেঁধে শুইয়ে নুসরাতের গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন লাগিয়ে দিলে ১০ এপ্রিল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। গত ২৪ অক্টোবর নুসরাত হত্যা মামলার রায়ে অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলাসহ ১৬ জনের মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন আদালত। নুসরাত মৃত্যুর আগপর্যন্ত চেয়েছেন, সর্বোচ্চ শাস্তি হোক আসামিদের।

২০১৭ সালে সিলেটের কলেজছাত্রী খাদিজা বেগম হত্যাচেষ্টা মামলায় একমাত্র আসামি বদরুল আলমকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। রায়ে আদালত বলেন, মানুষের মধ্যে প্রেম-ভালোবাসা থাকতেই পারে। কিন্তু তার জন্য এ ধরনের নৃশংসতা, নিষ্ঠুরতা ও ঘৃণ্য কর্মকাণ্ড কাম্য হতে পারে না। খাদিজার ঘটনাটি ঘটেছিল ২০১৬ সালের ৩ অক্টোবর। বদরুল খাদিজাকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে গুরুতর আহত করেন। ঘটনার পরপরই জনতা ধাওয়া দিয়ে বদরুলকে আটক করে পুলিশে দেয়। কোপানোর ভিডিওটি ফেসবুকে ভাইরাল হয়।