'বিজ্ঞানীর সবচেয়ে বড় ক্ষমতা মানসিক শক্তি'

>
স্ট্রিং তত্ত্ববিদ হিসেবে সারা বিশ্বে পরিচিত বাঙালি বিজ্ঞানী অশোক সেন। ছবি: প্রথম আলো
স্ট্রিং তত্ত্ববিদ হিসেবে সারা বিশ্বে পরিচিত বাঙালি বিজ্ঞানী অশোক সেন। ছবি: প্রথম আলো
ভারতের নামী তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী অশোক সেন। স্ট্রিং তত্ত্ববিদ হিসেবে তিনি সারা বিশ্বে পরিচিত। সম্প্রতি ‘হাই এনার্জি ফিজিকস’বিষয়ক একটি আয়োজনে অংশ নিতে বাংলাদেশে এসেছিলেন। তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক আরশাদ মোমেন। সঙ্গে ছিলেন মাসিক সাময়িকী বিজ্ঞানচিন্তার নির্বাহী সম্পাদক আবুল বাসার এবং সহসম্পাদক আব্দুল গাফফার

শুরুতেই আপনার শৈশব, কৈশোর ও লেখাপড়া সম্পর্কে জানতে চাই।

অশোক সেন: উত্তর কলকাতায় জন্ম আমার। সেখানেই বড় হয়েছি। বিএসসি পর্যন্ত আমার শিক্ষাজীবন কলকাতাতেই কেটেছে। শৈলেন্দ সরকার বিদ্যালয় নামে এক বাংলা মিডিয়াম স্কুলে পড়াশোনার হাতেখড়ি। খুব উন্নত মানের না হলেও সেটার লেখাপড়ার মান খুব খারাপও ছিল না। এরপর উচ্চ শিক্ষার জন্য প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হয়েছিলাম। সেখানে আমি বেশ কয়েকজন ভালো শিক্ষক পেয়েছিলাম। অমল রায় চৌধুরী; বিখ্যাত রায়চৌধুরী সমীকরণের জনক—তিনি সরাসরি আমার শিক্ষক ছিলেন। থার্মোডায়নামিকস পড়াতেন তিনি। আমি যে গবেষণায় আগ্রহী হয়ে উঠি, এর পেছনে তাঁর ভূমিকা ছিল। আমাদের ব্যাচে সবাই খুব আগ্রহী ছিল পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে। সহপাঠী যারা ছিল, তাদের পাঁচজনই বোর্ডে স্ট্যান্ড করা। স্নাতকের পর কানপুরের আইআইটিতে পড়তে যাই। ওখানে মাস্টার্স করি পদার্থবিদ্যায়। তারপর তো যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি দিই।

এখন কী নিয়ে গবেষণা করছেন?

অশোক সেন: বর্তমানে এলাহাবাদের হরিশচন্দ্র রিসার্চ সেন্টারে গবেষণা করছি। স্ট্রিং থিওরি নিয়ে। স্ট্রিং তত্ত্বের তো অনেকগুলো ক্ষেত্র আছে, এগুলোর বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রেই আমার কাজ।

স্ট্রিং থিওরি বিষয়টি কী, কিশোর-তরুণ পাঠকদের জন্য একটু সহজ ভাষায় বুঝিয়ে বলবেন?

অশোক সেন: এটা বোঝার জন্য আগে পদার্থবিজ্ঞানের একটা দুর্বলতার কথা জানতে হবে। সেটা হলো মহাকর্ষ বলের সঙ্গে কোয়ান্টাম বলবিদ্যার বৈরিতা। সবল নিউক্লীয়, দুর্বল নিউক্লীয় কিংবা বিদ্যুৎচুম্বকীয় বলকে কোয়ান্টাম মেকানিকস দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়। কিন্তু মহাকর্ষ বলকে কোয়ান্টাম বলবিদ্যা দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না। স্ট্রিং থিওরির মূল কথা হলো, প্রকৃতির যেসব উপাদান—সেগুলো ভাঙলে একসময় মূল কণিকাগুলো পাওয়া যায়। কিন্তু স্ট্রিং থিওরি বলে, এই মূল কণাগুলোও আসলে একধরনের তন্তু বা সুতার কম্পন। সেই সুতা বা স্ট্রিংগুলোর বিভিন্ন মোডে কম্পনের কারণেই সেগুলোকে কণা হিসেবে আমরা দেখি। এটা শুধু একটা গাণিতিক চিন্তা থেকে শুরু হয়েছিল। তখন অবশ্য মহাকর্ষের সঙ্গে এর সম্পর্কের কথা কেউই ভাবেনি। পরে দেখা গেল, স্ট্রিং থিওরিতে একটা মৌলিক কণা স্বয়ংক্রিয়ভাবে চলে আসছে, সেটা ঠিক মহাকর্ষের মতো আচরণ করে। সেই কণাটা কোয়ান্টায়িত। অর্থাৎ কোয়ান্টাম মহাকর্ষের একটা তত্ত্ব পাওয়া গেল স্ট্রিং থিওরি থেকে। এটা আসলে পেনিসিলিন আবিষ্কারের মতো অপ্রত্যাশিত এক আবিষ্কার।

এ দেশের কোনো শিক্ষার্থী যদি আপনার সঙ্গে গবেষণা করতে আগ্রহী হন, তাঁকে কী বলবেন?

অশোক সেন: প্রথমেই আমাদের ইনস্টিটিউটে আবেদন করতে হবে। এখানে প্রাথমিকভাবে নির্বাচিত হলে সাক্ষাৎকারের জন্য ডাকা হবে। মনোনীত হলে কাজ করার সুযোগ মিলবে সহজেই।

দেশে স্ট্রিং গবেষণা শুরু করতে চাইলে আমাদের কী কী করা উচিত?

অশোক সেন: এখানকার পরিস্থিতি তো আমি জানি না, ভারতে যেভাবে শুরু হয়েছিল সেটা বলতে পারি। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরেও কিছু কিছু গবেষণা ইনস্টিটিউট শুরু করা হয় সেখানে। ওখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরের এইসব রিসার্চ ইনস্টিটিউটেও বেশ কিছু মৌলিক গবেষণার কাজ হচ্ছিল। বাইরে থেকেও অনেক বিখ্যাত বিজ্ঞানী আনা হয়েছিল। এখন আমাদের মনে হয়, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রিসার্চ ইনস্টিটিউট আলাদা করা উচিত হয়নি। একসঙ্গে থাকলে আরও বেশি শিক্ষার্থী এই গবেষণাগুলোতে অংশ নিতে পারত। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে মিলিয়ে রিসার্চ ইনিস্টিটিউট চালু করলে অধ্যাপকেরাও কাজ শুরু করার সুযোগ পাবেন। শিক্ষার্থীরাও তখন এসব গবেষণায় অংশ নিতে পারবে।

আমাদের বিজ্ঞানীরা দেশের বাইরে গেলেও তাঁদের দেশে ফিরিয়ে আনা কষ্টকর। কীভাবে তাঁদের দেশে ফিরিয়ে বিজ্ঞান গবেষণায় নিযুক্ত করা যায়?

অশোক সেন: দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য আসলে একটা আকর্ষণ প্রয়োজন। একজন-দুজন তো আর ফিরবেন না। বরং পুরো একটা দল হিসেবে ফিরলে কাজ করা সুবিধা। যখন তাঁরা এখানে কাজ করবেন, তখন দলের সঙ্গে বিদেশি বিজ্ঞানীদের যুক্ত করতে পারলে ভালো। মৌলিক গবেষণার জন্য পর্যাপ্ত অর্থের জোগানও দিতে হবে। আবার ভালো বেতনের ব্যবস্থা করতে হবে। এ ছাড়া এখানে কাজ করেও যেন দেশের বাইরে তাঁরা গবেষণার সুযোগ পান, সে দিকে লক্ষ রাখতে হবে।

দক্ষিণ এশিয়ার ভারত তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানে এগিয়ে। এর সঙ্গে বাংলাদেশসহ অন্য দেশগুলো নিয়ে আঞ্চলিক একটা গবেষণাবলয় তৈরি করা যায় কি না, যেমনটা ইউরোপে হয়েছিল সার্ন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে।

অশোক সেন: দক্ষিণ এশিয়ার সরকার ও নীতিনির্ধারকদের এগুলো নিয়ে ভাবতে হবে। এটা অসম্ভব কিছু নয়। আবার সব সময় সরকারকেই ভাবতে হবে এমন নয়। এখানকার ইনস্টিটিউট ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এই উদ্যোগ নিতে পারে। সেখানে শুরুতেই হয়তো সব দেশকে একত্র করা যাবে না। হয়তো দুটো দেশ মিলেই শুরু করতে পারে। চীন, কোরিয়া আর জাপান মিলে যেমন এশিয়ান ফিজিকস স্কুল করে। একবার শুরু করা গেলে, সেটা এগিয়ে নেওয়া খুব বেশি কঠিন কিছু হবে না। ভারতে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোও বিনিয়োগ করে। সেটা এ দেশেও শুরু হতে পারে।

আমাদের তরুণ পাঠকদের অনেকে বিজ্ঞানী হতে চান। তাঁদের উদ্দেশে কিছু বলুন।

অশোক সেন: বিজ্ঞানী হতে গেলে আগ্রহ থাকা চাই। কারও যদি আগ্রহই না থাকে, তাহলে আসলে এ পথে আসা উচিত নয়। মনে রাখতে হবে, বিজ্ঞানে সমস্যা কখনো একই ধারায় চলে না। দেখা যায় বহু চেষ্টা করেও অনেক সমস্যার সমাধান করা যাচ্ছে না। কোনো কোনো পরীক্ষা বাস্তবে অসম্ভব হয়ে দাঁড়াতে পারে। এখানে বিজ্ঞানীর সবচেয়ে বড় ক্ষমতা হলো মানসিক শক্তি। এমন অবস্থা মোকাবিলা করার জন্য তরুণ বিজ্ঞানীকে মানসিকভাবে শক্তিশালী হতে হবে। আগ্রহ আর অধ্যবসায় কাজে লাগিয়ে সামনে এগোতে হবে। ব্যর্থ হলেই পথ বদলে নেওয়া চলবে না।

বাঙালি বিজ্ঞানী

অধ্যাপক অশোক সেনের জন্ম কলকাতায়, ১৯৫৬ সালে। কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজের স্নাতক তিনি। যুক্তরাষ্ট্রে স্টোনি ব্রুক বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করে পোস্ট ডক্টরাল গবেষণা করেছেন ফার্মিল্যাব ও স্ট্যানফোর্ড লিনিয়ার এক্সেলেটর কেন্দ্রে। ভারতে ফিরে প্রথমে যোগ দেন টাটা ইনস্টিটিউটে। বর্তমানে এলাহাবাদ হরিশচন্দ্র রিসার্চ ইনস্টিটিউটে গবেষণা করছেন।

ড. সেন তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী ও স্ট্রিং তত্ত্ববিদ হিসেবে সারা বিশ্বে পরিচিত। স্ট্রিং থিওরির বিস্তারিত ব্যাখ্যার পাশাপাশি কোয়ান্টাম গ্র্যাভিটি–সম্পর্কিত নানা জটিল সমস্যার সমাধান করেছেন তিনি। পেয়েছেন পদার্থবিজ্ঞানের অন্যতম সেরা ‘ফান্ডামেন্টাল ফিজিকস পুরস্কার’, যা ব্রেক থ্রু পুরস্কার নামে পরিচিত। ভারত সরকারের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা পদ্মভূষণে ভূষিত এই বাঙালি বিজ্ঞানী রয়্যাল সোসাইটির সদস্য। এ ছাড়া ২০১৪ সালে অত্যন্ত সম্মানিত ডিরাক মেডেলও পান এই তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী।