'ইউএনডিপিতেই গাড়ি চালাইছি ২১ বছর'

আকলিমা আক্তার। ৫৩ বছর বয়স। বলেন, ‘ইউএনডিপিতেই গাড়ি চালাইছি ২১ বছর। ২০১৪ সালে বসা থেকে দাঁড়াইতে গিয়া পইড়া যাই। হাতের দুইটা হাড্ডি ভাইঙা যায়। স্কয়ার হাসপাতালে চিকিৎসা করায় ইউএনডিপি। তারপরও গাড়ি চালাইছি। ২০১৭ সালের ২ নভেম্বর মেডিকেল আনফিট ঘোষণা করে। এখন আমি মোট বেতনের তিন ভাগের দুই ভাগ পাই। মেডিকেল ইনস্যুরেন্সের আওতায় চিকিৎসার ৮০ ভাগ টাকা ফেরত পাই। যত দিন জীবিত আছি, এ সুবিধা আমি পাব।’

আকলিমা জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি বা ইউএনডিপিতে গাড়িচালক হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন ১৯৯৭ সালের ৯ জানুয়ারি। আর গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র থেকে প্রশিক্ষণ নেওয়ার পর আকলিমা প্রথম গাড়ির স্টিয়ারিং হাতে নিয়েছিলেন ১৯৯১ সালে। জানালেন, দীর্ঘ চাকরিজীবনে সড়কে বড় কোনো দুর্ঘটনা ঘটেনি।

প্রথম আলোর কার্যালয়ে বসে আকলিমা ফিরে গেলেন তাঁর অতীত জীবনে। ১৩ বছর বয়সে বিয়ে হয়েছিল। ১৬ বছরের মাথায় কন্যাসন্তানের জন্ম দেন। আর ১৮ বছর বয়সে স্বামী হুট করে মারা গেলেন। স্বামী মারা যাওয়ার সাত দিন পর গৃহকর্মী হিসেবে কাজে নামেন আকলিমা। সাভারের গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে সিকিউরিটি গার্ড, চাষাবাদ এবং ক্যানটিনে কাজ করেন। তারপর গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র পরিচালিত গাড়ি চালানোর প্রশিক্ষণ নিতে বলেন। আকলিমার ভাষায়, এই ‘বড় ভাই’ এবং গাড়ি চালানো শিখেছিলেন বলেই তাঁর জীবনের মোড় ঘুরে গিয়েছিল। বেশ গর্ব করেই জানালেন, ইউএনডিপিতে সর্বশেষ তাঁর বেতন হয়েছিল ৭৭ হাজার টাকা।

আকলিমা বললেন, ‘বড় ভাইয়ের (জাফরুল্লাহ চৌধুরী) গাড়ি চালাইয়্যা ইউএনডিপিতে চাকরির ইন্টারভিউ দিতে যাই। তাই চাকরির জন্য তখন আর আলাদা ইন্টারভিউ নেন নাই স্যারেরা। পরে স্যারেরা ইংরেজি শেখান। এখন যা–ই একটু লিখি, খালি ইংরেজি চইল্যা আসে।’

আকলিমার বাবার বাড়ি ও শ্বশুরবাড়ি বরিশালে। আকলিমা জানালেন, স্বামী মারা যাওয়ার পর বাবার বাড়ি থেকে আবার বিয়ে দিতে চান। কিন্তু তিনি বিয়ে করতে রাজি হননি। তখন মেয়েকে নিজের মায়ের কাছে রেখে ঢাকার পথে রওনা দেন। ঢাকায় এসেও গৃহকর্মীর কাজ করেন কিছুদিন। তারপর গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের খবর জানতে পারেন।

আকলিমা আক্তার।  ছবি: প্রথম আলো
আকলিমা আক্তার। ছবি: প্রথম আলো

বর্তমানে আকলিমার মায়ের বয়স ৮৬ বছর। আকলিমা মাকে নিজের কাছে রেখেছেন। একমাত্র মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। আশকোনায় ৬ শতাংশ জায়গা কিনে টিনশেড বাড়ি করেছেন। এক ভাইয়ের প্রয়োজনের সময় দুই লাখ টাকা দিয়েছেন। অন্য ভাইবোনদের প্রতিষ্ঠিত করেছেন।

আকলিমা গাড়ি চালানোর প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন কক্সবাজার থেকে। বললেন, ‘তখন গাড়ি চালাই বইল্যা কত কথা যে শুনছি। দুই নম্বরি ব্যবসা করি বলেও বলছেন অনেকে। রাতে বাড়ি ফিরতে হইতো বইল্যা ভালো বাড়ি ভাড়া নিতে পারি নাই। একবার গাড়ি চালানোর সময় হর্ন দেওয়ার অপরাধে একজন নাকে ঘুষি মারছিল। স্বামী নাই, তাই কুপ্রস্তাবও পাইছি অনেক। তবে আমি কোনো দিকে কান দিই নাই। অনেক পুরুষ চালক আবার সাহায্যও করছেন।’

আকলিমার মতে, গাড়ি চালানো জানলে তা নারীদের বড় শক্তি হিসেবে কাজ করে। তবে আকলিমার আক্ষেপ নিজের মেয়ে তাঁর মতো হয়নি। পড়াশোনাও বেশি দূর করল না।