স্টিয়ারিং যখন নারীর হাতে

শারমীন আক্তার বানু জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থায় (ফাউ) চালক হিসেবে কর্মরত। ২০১২ সালে তিনি ব্র্যাকের ড্রাইভিং স্কুল থেকে প্রশিক্ষণ নেন। স্বামী মারা গেছেন, বাচ্চার বয়স মাত্র চার বছর—সবকিছু মিলিয়ে শারমীন প্রশিক্ষণ নিতে জীবনের প্রথমবার ঢাকায় পা রাখেন। প্রথম প্রথম কঠিন মনে হলেও প্রশিক্ষণ শেষ করার পর থেকে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রসহ বিভিন্ন জায়গায় গাড়ি চালিয়েছেন। এখন জাতিসংঘের সংস্থাটিতে কাজ করার জন্য গাড়ির বিদেশি যাত্রীদের সঙ্গে তাঁকে ইংরেজিতেও কথা বলতে হয়। জানালেন, বর্তমানে বেতন ৫০ হাজার টাকার বেশি পাচ্ছেন, অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা তো আছেই।

গত ৩১ জানুয়ারি রাজধানীর ধানমন্ডির গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে ‘ড্রাইভিং পেশায় নারীদের সফলতা: নিরাপদ সড়ক’ শীর্ষক এক সেমিনারে জানানো হয়, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র থেকে প্রশিক্ষণের পর দেশে ১৯৮৭ সালে প্রথম নারী গাড়িচালক হিসেবে স্বীকৃতি পান ছালেহা বেগম। তিনি বর্তমানে ইউনিসেফ বাংলাদেশে কর্মরত আছেন। তবে দেশে ছালেহা বা শারমীনের মতো পেশাদার নারী চালকদের সংখ্যা খুবই কম।

 বাংলাদেশ রোডস অ্যান্ড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) বলছে, দেশে অপেশাদার চালক হিসেবে লাইসেন্স নেওয়া নারীর সংখ্যা বাড়ছে। তবে সে তুলনায় পেশাদার হিসেবে লাইসেন্স নেওয়ার নারীর সংখ্যা বাড়েনি। সব মিলে পেশাদার নারী চালকের সংখ্যা এখন পর্যন্ত তিন হাজারের কম। ভারী গাড়ি চালনার লাইসেন্স পেয়েছেন ২৫ জনের কম নারী।

সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮–তে নারী চালক নিয়োগে উৎসাহ দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। দক্ষ নারী চালক তৈরিতে নিরাপদ সড়ক চাই, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র, ব্র্যাকসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করছে। নারী চালকদের প্রশিক্ষণের সঙ্গে যুক্ত বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা বলছেন, নারী চালকের সংখ্যা বাড়লে সড়ক দুর্ঘটনা অনেক কমে যাবে। একই সঙ্গে নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন হবে।

গাড়িচালক শারদীয় জানালেন, তিনি যখন গাড়ি চালানোর প্রশিক্ষণ নেন, তখন এসএসসি পাস ছিলেন। এরপর কাজের পাশাপাশি পড়াশোনাও চালিয়ে নেন। বর্তমানে তিনি ডিগ্রি পাস। হারমানের কাজ শুরু হয় সকাল সাড়ে আটটা থেকে। তবে তার আগে থেকেই প্রস্তুতির শুরু। তাঁর গাড়ি পার্ক করা থাকে বনানীতে। বাসা রাজধানীর বাড্ডার নতুন বাজারে। প্রথমে বনানী থেকে গাড়ি নিয়ে ফার্মগেটে আসতে হয়। তারপর যেখানে যেতে হয় যান। কাজ শেষে আবার বনানীতে গাড়ি রেখে বাড়ি ফেরেন। এর মধ্যে তাঁর বাচ্চাও বড় হয়েছে। সব মিলে ভালো আছেন বলে জানালেন।

জাতিসংঘের সংস্থায় কাজ পেতে শারমীনকে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা, ডোপ টেস্টসহ নানা পরীক্ষা দিতে হয়েছিল।

ভারী যান চালানোর লাইসেন্স আছে একটি পশ্চিমা রাষ্ট্রের দূতাবাসে কর্মরত নাজমুন নাহারের। তিনি এর আগে কেয়ার বাংলাদেশ, অক্সফাম বাংলাদেশ, জাতিসংঘ শিশু তহবিল-ইউনিসেফসহ বিভিন্ন সংস্থায় কাজ করেছেন। বললেন, তিনি কাজের প্রয়োজনে যখন ট্রাক নিয়ে পেট্রলপাম্পে যান তখন অন্য চালকেরা তাকিয়ে থাকেন। তবে তাঁর জানামতে, দেশে ভারী যান চালানোর লাইসেন্স আছে তিনিসহ মাত্র ১৭ জন নারীর। নাজমুন কেয়ার বাংলাদেশ থেকে গাড়ি চালানোর প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন।

নাজমুনসহ অন্যান্যরা জানালেন, নারীদের গাড়ি চালানোর বিষয়টিকে পরিবার, সমাজে এখনো ভালো চোখে দেখা হয় না। বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ পেলেও নারীরা ব্যক্তিগত গাড়ি চালাতে পারছেন না। নারী গাড়িচালকের জন্য ওই পরিবারে স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়া শুরু হয়। অন্যদিকে একজন পুরুষ গাড়িচালক কাজ না থাকলে গাড়িতে শুয়ে-বসে সময় কাটাতে পারলেও নারীদের বেলায় তা বরদাশত করা হয় না। অনেক সময় গাড়ির মালিকের বাসার বাসন মাজা, বাজার করে দেওয়াসহ বিভিন্ন ফুটফরমাশ করে দিতে হয়। গাড়িচালককে দিয়ে বিনা মূল্যে গৃহকর্মীর কাজও করিয়ে নিতে চান। তাই এই চালকেরা দৃষ্টিভঙ্গির বদল চান।

ব্র্যাকের ড্রাইভিং স্কুল থেকে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন ক্রাসং মারমা। তিনি এখন সড়কে গাড়ি চালানোর জন্য প্রস্তুত।  ছবি: সংগৃহীত
ব্র্যাকের ড্রাইভিং স্কুল থেকে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন ক্রাসং মারমা। তিনি এখন সড়কে গাড়ি চালানোর জন্য প্রস্তুত। ছবি: সংগৃহীত

রাজধানীর আশকোনায় বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের ড্রাইভিং স্কুলে দরিদ্র পরিবারসহ বিভিন্ন সমস্যায় থাকা নারীদের গাড়ি চালানোর প্রশিক্ষণ দিচ্ছে ২০১২ সাল থেকে। সম্প্রতি উত্তরার ব্র্যাক লার্নিং সেন্টারে ড্রাইভিং স্কুলটিতে গিয়ে দেখা যায়, নারীরা গাড়ির বিভিন্ন যন্ত্রাংশ দিয়ে হাতে-কলমে গাড়ি চালানো শিখছেন বিনা মূল্যে। আবাসিক প্রশিক্ষণ শেষে তাঁরা ইন্টার্নশিপ করার সুযোগ পাচ্ছেন। এ সময় তাঁরা ভাতা পাচ্ছেন। পরে ব্র্যাকের সহায়তায় ব্র্যাকের বিভিন্ন প্রকল্পে বা বিভিন্ন সংস্থায় চাকরি পেতেও সহায়তা করা হচ্ছে।

ড্রাইভিং স্কুলটিতে ক্রাসং মারমা, রুইম্রা মারমা, জান্নাতুল ফেরদৌসসহ কয়েকজনের সঙ্গে কথা হলো। তাঁরা জানালেন, বিভিন্ন পারিবারিক সমস্যার কারণে তাঁরা গাড়ি চালানোর প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। তাঁদের গলায় এখন দৃঢ় বিশ্বাস, তাঁরা রাস্তায় গা

ড়ি নিয়ে নামলে তা ভালোভাবেই সামলাতে পারবেন। ব্র্যাক ড্রাইভিং স্কুল থেকে এ পর্যন্ত পেশাদার চালকের প্রশিক্ষণ পেয়েছেন ২১৪ জন নারী। এর মধ্যে ২১১ জনই প্রশিক্ষণ পান ব্র্যাকের অর্থায়নে।

ব্র্যাকের প্রশাসন এবং সড়ক নিরাপত্তা কর্মসূচির পরিচালক আহমেদ নাজমুল হোসাইন বললেন, সরকারি নিয়োগে ১০ শতাংশ নারী কোটা পূরণ করার কথা। কিন্তু গাড়িচালকের বেলায় এ কোটা পূরণ করা সম্ভব হচ্ছে না। নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে পাঁচ বছরের অভিজ্ঞতা, ভারী যান চালানোর লাইসেন্সসহ যেসব শর্ত থাকে তা নারীরা পূরণ করতে পারেন না। ফলে নারীরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আবেদনই করতে পারছেন না। ফলে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে প্রশিক্ষণ নিয়েও আবার বাড়ি ফিরে যেতে বাধ্য হন।

আহমেদ নাজমুল হোসাইন বললেন, বিভিন্ন দূরপাল্লার বাস সার্ভিসে প্রশিক্ষণ পাওয়া নারীদের চালকের সহকারী হিসেবে কাজ দেওয়া যায়। তাঁরা পুরো কাজটি শিখে গেলে তখন চালক হিসেবেই কাজ করতে পারেন।

কমবে সড়ক দুর্ঘটনা

গত ২৫ জানুয়ারি ব্র্যাকের আয়োজনে নারী গাড়িচালকদের প্রশিক্ষণ পরবর্তী সনদ বিতরণ অনুষ্ঠানে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, নারী গাড়িচালকের সংখ্যা বাড়লে সড়ক দুর্ঘটনা কমবে। নারী গাড়িচালকেরা তুলনামূলক বেশি নিয়ম মেনে চলেন। ঠান্ডা মাথায় গাড়ি চালান। নারীরা নেশা করেন না। গাড়ি চালানোর সময় মুঠোফোনে কথাও বলেন না। মন্ত্রী সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নারী গাড়িচালকের চাকরির পথ সুগম করতে হবে বলেও উল্লেখ করেন।

নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা)–এর চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চনও বললেন, নারী চালকের সংখ্যা বাড়লে সড়কে দুর্ঘটনা কমবে। তবে নারীদের প্রশিক্ষণসহ বিভিন্ন বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত তেমন উদ্যোগ নিতে দেখা যাচ্ছে না। নারীদের এ পেশায় বেশি করে আনতে চাইলে ছাড় বা প্রণোদনা দিতে হবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।