এক অন্য খেলোয়াড়

পলাশ সকাল। ছবি: লেখক
পলাশ সকাল। ছবি: লেখক

‘গ্রামে কেউ যদি তোর ব্যাপারে জিজ্ঞেস করে, আমি কী বলব বল?’

বাবা শুক্কুর আলীর প্রশ্ন শুনে কিছুটা দিশাহারা বোধ করেছিলেন পলাশ সকাল। তত দিনে তিনি ভালো চাকরি ছেড়ে দিয়ে কাজ শুরু করেছেন ‘স্পোর্টস এজেন্ট’ হিসেবে। লোকে ক্রিকেট বোঝে, ক্রিকেটার বোঝে, কোচ বোঝে, কিন্তু স্পোর্টস এজেন্টের ধারণা একেবারেই নতুন। অতএব, বাবার দুশ্চিন্তা অমূলক ছিল না।

পলাশ হাল ছাড়েননি। ধৈর্যশীল ব্যাটসম্যানের মতোই বাউন্সার-ইয়র্কারে ঘাবড়ে না গিয়ে ক্রিজ আঁকড়ে থেকেছেন। পেয়েছেন ধৈর্যের পুরস্কার। কাজ করেছেন, করছেন বাংলাদেশের বেশ কয়েকজন ক্রিকেটারের সঙ্গে। একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর পাশাপাশি তরুণদের অনুপ্রাণিত করতে ঘুরে বেড়ান দেশের নানা প্রান্ত। সম্প্রতি তিনি গ্লোবাল ইয়ুথ পার্লামেন্ট নামে একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার পক্ষ থেকে ‘গ্লোবাল ক্রিয়েটিভ লিডার’ বিভাগে পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছেন। সবকিছু ঠিক থাকলে, আগামী এপ্রিলে ইতালিতে অনুষ্ঠেয় গ্লোবাল ইয়ুথ লিডারশিপ সামিটে তিনি সম্মাননাটি পাবেন।

স্পোর্টস এজেন্ট কী

ভিনদেশে স্পোর্টস এজেন্ট বেশ জনপ্রিয় একটি পেশা, তবে আমাদের দেশে ধারণাটি নতুন। মাঠের বাইরে ক্রিকেটারদের বিভিন্ন ব্যবসায়িক চুক্তি ব্যবস্থাপনা, ক্রিকেটারদের সঙ্গে করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর যোগাযোগ স্থাপন করা ও যোগাযোগমাধ্যম হিসেবে কাজ করেন একজন স্পোর্টস এজেন্ট। এ ছাড়া ক্রিকেটারদের ব্যক্তিগত জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রেও কাজ করেন পলাশ। মাঠের বাইরে ক্রিকেটারদের দৈনন্দিন রুটিনের যাবতীয় দেখভাল করা এবং ক্রিকেটারদের খারাপ সময়ে তাঁদের প্রয়োজনীয় সেবা প্রদানের ব্যবস্থা করাও তাঁর কাজের মধ্যে পড়ে বলে জানান। ক্রিকেটাররা তো কেবল খেলোয়াড় নন, তাঁরা প্রত্যেকেই একেকটা ব্র্যান্ড। তাই সহজ করে বললে, পলাশের কাজ একজন ‘ব্র্যান্ড ব্যবস্থাপকের’ মতো।

ঝুঁকির রোমাঞ্চ

পলাশ সকালের পড়ালেখার বিষয় ছিল টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং। ২০১২ সালে গাজীপুরের ঢাকা ইউনিভার্সিটি অব ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি (ডুয়েট) থেকে বিএসসি সম্পন্ন করেন তিনি। ক্যাম্পাসে তুখোড় বিতার্কিক ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় টেক্সটাইল ট্যালেন্ট হান্ট ২০১২-তে অংশ নিয়ে সারা দেশের মধ্যে প্রথম রানারআপ হন। অতএব, চাকরি পাওয়াটা তাঁর জন্য কঠিন হয়নি। পাস করার পরপরই যোগ দেন একটি বায়িং হাউজে।

কিন্তু এরপর হঠাৎ চাকরি ছেড়ে নতুন এই পেশার প্রতি ঝুঁকলেন কেন? পলাশ বলেন, ‘ওই চাকরিতে আসলে মন বসছিল না। নতুন কিছু করতে চেয়েছিলাম। তা ছাড়া ভালো কিছু করতে হলে তো ঝুঁকি নিতেই হয়। সেটা হোক ক্রিকেটে বা জীবনে।’

চাকরি করতে করতেই পলাশ লক্ষ করছিলেন, এ দেশের মানুষের ক্রিকেট নিয়ে ভীষণ আগ্রহ। খেলা শুরু হলে অফিসের লোকজনও বুঁদ হয়ে থাকেন ব্যাট-বলের জাদুতে। তাই তিনি ভাবছিলেন, ক্রিকেট নিয়েই যদি কিছু করা যায়, কেমন হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ই একটি এফএম রেডিওতে অনুষ্ঠান করতেন। সেই রেডিও অনুষ্ঠানে অতিথি হয়ে আসেন জাতীয় দলের ক্রিকেটার এনামুল হক বিজয়।

অনুষ্ঠান শেষে বিজয়ের সঙ্গেই প্রথম আলোচনা করেন পলাশ, ক্রিকেট নিয়ে নতুন কিছু করা যায় কি না। বিজয় উৎসাহ দেন। এরই মধ্যে পলাশ জানতে পারেন, ভারত থেকে শুরু করে ক্রিকেট খেলা হয়, এমন প্রায় প্রতিটি দেশেই স্পোর্টস এজেন্টরা কাজ করেন। যেহেতু খেলাধুলা ভালোবাসেন, স্পোর্টস এজেন্টের পেশাটি বেশ আগ্রহ জাগায় পলাশের মনে।

চাকরি ছেড়ে নতুন পথে

 ২০১৪ সালের শেষ দিকে কাজে নেমে পড়েন পলাশ সকাল। চাকরি তখনো ছাড়েননি। বিকেলে অফিস শেষে ছুটে যেতেন ক্রিকেটারদের কাছে। কিছুদিন পর বুঝলেন, এভাবে ঠিক কাজ হবে না। চাকরি অথবা স্পোর্টস এজেন্ট হওয়ার স্বপ্ন—যেকোনো একটি বেছে নিতে হবে। অবশেষে ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর চাকরি ছেড়ে দেন তিনি।

এরপর কয়েক বছর এক ক্রিকেটার থেকে আরেক ক্রিকেটারের পেছনে ঘুরেছেন। কেউই সেভাবে সাড়া দিচ্ছিলেন না। শুধু ব্যক্তি পলাশ পরিচয়ে পেশাদারির অভাব বোধ করছিলেন তিনি। তাই ২০১৫ সালের এপ্রিল মাসে পাওয়ার প্লে কমিউনিকেশনস নামে একটি প্রতিষ্ঠান খুললেন। ধীরে ধীরে ক্রিকেটারদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পেল। প্রথম সারির কয়েকজন ক্রিকেটারের সঙ্গে কাজও শুরু করলেন।

স্বপ্ন আরও বড়

টেক্সটাইলের জগৎ ছেড়ে যেহেতু মার্কেটিং, ব্র্যান্ডিং আর কমিউনিকেশনসের দুনিয়ায় এসে পড়েছেন, তাই কাজের পাশাপাশি এমবিএ করে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন পলাশ সকাল। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউট (আইবিএ) থেকে এমবিএ (মার্কেটিং) করেন তিনি।

পলাশ বলেন, ‘আমি দেশের প্রায় সব ক্রিকেট তারকার সঙ্গেই কাজ করেছি। বাংলাদেশ যখন খেলে, তখন সবারই তো টেনশন হয়। আমার টেনশন হয় আরও বেশি। কারণ, মাঠে খেলোয়াড়দের পারফরম্যান্সের ওপর আমার পারফরম্যান্স নির্ভর করে।’ এখন পরিবারের সদস্যরাও তাঁকে উৎসাহ দেন। হেসে পলাশ বলেন, ‘এখনো অবশ্য অনেকেই বুঝতে পারে না আমি আসলে কী কাজ করি।’ তবে পলাশ স্বপ্ন দেখেন কাজের পরিসরটা আরও বড় করার। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে মেসি-রোনালদোর মতো বড় বড় তারকা নিয়ে ভবিষ্যতে কাজ করতে চান তিনি। পাশাপাশি স্নাতক পর্যায়ে অর্জিত বিদ্যাটাও পুরোপুরি ঠেলে দেননি। সাহস সঞ্চয় করে, দেড় বছর হলো নিজেই একটা বায়িং হাউজ শুরু করেছেন তিনি।

নিজে ঠেকে যা কিছু শিখেছেন, সেটাই তরুণদের জানাতে চান পলাশ সকাল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএতে অতিথি শিক্ষক হিসেবে ‘সেলিব্রিটি এনডোর্সমেন্ট’ বিষয়ে পড়ান। দেশের নানা প্রান্ত ঘুরে তরুণদের সঙ্গে যখন কথা বলেন, মাইক্রোফোন হাতে পলাশ প্রায়ই বলেন, ‘তোমার আগ্রহের জায়গাটা খুঁজে বের করো। আরেকজন ইউটিউবে ভিডিও বানিয়ে সফল হয়েছে বলে তোমাকেও তা-ই করতে হবে, এমন তো নয়। নিজের পথ নিজে তৈরি করো।’