'নারীবাদী' কমলা ভাসিন

কমলা ভাসিন।  ছবি: জান্নাতুল মাওয়া
কমলা ভাসিন। ছবি: জান্নাতুল মাওয়া

ভারতের প্রখ্যাত নারীবাদী লেখক, প্রশিক্ষক এবং অধিকারকর্মী কমলা ভাসিন সম্প্রতি ব্র্যাকের আমন্ত্রণে বাংলাদেশে এসেছিলেন। সত্তরের দশক থেকেই স্যার ফজলে হাসান আবেদ আর ব্র্যাকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ তাঁর। প্রায় অর্ধশতক ধরে তাঁর কথা আর লেখায় সারা বিশ্বে নারী-পুরুষের ওপর সমাজের চাপিয়ে দেওয়া বিভেদ নিয়ে সচেতনতামূলক বা জেন্ডার সেনসেটাইজিং আলোচনা উসকে দেওয়ার কাজ করে আসছেন তিনি। নারীবাদী অভিধাটি শুনলে পুরুষ তো একটু দূরে সরেনই, এমনকি নারীদের অনেকেও একটু কুঁকড়ে যান। কমলা ভাসিন দেখলাম তাই প্রায়ই ঘরোয়া আড্ডা থেকে কর্মশালা অথবা বক্তৃতা সভায় প্রথমেই ভুল ভাঙিয়ে মনে করিয়ে দেন, নারীবাদের লড়াইটা পুরুষতন্ত্রের পতন ঘটিয়ে নারীতন্ত্রের সূচনার দাবি নয়; বরং দাবিটা সমতার। নারী-পুরুষনির্বিশেষে সবাইকে সমাজ সমানভাবে দেখবে আর সমান সুযোগ দেবে—এমন সমতার পৃথিবীই চায় নারীবাদ। এই ব্যাখ্যার পর যখন কমলা জিজ্ঞেস করেন, তাহলে এখানে কে নারীবাদী? তখন ছোট-বড় সমাবেশে সব মানুষের হাত উঠে আসে সংহতিতে।

কমলা ভাসিন বোঝান, সেক্স আর জেন্ডারে পার্থক্য আছে। সেক্স বা প্রাকৃতিক লিঙ্গ নির্ধারিত থাকে। আমরা জন্মের সময়েই সে তফাত নিয়ে জন্মাই। কমলার ব্যাখ্যায়, সেটা ভেদ বা বৈচিত্র্য, বিভেদ নয়। কিন্তু জেন্ডার বা সমাজনির্ধারিত লৈঙ্গিক ধারণা, বিভেদ সৃষ্টি করে। নারী সন্তান ধারণ করবে, সন্তানকে দুধ খাওয়াবে আর পুরুষ তা পারবে না, এ ছাড়া নারী-পুরুষের সৃষ্টিতে আর কোনো তফাত করা হয়নি। তাই বাচ্চার ভেজা কাঁথা ধোয়া হোক আর উড়োজাহাজ চালনাই হোক, নারী-পুরুষ উভয়েই সব পারেন। আরও পরিষ্কার করে বোঝাতে, কমলা ভাসিন বলেন, সন্তান জন্মদানের ক্ষমতা নিয়ে জন্মানো তাঁর শরীরটা নারীর, এ তাঁর প্রাকৃতিক লিঙ্গ বা সেক্স। আর তাঁর জামার ওপর ছড়িয়ে রাখা ওড়নাটা হলো জেন্ডার। মিলনায়তনভর্তি নারী-পুরুষকে তিনি বলেন, নারীর কানের দুল, লিপস্টিক, তাঁকে সব সময় সুন্দর থাকতে হবে, নরম, কোমল হতে হবে, নিজের মতপ্রকাশ করা যাবে না, এসব চাপিয়ে দেয় তাঁর সামাজিক লিঙ্গ বা জেন্ডার। আর পুরুষকে জেন্ডার শেখায়, লাল–গোলাপিসহ জগতের সব উজ্জ্বল রং নারীর জন্য, মন খারাপ হলেও কাঁদতে পারবে না সে, পরিবারের সঙ্গে হাসি খেলায় মাততে পারবে না, তাঁকে লৌহকঠিন হয়ে শুধু পরিবারের জন্য রোজগার করে যেতে হবে। কমলা ভাসিন মনে করিয়ে দেন, তাই এই সমাজ নির্ধারিত লৈঙ্গিক আচরণের ফাঁদে বা জেন্ডারের খাঁচায় পুরুষ, নারীর চেয়ে কিছু কম আটকা পড়েনি।

উচ্চশিক্ষিত ও উচ্চ মধ্যবিত্ত ৩০-৫০–এর নারী-পুরুষের এক ছোট সমাবেশে কমলা ভাসিন এমন আলাপের গভীরে গেলে দেখি, পুরুষের চোখে জল, ছোটবেলায় পিঠেপিঠি বোনকে না দিয়ে তার পাতেই সব সময় ইলিশের পেটি আসার বেদনায়। আরেক পুরুষের অপরাধবোধ, বোনের কাছে অঙ্ক শিখে ভাই বুয়েটের ইঞ্জিনিয়ার হয়েছেন, আর বোনটিকে মেয়েদের জন্য নয় বলে সায়েন্স নিতেই দেওয়া হয়নি। আমি দেখি অনেক পুরুষই বলতে শুরু করেন, বাবার ভীষণ রাগের কথা আর সেই রাগের সামনে ভীত অসহায় মাকে দেখার গভীর বেদনার কথা। একজন পুরুষ যখন মন খুলে বলেই ফেলেন, ওই হঠাৎ রাগের সময় বাবা আসলে মায়ের গায়ে হাত তুলতেন, তখন অনেকেই বাবার রাগ বলতে যে রেখেঢেকে তাঁরাও মায়ের মার খাওয়ার স্মৃতিই লুকাচ্ছিলেন, সেটাও বলে ফেলেন। আমি সেই বেদনার ঐক্যে সমতার পৃথিবীর এক অমিত সম্ভাবনা তৈরি হতে দেখি।

এক ভাই বলেন, খাবার ভাগাভাগির সমাজ নির্ধারিত নিয়ম থেকে মুক্তি পেতে শেষ পর্যন্ত বলেছেন, মাছের পেটি, মুরগির রান খেতে ভালো লাগে না তাঁর। তরুণতরদের অনেকেই সন্তান পালন আর সংসারের কাজে স্ত্রীর সঙ্গে সমান তালে হাত লাগানোর প্রয়োজনীয়তা আর আনন্দের কথা বলছিলেন।

আমি মনে মনে ভাবি, সরকারি পরিসংখ্যান বলে, আজকের বাংলাদেশেও ৮০ শতাংশের ওপর সংসারে নারী নির্যাতনের শিকার। তাহলে এই আলাপ থেকে কী সে ঘরে উপস্থিত জনা তিরিশেক নারী-পুরুষ তাঁদের সংসারে তা স্বীকার করা আর ঠেকানোর শক্তি এবং সাহস নিয়ে গেলেন? বোনের জন্য মাছের পেটি ছাড়তে চান যে ভাই, একই ভালোবাসায় একদিন কী সম্পদের ন্যায্য ভাগ তুলে দিতে পারবেন তিনি?

কমলা সমবেত পুরুষদের একটু ঝাঁকুনি দিয়ে বলেন, আরও অনেক নারীবাদী ছেলে আর পুরুষ দরকার। কারণ, পুরুষ ধর্ষণ করা, বাসে ট্রেনে গায়ে হাত দেওয়া আর সংসারে গায়ে হাত তোলা বন্ধ করলেই সমতার পৃথিবী গড়ার পথে অনেক দূর যাওয়া যাবে। এমন মন্তব্যে অপমানিত অনেক পুরুষ যখন বলে ওঠেন, পৃথিবীর সব পুরুষ তো ধর্ষক নন। তখন কমলা মনে করান, আবার এ–ও ঠিক যে ধর্ষকমাত্রই পুরুষ। পুরুষকে সামাজিক লিঙ্গ বা জেন্ডার নির্ধারিত এই কলঙ্কের শিকল ছিঁড়েইবা মুক্ত করবে কে?

নবনীতা চৌধুরী, পরিচালক, ব্র্যাক