দিনটি আসে চার বছর পরপর

মামুনুর রশীদ।
মামুনুর রশীদ।

সময়ের কোনো বিভাজন হয় না। মানুষই যেদিন আবিষ্কার করেছে সূর্য স্থির আর পৃথিবীটা তার চারদিকে ঘোরে, তখন থেকেই সময়ের বিভাজন আর সম্ভব নয়। এখানে দিন, আমেরিকায় রাত। তাই সূর্যটা চিরদিবসের। কিন্তু বিজ্ঞানীরা সব অঙ্ক মেলাতে পারেননি। তাই অঙ্ক মেলানোর জন্য চার বছর পরপর এক দিন বেড়ে যায় ফেব্রুয়ারি মাসে।

এটা কি একটা সৌভাগ্য না দুর্ভাগ্য, যাদের জন্ম হয় লিপ ইয়ারে? সবার মতো প্রতিবছর জন্মদিন আসে না। জন্মদিনের আনন্দটাই ম্লান। কিন্তু এই যে চার বছর পর জন্মদিনটা আসে, সে তো বিপুল বিশাল আনন্দ নিয়ে আসে। আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব— সবাই কেমন উন্মুখ হয়ে থাকে। কবে আসবে সেই ২৯ ফেব্রুয়ারি। কানায় কানায় পূর্ণ হয় জন্মদিনের উৎসব।

পৃথিবীতে বহু বছর আগে থেকেই লিপ ইয়ার ক্লাব গড়ে উঠেছে। দেখতে পেলাম সেখানে আমার নামটিও আছে। যাদের, লিপ ইয়ারে জন্ম, একটু খোঁজ করলেই দেখা যাবে ওই ক্লাবে কেমন করে যেন নামটা উঠে যায়। লিপ ইয়ারে জন্ম হওয়া মানুষগুলো কি বাড়তি কোনো সুবিধা পেয়ে থাকে? একটা সুবিধা তো পেয়েই থাকে। জন্মতারিখের কথা শুনেই যেকোনো মানুষের চোখটা বড়, অবাক হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে, তারপর হাসির রোল উঠে যায়। সবার মতো যাদের বছরে এক দিন জন্মদিন, তাদের বেলায় কি চক্ষু চড়কগাছ হয় কখনো? হয় না।

অনেক শিশুর আক্ষেপ হয় বয়স্কদের মতো তারও কেন জন্মদিন উদ্‌যাপন হয় না। আসলে পারিবারিকভাবে জন্মদিন উদ্‌যাপন বর্তমানে একটা রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। এই যে এত মহামানবের জন্মদিন আমরা উদ্‌যাপন করি, তা ওই মানুষটির কীর্তির জন্য। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, বিদ্যাসাগর, শেক্‌সপিয়ার—তাঁরা হয়তো জীবদ্দশায় তাঁদের জন্মদিন উদ্‌যাপন দেখেও যেতে পারেননি। কারও কারও জন্মদিন কবে, তা–ও জানা যায়নি। সেই সব মহামানবের জন্মদিন লিপ ইয়ারে কি না, তা–ও আমরা জানি না। এখন আবার অনেকের শতবর্ষ, সার্ধশতবর্ষ, দ্বিশতবর্ষ উদ্‌যাপিত হয়ে থাকে। মানুষগুলো কি গুরুত্বপূর্ণ হয়েছেন পৃথিবীতে? তাই জন্মদিন উদ্‌যাপনের আগে ভাবনাটা এমন আসা উচিত যে পৃথিবীতে কতটা অবদান রাখা সম্ভব হলো, জীবনটাই–বা কতটা গুরুত্বপূর্ণ হয়েছে। এই গুরুত্বটাই সবচেয়ে বড় প্রশ্ন।

এ প্রশ্নের উত্তর যখন নিজের মধ্যে ভাবি আমরা, তখনই জীবনটা কর্মময় হয়ে পড়ে। এক বছরে নয়, চার বছরে পৃথিবী যতবার সূর্যকে প্রদক্ষিণ করেছে, ততবার কী কাজটা আমরা করতে পারলাম। আমাদের বাঁচার সার্থকতা তো সেখানেই। আর মহাকালের কাছে এক বছর, চার বছর, দশ বছর তো কোনো ব্যাপারই নয়। সে অণুক্ষণ মাত্র।

তাই পৃথিবীতে আমাদের প্রবেশ এবং প্রস্থানের কালই–বা কতটুকু? সেই কালটার প্রতিটি অণুক্ষণকে যদি আমরা আমাদের প্রতি দায়িত্ব পালন করে দখল করতে পারি, তাহলে জন্মটাই সার্থক হয়। আর লিপ ইয়ারে যার জন্ম, তার টুপিতে একটা করে, দুটো করে, পাঁচটা করে, দশটা করে পালক যুক্ত হতে থাকে।

লিপ ইয়ারে জন্মে আমার অভিজ্ঞতা তো ভীষণ আনন্দের। বন্ধু, আত্মীয়স্বজন সবাই শুধু অপেক্ষা করে না, খুঁজে খুঁজে আমার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সুকৃতিকে বের করে। বছর বছর জন্মদিনের আর্থিক ঝামেলা থেকে মুক্ত হয়। কিন্তু বছরের পর বছর কর্মহীন থেকে, সমাজের প্রতি কোনো দায়িত্ববোধ পালন করা থেকে বিরত থাকলে যেকোনো মানুষই সমাজে অপাঙ্‌ক্তেয়, অর্থহীন হয়ে পড়বে।

তাই জীবনটাকে অর্থপূর্ণ করার জন্য আমাদের সব উদ্যোগকে সচল রাখা প্রয়োজন। শুধু লিপ ইয়ারে যাদের জন্ম, তাদের জন্য এসব কথা নয়। সবার জন্যই একই কথা। তবে জন্মেই যারা চার বছরে একবার জন্মদিনের জন্য সৌভাগ্যবান হয়েছে, তাদের জন্য বেশি প্রযোজ্য।