যুদ্ধ করেই জায়গা পেতে হয়

শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে কেন্দ্রী শহীদ মিনার এলাকায়  নারী ও নারীর ভাষাকে ফুটিয়ে তোলার প্রয়াসে এই দেয়ালচিত্র আঁকা হয়েছে ।  ছবি: আবদুস সালাম
শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে কেন্দ্রী শহীদ মিনার এলাকায় নারী ও নারীর ভাষাকে ফুটিয়ে তোলার প্রয়াসে এই দেয়ালচিত্র আঁকা হয়েছে । ছবি: আবদুস সালাম

‘যে নারী লেখালেখি করতে চায়, তার দরকার কিছু টাকা, আর নিজের  একটি ঘর’,  প্রায় ৯০ বছর আগে এ কথা লিখেছিলেন ভার্জিনিয়া উলফ। এই নিজের ঘরটা আসলে কী? একটা চার দেয়ালে ঘেরা কক্ষ, যেখানে বসে একজন নারী লিখে চলেছেন নিজের মনে? নাকি তাঁর একান্ত কিছু সময়, নিজের কিছু ভাবনা, নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি, যে দৃষ্টিভঙ্গি পুরুষের বা সমাজের তৈরি করে দেওয়া নয়। ভার্জিনিয়া বহুবার আক্ষেপও করেছেন এই বলে যে কত জেন অস্টিন হারিয়ে গেছেন শুধু নারী বলে, নারীর লেখালেখি কোথাও কোনোখানে মর্যাদা পেল না বলে, অথবা নারী নিজেই তার লেখকসত্তাকে মূল্য দিল না বলে!  

প্রায় শত বছর পরে, এই সময়ে, নারী লেখকেরা কি এখনো তাঁর মতো করেই ভাবেন? এখনো কি তাঁরা পুরুষ প্রাধান্যের এই লেখালেখির জগতে অপাঙ্‌ক্তেয় আর অনুচ্চই রয়ে গেলেন? সংসার, সন্তান, ক্যারিয়ার, সামাজিক দায়দায়িত্ব সব সামলে শেষ পর্যন্ত লেখালেখির মতো ‘অপ্রয়োজনীয়’ কাজটিতে সব ভালোবাসা আর অন্তর ঢেলে দেওয়ার পর নারীরা কি এখনো অনেকটাই অনুচ্চারিত, অনুল্লেখ্য, অসমালোচিতই রয়ে যাচ্ছেন পুরুষশাসিত এই সাহিত্যের বাজারে? 

সদ্য সমাপ্ত একুশে বইমেলায় নারী লেখকদের কবিতা, ফিকশন, গবেষণাধর্মী বই প্রকাশিত হয়েছে। তবে মেলা আয়োজক কমিটির কাছে মোট কতজন নারীর কতটি বই প্রকাশিত হয়েছে, তার আলাদা পরিসংখ্যান নেই। তবে  সংখ্যায় পুরুষদের তুলনায় নারীর সংখ্যা কম, তা বলেছেন অনেকেই।

 প্রথমা প্রকাশনের নতুন ১০০টি বইয়ের তালিকায় নারীর লেখা বই ৫টি। ছোটগল্প সংকলন ২টি—ভালোবাসার পরিধি (শাহীন আখতার), দ্বিতীয় ভ্রান্তিপাশ (সাগুফতা শারমীন তানিয়া)। উপন্যাস একটি—কোলাহল থামার পরে (আফসানা বেগম)। শিশু-কিশোর সাহিত্য শাখায় নিশাত সুলতানার ডিজিটাল দৈত্যরিমির আশ্চর্য পেনসিল বক্স। আর কবিতার বই ত্রিকালদর্শী বেলপাতা (তাসনুভা অরিন)।

 প্রথমার নির্বাহী জাফর আহমেদ রাশেদ জানান, তাসনুভা অরিনের বইটি ২০১৮ সালে জীবনানন্দ দাশ পাণ্ডুলিপি পুরস্কার পায়, যা এবার গ্রন্থাকারে বেরিয়েছে। আর পরপর তিনবার এই পুরস্কার পেয়েছেন নারী কবিরা। কিন্তু বইমেলায় কি মেলার বাইরে এই প্রতিভাবান নারী কবিদের অস্তিত্ব কোথায়?

 বাতিঘর থেকে প্রকাশিত বইয়ের দীর্ঘ তালিকাতেও নারীর উপস্থিতি প্রায় না থাকার মতোই। গল্পগ্রন্থ মৃত অ্যালবেট্রস চোখ (ফাতেমা আবেদীন),  তেত্তিরিশ (রঞ্জনা ব্যানার্জি), বিস্ময়চিহ্নের মতো ( রিমঝিম আহমেদ); শিশুসাহিত্যে পেটুক ভূত কাঁটাগাছি (শাওন আজিম), ভ্রমণসাহিত্যে নীলনদের উৎসমুখে ( অঞ্জনা দত্ত), আত্মজীবনী যে অতীত ভোলা যায় না (আরতি দত্ত) আর অনুবাদ সাহিত্যে প্রিসিলা রাজ অনূদিত মিথ এন্ড মিনিং

 অন্যান্য প্রকাশনীর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ বই হচ্ছে চৈতন্য প্রকাশিত সাদিয়া মাহজাবীন ইমামের বৈদিক পাখির গান, অদিতি ফাল্গুনীর প্রথম উপন্যাস ক্রমাগত হত্যার সেরেনাদে, যা বেরিয়েছে সংবেদ থেকে। পেন্ডুলাম থেকে বেরিয়েছে ম্যাগডেলিনা মৃ-এর অনুবাদে গারো গল্প সংকলন

এবারের মেলায় কথাসাহিত্যিক রুমা মোদকের দুটি বই বেরিয়েছিল—সেলিব্রেটি অন্ধকারের রোশনাই (সময়) আর নদীর নাম ভেড়ামোহনা (পেন্সিল)। রুমা মোদক বলছিলেন, সেই কুসুমকুমারী দেবী থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত নারী লেখকদের তো যুদ্ধ করেই নিজেদের জায়গাটা করে নিতে হয়েছে। বরং এই সময়ে এই পরিস্থিতিটা আরও সংকুল। সাহিত্যচর্চা ও প্রকাশনার জগৎটা বিভক্ত হয়ে গেছে, লেখকেরা যে যাঁর বৃত্তের মধ্যে আবদ্ধ হয়ে পড়েছেন, সেখানে নারীদের প্রবেশাধিকার ততটাই সংকুচিত হয়ে পড়ছে।

নারী লেখক এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানালেন, একজন নারী কবি বা লেখকের লেখা কোনো প্রকাশক বা সম্পাদক  দুবারের বেশি ছাপলেই শুরু হয়ে যায় ফিসফাস। একজন পুরুষ লেখক সাহিত্য সম্পাদক বা প্রকাশকের অফিসে বসে বা কবি-সাহিত্যিকদের সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আড্ডা দিচ্ছেন, চা সিগারেট খাচ্ছেন, লেখালেখি নিয়ে কথা বলছেন, তাঁর নিজস্ব একটা পরিচিতির গণ্ডি তৈরি হচ্ছে, সেখানে একজন নারী লেখকের লেখালেখিটা হয় নিভৃতে, পাদপ্রদীপ থেকে দূরে, প্রচার-প্রচারণার বাইরে। আবার কখনো নারী বলেই অতি মনোযোগ, অতি প্রশংসা, অতি বাহবা পান কেউ কেউ। এটাও সঠিক কোনো পথ নয়। 

যুক্ত প্রকাশনীর কর্ণধার নিশাত জাহান হাতে গোনা নারী প্রকাশকদের একজন। যুক্ত থেকে মিলা মাহফুজার সম্পাদনায় নির্বাচিত ছোটগল্প পটভূমি যুদ্ধকাল, সর্বশ্রী বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাংলা চলচ্চিত্রে স্বতন্ত্র নারী এবং আইনুন নাহার বেগমের আধুনিক শিখন শেখানো ও জেন্ডার প্রসঙ্গ  বের হয়েছে। নিশাত জাহানের নিজের একটি ভ্রমণবিষয়ক বইও এসেছে আলোর নগর ছায়ার নগর নামে।

 নিশাত জাহান বললেন, সাহিত্য ও প্রকাশনার জগতে যখন সুস্থ বাজার নেই, ভালো পাঠক নেই, ভালো সমালোচনা নেই, তখন ভালো লেখকমাত্রই বিপদে, তিনি পুরুষই হোন আর নারী। নারীদের বাড়তি সমস্যা,  পুরুষশাসিত সাহিত্য জগতে আগে থেকেই তাঁকে খানিকটা তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে দেখা হয়। আর নারীরাও সগর্বে নিজেদের উপস্থিতি জানান দিতে কুণ্ঠিত হয়ে থাকেন। আত্মবিশ্বাসের অভাবে ভোগেন।

  ঐতিহ্য প্রকাশনীর কর্ণধার আরিফুর রহমান বললেন, রিজিয়া রহমানের মতো উঁচু মানের লেখকের বই কটি বাড়িতে আছে, কয় লাখ পাঠক ওনার? তিনি যদি আরেকটু আলোচিত হতেন, আরেকটু পাদপ্রদীপের আলোয় আসতেন, পাঠকেরাই লাভবান হতেন। হুমায়ূন আহমেদকে যেমন পরিচয় করিয়েছিলেন আহমদ ছফা, রিজিয়া রহমানদের কে পরিচয় করাবে? সমস্যা হলো, নারী লেখকদের সমালোচনার ঊর্ধ্বে এ রকম বন্ধুবলয় গড়ে ওঠা মুশকিল। আশ্চর্যের ব্যাপার, এখনো নারী কবি বা সাহিত্যিকদের পুরুষ কবি/সাহিত্যিক/সম্পাদক/প্রকাশকের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ভালো চোখে দেখা হয় না।

 ঐতিহ্য প্রকাশিত বইয়ের তালিকায় নারীদের বই গোটা কয়েক। মনোবিজ্ঞানবিষয়ক কৈশোরের মনস্তত্ত্ব (ফজিলাতুন্নেসা শাপলা), গবেষণা গ্রন্থ বাংলা কথাসাহিত্যে শহর পরিবেশ ও প্রকৃতি (রাফেয়া আবেদীন), উপন্যাস আমারে দেব না ভুলিতে (শারমিন আঞ্জুম) এবং গল্পগ্রন্থ ত্রি (আখতার বানু জলি, সুরভী হাসনীন, মনোয়ার হোসেন)।

লেখক আফসানা বেগমের দুটি বই এসেছিল মেলায়। প্রথমা থেকে কোলাহল থামার পরে (উপন্যাস) আর অবসর থেকে সিয়ান অথবা নাবিল (সায়েন্স ফিকশন)। তিনি বললেন, নারীরা ক্ষেত্রবিশেষে কখনো একটু বেশি কখনো একটু কম মনোযোগ পান, যার কোনোটাই সুস্থ লক্ষণ নয়। নারী লেখককে প্রশংসা করার সময় বলা হচ্ছে, ‘তাঁর লেখার ভঙ্গি মোটেই নারীদের মতো নয়’ অথবা ‘তিনি বর্তমানে নারী লেখকদের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ বা অন্যতম’। কী অদ্ভুত ব্যাপার, তাই না? আফসানা বেগম বললেন, ‘আমি যখন উইলিয়াম ফকনার অনুবাদ করি তখন অনেকেই আশ্চর্য হয়ে বলেছেন, ‘নারী হয়ে এমন কঠিন অনুবাদগ্রন্থ লিখলে কী করে?’ আর এবার শুনতে হয়েছে, ‘বিজ্ঞান কল্পগল্প মেয়েরা লেখে নাকি?’

নারী লেখকেরা লিঙ্গবৈষম্যের শিকার, এই অভিযোগ উঠেছে পশ্চিমা বিশ্বেও। ২০১৮ সালে ব্রিটিশ কথাসাহিত্যিক ক্যামিলা শামসি বলেন, সাহিত্য পুরস্কার, বইয়ের  সমালোচনা, প্রকাশনা জগৎ—সব খানেই নারী-পুরুষে বৈষম্য আছে। তাঁর সঙ্গে তখন সুর মিলিয়েছিলেন অ্যান্ড আদার স্টোরিজের প্রকাশক স্টেফান টবলার।  তিনি দেখিয়ে দেন যে খোদ ইংল্যান্ডে লন্ডন রিভিউ অব বুকস পত্রিকায় বছরজুড়ে যে রিভিউ ছাপা হয় তার মাত্র ২৬ শতাংশ নারীদের লেখা নিয়ে। ব্রিটেনে বিশ্ব সাহিত্যের অনূদিত বইয়ের মধ্যে মাত্র ৩০ শতাংশ নারী লেখকদের। ১০ বছর ধরে বুকার পুরস্কার পাওয়া লেখকদের মধ্যে ৫৭ শতাংশ হলেন পুরুষ। অথচ ব্রিটেনে সর্বাধিক জনপ্রিয় সেরা ১০ লেখকের তালিকার ৯ জনই নারী।