অভিযান ঘিরে রাকার জীবন

নিজের পিক ৬৯–এ হানিয়াম মারিয়া। ছবি: খালেদ সরকার
নিজের পিক ৬৯–এ হানিয়াম মারিয়া। ছবি: খালেদ সরকার

প্রথম কথা হয়েছিল মুঠোফোনে। অভিযাত্রী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখক রাকিব কিশোর জানিয়েছিলেন, একজন মেয়ে কায়াক (বৈঠাচালিত সরু নৌকা) নিয়ে বঙ্গোপসাগরের বাংলা চ্যানেল পাড়ি দিয়েছেন। এটা গত বছরের ১৫ জানুয়ারির কথা। প্রথম আলোর শনিবারের ক্রোড়পত্র ছুটির দিনের প্রতিবেদনের জন্য ১৬ জানুয়ারি যখন তাঁকে ফোন দেওয়া হয়, তখন তিনি ছেঁড়া দ্বীপে পানিতে স্কুবা ডাইভ দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। এই অভিযাত্রী হানিয়াম মারিয়া, কাছের মানুষদের কাছে রাকা নামেই পরিচিত। গত বছরের ১৯ জানুয়ারি ছুটির দিনের প্রচ্ছদ প্রতিবেদনে ছাপা হয় হানিয়াম মারিয়ার কথা।

২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকার বসুন্ধরা সিটি শপিং কমপ্লেক্সের দোতলায় একটি দোকানে, মুখোমুখি বসে কথা হয় রাকার সঙ্গে। দোকানের নাম পিক ৬৯। এই দোকানটি তাঁর নিজের। অ্যাডভেঞ্চার বা রোমাঞ্চকর অভিযানের দরকারি সবকিছুই পাওয়া যায় এখানে। কেন এই দোকান? হেসে, চোখে উজ্জ্বল দৃষ্টি এনে রাকা বললেন, ‘মানুষকে অ্যাডভেঞ্চার আর রোমাঞ্চকর ক্রীড়ায় অনুপ্রাণিত করতেই এই দোকান। প্রযুক্তি–আসক্ত হয়ে মানুষ ঘরকুনো হয়ে যাচ্ছে। সেখান থেকে বের করে আনা দরকার—সুস্থতা আর ফিটনেসের জন্য। আমি যেহেতু ঘুরতে পছন্দ করি, তাই এ উদ্যোগ।’ শাহবাগের আজিজ কো-অপারেটিভ সুপার মার্কেটে প্রথম পিক ৬৯-এর শুরু আট বছর আগে। বসুন্ধরায় চার বছর হলো চালু হয়েছে এই দোকান।

কায়াকে বাংলা চ্যানেল পাড়ি দিয়েছেন, তাই প্রথম ভাবনায় মনে হয় রাকা এক জলের কন্যা। কিন্তু পাহাড়ও তাঁকে সমান টানে। ‘পাহাড়-পর্বতের ক্ষেত্রে আমি উচ্চতা বড় করে দেখি না। দেখি চ্যালেঞ্জ কতটা।’ মানে হলো সহজ পাহাড়ে অভিযানে যান না রাকা। গত বছর অন্নপূর্ণা বেসক্যাম্পে গিয়েছিলেন—সঙ্গে দুজন মেয়েকে নিয়ে। যদিও শেষমেশ অভিযানটি সম্পন্ন হয়নি।

অ্যাডভেঞ্চার জনপ্রিয় করার নানা চেষ্টা আছে হানিয়াম মারিয়া আর তাঁর স্বামী ফজলে রাব্বির। ২০১৬ সালে তাঁরা বিয়ে করেছেন। ফজলে রাব্বিও অভিযাত্রী। কাজ করেন একটি আন্তর্জাতিক সংস্থায়। ট্রাভেলার্স অব বাংলাদেশ (টিওবি) নামের ফেসবুক গ্রুপ চালান আর ঘুরে বেড়ান। টিওবিতে সক্রিয় রাকাও। পাহাড়ি চ্যালেঞ্জের কথায় আসি আবার। ২০১৭ সালে রাকা ও রাব্বি গিয়েছিলেন নেপালের থরংলা পাসে। ৫ হাজার ৪১৬ মিটার উচ্চতার পাহাড় সেটা।

রাকা শোনালেন লাংটান ভ্যালির কথা। সেটাও নেপালে। সেখান থেকে ট্রেকিং করে গেছেন লাংশিশা খারখায়। রাকা বললেন, ‘খুব দুর্গম। আমরা যাওয়ার আগে আগে ভূমিকম্প হয়েছিল। পাথর পড়ে বিরান হয়েছিল পাহাড়ি জনপদ। মাইলের পর মাইল কোনো মানুষ নেই। খুবই কঠিন ছিল সেই অভিযান।’

হানিয়াম মারিয়ার নানা রকম উদ্যোগ রয়েছে। সব মেয়েদের ঘিরে, অভিযান ঘিরে। ফেসবুকে থার্ড আই নামে মেয়েদের একটি গ্রুপ চালান রাকা। ‘মেয়েরা একজন যেন আরেকজনের অনুপ্রেরণা হতে পারে, সে কাজটা এই গ্রুপে চলে।’ নারীদের যোগব্যায়ামচর্চাও করান হানিয়াম মারিয়া। এলিফ্যান্ট রোডের বাড়িতে ধ্যানের অধিবেশনও পরিচালনা করেন। মনে করেন, এই সবকিছুই নারীর সুস্থতা, মানসিক প্রশান্তি আর আত্মবিশ্বাস বাড়ানোর জন্য সহায়ক। জল কিংবা স্থল—মেয়েদের জন্য অ্যাডভেঞ্চার বিশেষভাবেই দরকার। এতে নিজের প্রতি আস্থা বাড়ে।

১৯৮৭ সালে কুষ্টিয়া জন্ম রাকার। কিছুদিনের মধ্যেই চলে আসেন ঢাকায়। স্নাতক হয়েছেন ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস, অ্যাগ্রিকালচার অ্যান্ড টেকনোলজি (আইইউবিএটি) থেকে।

প্রায় নিয়মিতই জলের নিচে স্কুবা ডাইভিং ও স্নরকেলিং করেন রাকা। তিনি বলেন, ‘সামনে আবার যাব সেন্ট মার্টিন দ্বীপে। ডাইভ দিয়ে দিয়ে সেন্ট মার্টিনে বঙ্গোপসাগরের নিচে থাকা ময়লা তুলে আনব। আর পাহাড়ে তো যেতেই হবে।’

আরেকটা পরিকল্পনা আছে রাকার। সেটার জন্য অপেক্ষা নতুন নৌকার। রাকা ও রাব্বির বিশেষ পছন্দ বাংলাদেশের নদীতে সাগরে ঘুরে বেড়ানো। তাঁদের ছিল ইঞ্জিনচালিত একটি ফোলানো (ইনফ্ল্যাটেবল) নৌকা। সেটি দিয়ে সমতলের নদী তো বটেই, পাহাড়ি সাঙ্গু নদীও পাড়ি দিয়েছেন অনেকবার। বার্ধক্য এসেছে নৌকাটির। নতুন নৌকার ফরমাশ দিয়েছেন। সেটি আসছে। রাকা বললেন, ‘বুড়িগঙ্গা থেকে শুরু করব, এরপর নদীপথে পুরো বাংলাদেশ ঘুরব আমরা। এটা আমাদের কাছে খুব রোমাঞ্চকর মনে হচ্ছে।’ আশা করা যায়, সেই নদীপথে বাংলাদেশ ঘোরার সংবাদও আমরা পাব শিগগিরই।

লেখক: যুগ্ম ফিচার সম্পাদক, প্রথম আলো