৭০ শিশুর মুখে হাসি ফুটিয়েছি

স্বল্প আয়ের পরিবারের শিশুদের মুখে হাসি ফোটান চিকিৎসক তাহেরা নাজরীন। ছবি: সংগৃহীত
স্বল্প আয়ের পরিবারের শিশুদের মুখে হাসি ফোটান চিকিৎসক তাহেরা নাজরীন। ছবি: সংগৃহীত

মৌয়ের হতদরিদ্র বাবা হোটেল বেয়ারা হিসেবে কাজ করে দিনে আয় করেন ৭০ থেকে ৮০ টাকা। ৮ বছরের মৌকে নিয়ে বিভিন্ন হাসপাতালেও ঘুরেছেন। মেয়ের হার্টের ছিদ্র বন্ধ করতে হবে। খরচ তো ম্যালা। দিন দিন দুর্বল হয়ে পড়ছে মেয়েটি। হোটেলের কাজ সেরে বাড়ি ফেরার পথে প্রথম আলো পত্রিকায় একটি বিজ্ঞাপনে চোখ আটকে যায় এই বাবার। কোনো রকম কাটাছেঁড়া ছাড়াই শিশুদের হার্টের ছিদ্র বন্ধ করা হচ্ছে রাজধানীর অ্যাপোলো হাসপাতালে। ডিভাইস মিলবে বিনা মূল্যে। মাত্র ৫৫ হাজার টাকার প্যাকেজ। এই বাবা দ্রুত যোগাযোগ করেছিলেন। দেখলাম, শোকে–দুঃখে নুয়ে পড়া বাবা শীর্ণকায় মেয়েটিকে নিয়ে ঢুকলেন। এই প্যাকেজে মেয়ের হার্টের ছিদ্রটি ডিভাইসের মাধ্যমে বন্ধ করা হলো।

শুধু মৌ নয়। ২০১৭ সালের ৮ মার্চ থেকে এ পর্যন্ত মৌয়ের মতো আর্থিক অবস্থায় থাকা ৭০টি শিশুর হার্টের ছিদ্র বন্ধ করা হয়েছে স্বল্পমূল্যে। সরুভালভ ও সরু রক্তনালি ও বেলুনের মাধ্যমে ফুলিয়ে স্বাভাবিক করা হচ্ছে এই হাসপাতালের স্বল্পমূল্যের প্যাকেজে। সেন্টার ফর জাকাত ম্যানেজমেন্ট সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে।

দিনটি ছিল ২০১৭ সালের ৬ মার্চ। দুই বছরের নাহিয়ান মায়ের দুধ টেনে খেতে গেলে হাঁপিয়ে যেত। কপাল ঘেমে যেত। একটু বড় হলে খাবার খেতে গেলে শ্বাস কষ্ট হতো। বুকের পাঁজর দেবে যেত। বারবার নিউমোনিয়ার কারণে হাসপাতালে ভর্তি হতো, ওজনও কম ছিল। নাহিয়ানের বাবা কিছুদিন আগে মারা গেছেন ক্যানসারে। এ রকম পরিস্থিতিতে প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক মা জানতে পারলেন, নাহিয়ানের হার্টে বড় একটি ছিদ্র। ইকো পরীক্ষা করে দেখলাম ছিদ্রটি অস্ত্রোপচার ছাড়া ডিভাইস দিয়ে বন্ধ করা যাবে। সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে নাহিয়ানকে দিয়েই হাসপাতালে শুরু হলো স্বল্পমূল্যের প্যাকেজটি। নাহিয়ানের ছিদ্র বন্ধ করা হলে পরের দিনই মা ও ছেলে হাসতে হাসতে বাড়ি ফিরলেন।

শিশুদের জন্মগত ছিদ্রগুলো (ASD, VSD, PDA) বন্ধ করার ডিভাইস বা বোতামের দাম প্রায় দেড় থেকে তিন লাখ টাকা। হাসপাতালে দুই দিন থাকা ও প্রসিডিউরের খরচও প্রায় ৯০ হাজার টাকা। নিম্নবিত্ত বা মধ্যবিত্ত মা–বাবার কাছে এ টাকা ধরাছোঁয়ার বাইরে। আমি একটি প্যাকেজ তৈরি করলাম এবং হাসপাতালের কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বললে হাসপাতালের প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা চিকিৎসক রত্নদ্বীপ চাসকার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য চালু হলো ৫৫ হাজার টাকার প্যাকেজ, যা ছিল ৯০ হাজার টাকা। কিন্তু ডিভাইসের খরচ তো আছে, এগুলো যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি। আমি আমার আত্মীয়স্বজন, বন্ধুজন ও হাসপাতালের কিছু সুহৃদয় ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বললে অনেকেই এগিয়ে এলেন, ডিভাইসের খরচও জোগাড় হয়ে গেল। আমি বিভিন্ন সরকারি–বেসরকারি হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটে গিয়ে নব্য চিকিৎসকদের জানানোর জন্য প্রচার কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি। তাঁরা সময় মতো একজন শিশুকে হৃদ্‌রোগ বিশেষজ্ঞের কাছে পাঠালে শিশুর জীবন বাঁচানো সম্ভব।

আমি সরকারি হাসপাতালে কাজ করতে পারিনি। পেডিয়াট্রিকসে (শিশু রোগ) উচ্চতর ডিগ্রি ডিসিএইচ ও এফসিপিএস অর্জন করার পর সাব-স্পেশালিটি করার তাগিদ অনুভব করেছি পেডিয়াট্রিক কার্ডিওলজিতে। এই পরিসরে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চিকিৎসকের সংখ্যা অনেক কম।

ভারতের নারায়না হৃদয়ালয়া হাসপাতালে প্রশিক্ষণ, একটানা বেঙ্গালোর, জয়পুর, কলকাতা হৃদয়ালায়া হাসপাতাল ও ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি-সিঙ্গাপুরে (এনইউএইচএস) কাজ করার সুযোগ হয়েছে আমার। দেখেছি, জমি, গয়না বিক্রি করে হলেও বাংলাদেশের মা–বাবারা তাঁদের সোনামণির চিকিৎসা করাতে এসেছেন অন্য দেশে। তিন বছর প্রশিক্ষণ শেষ করে দেশে ফিরে এই শিশুদের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলাম।

এই শিশুদের পাশে দাঁড়াতে গিয়ে নিজের ছেলেমেয়েকেও সেভাবে সময় দিতে পারিনি। ২০১১ সালের মাঝামাঝি মেয়েটি ষষ্ঠ শ্রেণি ও ছেলেটি পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে। ছেলেটি রাতে জেগে বসে থাকত কখন আমি হাসপাতাল থেকে বাসায় ফিরে ওকে মুখে তুলে খাইয়ে দেব। মেয়েটি বসে থাকত সারা দিনের গল্পের ঝুড়ি নিয়ে। দেশের বাইরে প্রশিক্ষণ নিতে গিয়ে প্রথম প্রথম ঘুমের মধ্যে হাত বাড়িয়ে দিতাম ছেলেকে খাইয়ে দেব বলে। ঘুম ভেঙে ডুকরে কাঁদতাম। আবার শক্ত মনে সকালেই হাসিমুখে কাজ শুরু করেছি। দেশে ফিরে করপোরেট হাসপাতালে কাজ শুরু করাটা যেমন আশীর্বাদ ছিল, তেমনি ছিল চ্যালেঞ্জিং বা যুদ্ধ করা। তবে আমার সৌভাগ্য যে, হাসপাতালের কর্তৃপক্ষ আমাকে বিশ্বমানের ইকো মেশিন ও ক্যাথল্যাবসহ সব সুযোগ-সুবিধা দিয়েছিলেন। কিন্তু সব সময় মাথায় ছিল, আমি তো চিকিৎসা দিচ্ছি তাঁদের, যাঁরা দেশের বাইরে গিয়ে চিকিৎসা করাতে পারেন। কিন্তু যাঁরা এই হাসপাতালের নাম শুনলেই ভয়ে আমার কাছে আসতে পারছে না, তাঁদের কাছে তো আমাকে পৌঁছাতে হবে। সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের কাছে পৌঁছানোর জন্য আমার প্রতিষ্ঠান যেমন পাশে ছিল, তেমনি পাশে পেয়েছি আমার স্বামী ব্যবসায়ী সৈয়দ সালমান হাবীব, মা, শাশুড়ি ও বাচ্চাদের।

তাহেরা নাজরীন, শিশু হৃদ্‌রোগ বিশেষজ্ঞ, ক্লিনিক্যাল অ্যান্ড ইন্টারভেনশনাল পেডিয়াট্রিক কার্ডিওলজিস্ট কনসালট্যান্ট, অ্যাপোলো হাসপাতাল, ঢাকা