ঘরবন্দী দিনলিপি

>
করোনাকালে কাটছে ঘরবন্দী সময়। বন্ধু–স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগ হয় মুঠোফোনে। ছবি: স্বপ্ন নিয়ে
করোনাকালে কাটছে ঘরবন্দী সময়। বন্ধু–স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগ হয় মুঠোফোনে। ছবি: স্বপ্ন নিয়ে
ঘরে বসে কীভাবে কাটছে সময়, নতুন কী শিখলেন, কী অভিজ্ঞতা হলো—জানতে পাঠকের কাছে লেখা আহ্বান করেছিলাম আমরা। বাছাই করা কয়েকটি লেখা নিয়ে এই আয়োজন।
রাফিদ রাইয়ান
রাফিদ রাইয়ান

পরে যেন আফসোস না হয়
রাফিদ রাইয়ান, চতুর্থ বর্ষ, রংপুর মেডিকেল কলেজ

 এ লেখাটা যখন লিখছি, একদিন বাদেই পয়লা বৈশাখ। করোনাভাইরাসের তোপে এই বৈশাখে সবাই কার্যত গৃহবন্দী। কিন্তু গত রাতের কালবৈশাখী জানান দিয়ে গেল, বর্ষবরণের সব উদ্যোগ প্রকৃতি ঠিকই নিয়েছে।
সাধারণত বর্ষবরণের এই সময়টা ক্যাম্পাসে থাকি। এ সময় ক্যাম্পাস পরিণত হয় বড়দের–ছোটদের মিলনমেলায়। রাত জেগে ক্যাম্পাস সাজানো আর আলপনা আঁকা চলে, সেই সঙ্গে থাকে শোভাযাত্রার প্রস্তুতি, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা। এবার সেসব কিছুই নেই।

করোনাভাইরাসের প্রকোপে মার্চ থেকেই বাসায় বসে আছি। পরীক্ষার মাঝখানে চলে এসেছি। চিন্তা ছিল, ছুটি শেষেই পরীক্ষায় বসতে হবে। কিন্তু এখন লকডাউনের মেয়াদ বাড়ায় ক্যাম্পাস কবে খুলবে, তার নিশ্চয়তা নেই। তা–ও একটু একটু করে পড়ালেখা এগিয়ে রাখছি। নাহলে পরে সময়টার জন্য আফসোস করতে হবে।

কিন্তু কাহাঁতক আর বই নিয়ে বসে থাকা যায়। তাই ছবি আঁকা শুরু করলাম। নিউমার্কেট থেকে জলরং কিনে এনে রেখেছিলাম। এবার সেগুলো কাজে লাগাচ্ছি। ইনস্টাগ্রাম আর ইউটিউবে শিল্পীদের কাজ দেখছি, শিখছি, নিজে আঁকছি। অনলাইন শিক্ষার ওয়েবসাইট ইউডেমিতে কয়েকটা কোর্সে নিবন্ধন করে রেখেছি, দেখা শুরু করব। এই ফাঁকে করোনাভাইরাসের ওপর কয়েকটা কোর্সও করলাম ইন্টারনেটে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, বিশ্বের বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয় অনেক কোর্স বানিয়ে রেখেছে অনলাইনে। চিরায়ত সািহত্যের প্রতি বরাবর ঝোঁক ছিল। গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের ছোট গল্পসমগ্র পড়লাম। এখন পড়ছি মঈনুস সুলতানের ভ্রমণগল্প রোড টু কান্দাহার

উচ্চশিক্ষা, ক্যারিয়ার নিয়ে বিভিন্ন সাইটগুলোতে খোঁজ নিচ্ছি, সিনিয়রদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছি। এখন সবাই মোটামুটি ঘরে বসে। তাই তাঁরাও আগ্রহ নিয়ে সহযোগিতা করছেন। করোনার দিন একদিন নিশ্চয়ই শেষ হবে। সময়টা চলে গেলে যেন আফসোস না করা লাগে, সেই চেষ্টা করছি।

১২.০৪.২০২০

কানিজ ফাতেমা
কানিজ ফাতেমা

পাখির কাছে শেখা
কানিজ ফাতেমা, তৃতীয় বর্ষ, দর্শন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

 বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় বর্ষের চূড়ান্ত পরীক্ষা সামনে। সারা দিন ক্লাস, টিউটোরিয়াল—এসব নিয়ে ব্যস্ততা। উত্তরার বাসা ছেড়ে কয়েক মাসের জন্য চলে গিয়েছিলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলে। মায়ের আঁচলে বেড়ে ওঠা এই আমার হল জীবনে মানিয়ে নিতে খুব কষ্ট হচ্ছিল। পড়ায় মন বসে না। পরীক্ষার প্রস্তুতিও খুব খারাপ। শুধু মনে হচ্ছিল, কোনোভাবে যদি পরীক্ষাটা পিছিয়ে যেত। কিন্তু এভাবে যে জীবনটাই হঠাৎ থমকে যাবে, ভাবিনি।

১৬ মার্চ বিকেলে আবার ফিরলাম বাসায়। সারা দিনের ক্লাস, পরীক্ষা—এসবের চিন্তা থেকে মুক্তি পেয়ে প্রথম কয়েক দিন ভালোই কাটল। কিন্তু এরপরই কেমন যেন একটা দমবন্ধ অনুভূতি হতে লাগল। কী অপেক্ষা করছে সামনে? খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের কী হবে? পরিচিত সব মুখ আবার দেখতে পাব তো?

বিষণ্নতায় ভরা দিনগুলোতে আমাকে একটুখানি স্বস্তি এনে দিল বারান্দায় করা আমার ছোট্ট বাগান। শখ করে রুম লাগোয়া বারান্দাটায় লাগিয়েছি নানা রকম গাছ। হঠাৎ একদিন খেয়াল করলাম, বারান্দার গ্রিল ঘেঁষে বেড়ে ওঠা আমার অপরাজিতাগাছের ডালে দুটো বুলবুলি বাসা বানাচ্ছে। থমকে যাওয়া এই নগরীতে ওদের কিচিরমিচিরেই প্রাণ পায় আমার বারান্দা। প্রথম প্রথম আমাকে দেখলে ভয়ে উড়ে যেত। একসময় আমাকে হয়তো একটু একটু চিনে ফেলে। পাত্তা না দিয়েই আপনমনে চালিয়ে যায় বাসা বানানোর কাজ।

২২ মার্চ সকালে ঘুম ভাঙার পর চুপি চুপি বারান্দায় গিয়ে দেখি, পাখিটা নেই। বাসাটা এত উঁচুতে বানানো যে বারান্দার গ্রিল বেয়ে ওপরে ওঠা ছাড়া পাখির বাসায় কী আছে, দেখার উপায় নেই। ছোটবেলার গ্রিল ধরে ঝুলে থাকার প্রতিভা কাজে লাগিয়ে উঠে গেলাম, উঁকি দিলাম বুলবুলির বাসায়। দেখি ছোট্ট দুইটা ডিম। আমার আনন্দ তখন দেখে কে! শুরু হলো অপেক্ষার পালা।

আমার রুমের জানালা দিয়েই দেখা যেত বারান্দা। আমি গল্পের বই পড়তে পড়তে কিংবা কখনো সিনেমা দেখতে দেখতে উঁকি দিয়ে দেখতাম, ডিমে তা দিয়ে যাচ্ছে মা পাখিটা। কখনো তো এভাবে এত কাছ থেকে পাখি, পাখির বাসা দেখার সুযোগ বা সময় হয়নি। তাই পাখিগুলোর প্রতি অন্য রকম একটা মমতা, ভালোবাসা কাজ করতে লাগল।

২ এপ্রিল আবার গ্রিল বেয়ে ওপরে উঠে দেখি, পালকহীন, ছোট্ট, লাল দুটো দেহ। নিশ্বাসের সঙ্গে কেঁপে কেঁপে উঠছে ওরা। কী যে ভালো লাগল আমার! মনে হলো এ যেন আমারই পোষা কোনো পাখির বাচ্চা। চোখের সামনেই বাচ্চাগুলো বেড়ে উঠতে লাগল আস্তে আস্তে৷ সকালবেলা মা আর বাবা পাখি বেরিয়ে পড়ে। ঠোঁটে করে নিয়ে আসে নানা রকমের পোকামাকড়। বাচ্চা দুটো হাঁ করে ঠোঁট বাড়িয়ে দেয়। সন্ধ্যা হলেই বাবা পাখিটা কোথায় যেন চলে যায়, আর মা পাখি বাসায় বসে তার ডানা দিয়ে আগলে রাখে বাচ্চা দুটোকে।

পাখিগুলো আমাকে জীবনের অনেক বড় শিক্ষা দিয়ে গেল। সন্তানের প্রতি বাবা–মায়ের ভালোবাসা, কষ্ট—এসব খুব কাছ থেকে উপলব্ধি করার সুযোগ করে দিল। আমাদের মা-বাবাও আমাদের জন্য কত কষ্ট করেন, ত্যাগ স্বীকার করেন। আর আমরা হয়তো খুব সামান্য কিছু নিয়েই তাঁদের সঙ্গে রাগারাগি করে ফেলি, তাঁদের মনে কষ্ট দিই। সব সময় নিজেদের মতো করেই বন্ধুবান্ধব নিয়ে সময় কাটাই। সন্তান হিসেবে বাবা-মাকেই বা কতটুকু সময় দিই? এসব ভেবে নিজের মধ্যে একধরনের গ্লানি, অপরাধবোধ কাজ করল। মনে মনে প্রতিজ্ঞাও করলাম, যতটা পারি বাবা-মাকে সময় দেব।

বাচ্চাগুলো দেখতে দেখতে বড় হয়ে গেল। ১২ এপ্রিল দেখি ওরা একটু একটু ওড়ার চেষ্টা করছে। পরদিন ঘুম থেকে উঠে দেখি, বাচ্চা দুটো দিব্যি বাসা থেকে বেরিয়ে গ্রিলের ওপর বসে আছে। ঘণ্টাখানেক পরই ওদের আর দেখতে পেলাম না। হয়তো ওরা স্বাধীন হয়ে গেছে। ওরা ভালো থাকুক। আর এভাবেই প্রকৃতির সঙ্গে গড়ে উঠুক মানুষের বন্ধন।

১৫.০৪.২০২০