জেআরসি স্যারকে যেমন জানতাম

নায়াগ্রা জলপ্রপাতের সামনে অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী। ছবি: লেখক
নায়াগ্রা জলপ্রপাতের সামনে অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী। ছবি: লেখক

নবম শ্রেণিতে আমার এক গৃহশিক্ষক ছিলেন। তিনি বুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়তেন। উনি দুইটা বিষয়ে খুব গর্ব বোধ করতেন। এক, তাঁদের জেলার বুয়েট অ্যাসোসিয়েশন এবং দুই, জেআরসি স্যার।

আমি অবাক হয়েছিলাম। দেশের একটি জেলাকে নিয়ে ওনার মাতামাতিতে নয়; বরং একজন মানুষের নাম জেআরসি কেন? তবে জেআরসি মানুষটা মনে হয় খুবই করিতকর্মা। কারণ, তাঁরই সুপারিশে আমার গৃহশিক্ষকের ডিগ্রি শেষ করার আগেই বিদেশে চাকরি হয়ে গেল।

ঘরে এলেন নতুন এক গৃহশিক্ষক। উনিও বুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়েন এবং জেআরসি বলতে আরও বেশি পাগল। উনি আমাকে বোঝালেন, 'জেআরসি তোমার আগের শিক্ষকের জন্য সুপারিশ করেননি। উনি শুধু একটু কাগজে ছোট করে লিখে দিয়েছিলেন, “তোমরা একটু দেখো”। তাতেই কাজ হয়ে গেছে।' 

আরও কয়েক বছর পরে, বিটিভিতে কম্পিউটার নিয়ে বিশেষ অনুষ্ঠান। হঠাৎ দেখি উপস্থাপিকা জেআরসি বলে একজনকে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন। সঙ্গে বললেন, 'বাংলাদেশে কম্পিউটার নিয়ে চর্চার ক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকা অন্যতম।'
সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে নিয়ে একটু গবেষণা করেই চক্ষু চড়কগাছ হলো। উনি সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে গ্র্যাজুয়েট ডিগ্রি নেওয়ার সময় ১৯৬৬ সালে কংক্রিটের বিমে ফাটল আছে কি না বোঝার জন্য উনি কম্পিউটার প্রযুক্তি ব্যবহার করেছেন। ষাটের দশকে কম্পিউটারের মতো দুর্লভ প্রযুক্তিকে কেন্দ্র করে ডিগ্রি নেওয়ার প্রবণতাকে শুধু এক শব্দেই সমাহিত করা যায়, কালদ্রষ্টা। পরবর্তীকালে ওনার নেতৃত্বেই বুয়েটে কম্পিউটার ল্যাব তৈরি হয়েছে। কম্পিউটার নিয়ে আলোড়ন তৈরি হয়েছে। এর রেশ ধরে অনেকেই কম্পিউটার বিজ্ঞান নিয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য অনুপ্রাণিত বোধ করেছেন। আমি তাঁদের একজন।
যুক্তরাষ্ট্রে পিএইচডির প্রথম বর্ষ, সাল ২০০৮। দেশে মা মুমূর্ষু অবস্থায়, অনেক রক্ত লাগবে। আমি অনন্যোপায় হয়ে রক্ত চেয়ে যোগাযোগমাধ্যমে এক স্ট্যাটাস দিয়ে দিলাম। অনেকেই সঙ্গে সঙ্গে ফেসবুকে প্রকাশ্যে সাহায্য করতে এগিয়ে এলেন। শুধু একজন লিখলেন ব্যক্তিগতভাবে। ইউনিভার্সিটির এক সিনিয়র আপা—কারিশমা। উনি তখন যুক্তরাষ্ট্রে ছিলেন। তবে ওনার ছোট ভাই কাশিফ দেশে থাকেন, উনি নাকি রক্ত দিতে পারবেন। কাশিফ বড় চাকরি করেন। চাকরি ফেলে দিনের অর্ধেক বেলা ব্যয় করলেন অজানা, অচেনা এক মানুষকে রক্তদানে। পরে জানতে পেরেছি, কারিশমা ও কাশিফ জেআরসি স্যারের দুই সন্তান।
যুক্তরাষ্ট্রে ফেরত এসে ইউনিভার্সিটির বন্ধুদের সঙ্গে কথা হচ্ছে। অনেকেই জিজ্ঞেস করছিল, মায়ের রক্তের ব্যবস্থা হয়েছে কি না।
'হ্যাঁ, কারিশমা আপার অনুরোধে ওনার ছোট ভাই–ই তো দিল। কেন? তোমাদেরকে বলেনি কিছু বুঝি?' যোগাযোগমাধ্যমে ঢাকঢোল বাজানোর এই যুগে বাবার মতো প্রচারবিমুখ দুই ভাইবোন। আমার অবাক উপলব্ধি।
সেই সপ্তাহান্তে আমার বন্ধু নায়াগ্রা ফলস যাবে। আমাকেও সঙ্গে নেবে। গাড়িতে উঠতে গিয়ে দেখি, সঙ্গে আরও আছেন, 'জেআরসি স্যার, ওনার স্ত্রী, কারিশমা আপা ও জিয়া ভাই (কারিশমা আপার স্বামী)। আমার সঙ্গে ওনার প্রথম দেখা। সবাই তাঁকে স্যার বলে ডাকছেন। ভয়ে আমার অবস্থা কেরোসিন। তাই আমি পেছনের সিটে মাথা নিচু করে কাঁচুমাচু করে বসে গেলাম। জেআরসি স্যার ছিলেন সামনের সিটে। তবে ওনার মাথার পেছনেও মনে হয় এক জোড়া চোখ লাগানো আছে। বুঝতে পেরেছিলেন যে আমি হয়তো অস্বস্তিবোধ করছি। কয়েক ঘণ্টা চলার পরে গাড়ি থামানো হলো রাতের খাবারের জন্য। জেআরসি স্যার লাইনের সামনে দাঁড়িয়ে প্রথমে আমার হাত ধরে বললেন, কী খাবে বলো। আজ আমি তোমাদের সবাইকে খাওয়াব। পরিবার নিয়ে ভ্রমণ করার সময়ে আমার মতো অচেনা, অজানা এক শিক্ষার্থীর অনুভূতিকে প্রাধান্য দেওয়ার প্রত্যুৎপন্নমতিত্বে আমি সেই দিন অনুপ্রাণিত হয়েছিলাম। পণ করেছিলাম যে স্যারের মতো বিদ্বান হয়তো হতে পারব না, কিন্তু তাঁর মতো ভালো মানুষ হওয়ার চেষ্টা করব।
সেই থেকে স্যারের সঙ্গে সখ্য।
প্রতিদিন সকালে স্যার ধানমন্ডি লেকে হাঁটতে বের হতেন। ওনার সঙ্গে মুখোমুখি হওয়ার প্রয়াসে আমিও প্রতি ডিসেম্বরে বাংলাদেশ ভ্রমণ করার সময় প্রতিদিন লেকের পাশে হাঁটতাম। দেখা হতো প্রায় প্রতিদিনই। ওনার চারপাশে প্রায়ই অনেক লোকের সমাগম থাকত। তাই অনেক সময়েই তাঁকে দূর থেকে শনাক্ত করতে পারতাম না। উনি কিন্তু ঠিকই চিনে ফেলতেন। আন্তরিক স্মরে কাছে ডাকতেন, কাছের সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতেন। বাংলাদেশের কাগজে লেখালেখিকে উনি খুবই উৎসাহব্যঞ্জকভাবে দেখতেন। নতুন কিছু লিখলে ব্যক্তিগতভাবে এবং ই-মেইলে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অনুপ্রেরণা দিতেন, বাংলাদেশের জন্য ভাবতে অনুরোধ জানাতেন।

পৃথিবীতে অনেকেই আছেন বিদ্যা, বুদ্ধি, অর্থ এবং সম্মানে পরিপূর্ণ। কিন্তু জেআরসি স্যার তাঁদের সবার থেকে আলাদা। কারণ, তিনি তাঁর বিদ্যা, বুদ্ধি ও প্রভাবের সুষম প্রয়োগ করেছেন। অসম্ভব মেধাবী এবং মার্জিত দুই সন্তানের পাশাপাশি তিনি যুগের পর যুগ চারিত্রিক মহত্ত্বের মধ্যে হাজার হাজার শিক্ষার্থীকে দিকনির্দেশনা দিয়েছেন, ভালো মানুষ হওয়ার অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন। তিনি আজ চলে গেলেও তাঁর শাণিত জ্ঞান, প্রজ্ঞা, আন্তরিকতা আমাদের এবং আমাদের পরবর্তী প্রজন্মগুলোকে ভবিষ্যতের চলার রাস্তা বাতলে দেবে।