অদ্বিতীয় আনিস স্যার

জাতীয় অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান।
জাতীয় অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান।

আমরা বাংলাদেশে যারা সাংস্কৃতিক অঙ্গনে বিচরণ করি, তাদের পরম সুহৃদ ছিলেন ড. আনিসুজ্জামান—আমাদের আনিস স্যার। সত্যিকার অর্থে একজন বিদ্বান ও শিক্ষাগুরু ছিলেন। সব ধরনের মানবিক গুণের সমন্বয়ে একজন নির্মল মানুষ ছিলেন স্যার। পৃথিবীর যেকোনো দেশে জন্মগ্রহণ করলে তিনি সে দেশেই উচ্চাসনে সমাসীন হতেন।

স্যারের সঙ্গে প্রচুর সুখস্মৃতির একজন সৌভাগ্যবান সাক্ষী আমি। আমার নাট্যদল নাট্যজনের একটি নাটকের খুব প্রয়োজন ছিল। স্যারকে অনুরোধ করতেই নিজের শত ব্যস্ততার মাঝেও মূল্যবান সময় ব্যয় করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগার ঘেঁটে রস–সাহিত্যিক প্রমথনাশ বিশীর বিখ্যাত হাসির নাটক ‘ঘৃতং পিবেৎ’ খুঁজে আমাকে দিয়েছিলেন। নাটকটি সুপ্রযোজনা হিসেবে প্রশংসিত হয়। পরবর্তী সময়ে ইন্ডিয়ান কাউন্সিল ফর কালচারাল রিলেশনসের আমন্ত্রণে জ্যেতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রহসন অলীক বাবু নয়াদিল্লি, লক্ষ্ণৌ ও কলকাতার মঞ্চস্থ করি। ভারতে এই নাটকটি সুনামের সঙ্গে মঞ্চায়ন উপলক্ষে ভারতীয় দূতাবাসের তৎকালীন কাউন্সিলর শ্রী অজিত গুপ্ত তাঁর বাসায় নৈশভোজের আয়োজন করেন। ওখানে উপস্থিত হয়ে দেখি স্যার বসে আছেন। নৈশভোজের পর স্যার আমাকে বললেন, আমার গাড়ি আছে কি না। আমি হ্যাঁ বলাতে তাঁকে আমার বাসায় যাওয়ার পথে গুলশানে ন্যাম ভবনে পৌঁছে দিতে অনুরোধ করলে বাসার সামনে নামিয়ে দেওয়ার পর যতক্ষণ গাড়িটি তাঁর দৃষ্টিগোচরে ছিল, আমি বিস্মিত হয়ে দেখলাম, স্যার হাত নাড়ছেন। আমার মতো একজন সাধারণ মানুষের প্রতি তাঁর এই শিষ্টাচার আমাকে সারাটা পথ আপ্লুত করে রেখেছিল।

বেশ কয়েক বছর আগে আমার স্ত্রী অভিনেত্রী সাঈদা ইসলাম আমাদের জনৈক আত্মীয়ের ছেলের পান–চিনিতে উপস্থিত হয়ে দেখল কন্যাপক্ষের হয়ে স্যার বসে আছেন। তখন থেকেই দেখা হলে স্যার সাঈদাকে সস্নেহে বেয়ান বলে সম্বোধন করতেন। স্যারের সঙ্গে সামনে বা ফোনে কথা হলেই জিজ্ঞেস করতেন, ‘বেয়ান, কেমন আছেন?’

ভারত সরকারের পদ্মভূষণ পুরস্কার প্রাপ্তিতে সাঈদা, দলের সদস্য উত্তম গুহ ও চিত্রলেখা গুহকে নিয়ে স্যারের বাসায় গিয়ে একটি ক্রিস্টালের স্মারক উপহার দিয়ে আমার বাসায় নিমন্ত্রণ করলাম। স্যার ব্যস্ততার দরুন আপাতত সময় দিতে না পারায় মনটা খারাপ হয়ে গেল। হঠাৎ কয়েক মাস পর স্যার ফোনে বললেন, আমাদের বাসায় মধ্যাহ্নভোজের একটা তারিখ বের করেছেন। এত দিন মনে রেখেছেন! যারপরনাই আনন্দিত ও বিস্ময়াবিষ্ট হলাম। নির্দিষ্ট দিনে স্যার যথারীতি সময়মতো সস্ত্রীক উপস্থিত হলেন। সুরধুনী হিসেবে সাঈদার অন্ন গ্রহণের পর স্যারকে একলা পেয়ে একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলাম। পাকিস্তানের জনক মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ জাঁদরেল ইংরেজ ও ভারতীয় নেতাদের সঙ্গে সংগ্রাম করে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান নামে এই উপমহাদেশে মুসলমানদের জন্য একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন করেন। কিন্তু এখনো কিছু রাজনীতিবিদ ও ঐতিহাসিক দ্বিজাতিতত্ত্ব ও সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তি ইত্যাদি যুক্তিতে পাকিস্তান সৃষ্টির বিরোধিতা কেন করেন? তাহলে, আপনিসহ পশ্চিমবঙ্গ, আসাম থেকে প্রচুর, বিশিষ্ট, রাজনীতিবিদ, বরেণ্য বুদ্ধিজীবী, লেখক, গায়ক গায়িকা অভিনেতারা কেন পাকিস্তানে চলে এলেন? স্যার উত্তরে বললেন, ‘১৯৪৭ সালে আমরা অধিকাংশই পাকিস্তান সৃষ্টির পক্ষে ছিলাম। কিন্তু পরবর্তী সময়ে পশ্চিম পাকিস্তানি বিশেষ করে পাঞ্জাবিদের দুঃশাসন, অপশাসন, শোষণ, বঞ্চনা ইত্যাদির বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আন্দোলন, বিশেষ করে ৬ দফা দাবিতে স্বাধীন বাংলাদেশের সংগ্রামে আমরা বাঙালিরা ঐক্যবদ্ধ হয়েছিলাম।’

একবার চারুকলা ইনস্টিটিউটের বকুলতলায় স্যারকে জিজ্ঞেস করলাম, প্রতিবছর অমর একুশে উপলক্ষে কেন ২১ জনকেই ২১ একুশে পদক প্রদান করতে হবে? অযোগ্য ব্যক্তি, তদবির ও বায়োডাটার মাধ্যমে কেন স্বাধীনতা ও একুশে পদককে অবমূল্যায়ন করা হচ্ছে? এই পদক দুটির কি কোনোই মানদণ্ড নেই? এই হারে ও মানদণ্ডে পদক প্রদান করলে অচিরেই টর্চলাইট দিয়ে খুঁজে খুঁজে স্বাধীনতা ও একুশে পদকের জন্য মানুষ খুঁজতে হবে! শুনে স্যার হাসতে হাসতে বললেন, এ দেশে কিছু ব্যক্তি নিজেই নিজের মুখে টর্চলাইট দিতে সচেষ্ট, অন্যের প্রয়োজন পড়ে না।

এই করোনাভাইরাসের বিভীষিকার মাঝে স্যার, আপনি আপনার অগণিত শুভানুধ্যায়ীদের ফাঁকি দিয়ে প্রায় অগোচরেই চলে গেলেন? এভাবে আপনাকে আমরা চিরতরে বিদায় দিতে চাইনি। এ দুঃখ আমাদের জীবনে কখনোই যাবে না। আপনি যেখানেই থাকুন শান্তিতে থাকুন।