আশার আলো আছে

>
গ্রাফিকস: মনিরুল ইসলাম
গ্রাফিকস: মনিরুল ইসলাম
ক্লাসে, ক্যাম্পাসে ফেরা হচ্ছে না প্রায় তিন মাস। তারুণ্যের উচ্ছ্বাস নিয়ে পথে নামার উপায় নেই। জীবনের গন্তব্য নিয়ে যাঁদের স্বচ্ছ পরিকল্পনা ছিল, তাঁদেরও ভাবতে হচ্ছে নতুন করে। করোনাকাল আমাদের সামনে যতই বাধার দেয়াল তুলে দিক, অনিশ্চয়তার অন্ধকার দেখে ঘাবড়ে গেলে চলবে না। কারণ, ইতিবাচক মানসিকতাই সামনে এগোনোর সাহস জোগায়।
সাইফ নোমান খান
সাইফ নোমান খান

তরুণদের মানসিকতায় ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে
সাইফ নোমান খান
সহযোগী অধ্যাপক, ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউট (আইবিএ), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ইতিহাস বলে, যে প্রজন্মের কোনো দুর্যোগের মধ্য দিয়ে যাওয়ার অভিজ্ঞতা হয়েছে, তারাই পরবর্তী সময়ে ভালো করেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অভিজ্ঞতা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র শক্তি সঞ্চয় করেছে। আমাদের দেশেও ১৯৭১ সালের প্রজন্ম দেশ গড়ায় বড় ভূমিকা রেখেছে। বর্তমান দুর্যোগ–পরবর্তী সময়ের ক্ষেত্রেও এই আশা আমরা করতে পারি, সেটা শুধু ইতিহাসের দিকে তাকিয়ে নয়। এই কঠিন সময় এখনকার তরুণদের সমানুভূতি (এমপ্যাথি), আবেগিক বুদ্ধিমত্তার (ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্স) মতো জরুরি বিষয়গুলো শেখাচ্ছে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লব নিয়ে অনেকে হয়তো আগে খুব একটা ভাবেনি। বর্তমান সংকট আমাদের ভাবতে বাধ্য করছে। আমরা বুঝতে পেরেছি, প্রচলিত ধারায় এগোলে টিকে থাকা কঠিন হয়ে যাবে।

আমি মনে করি, করোনার আগে ও পরে, তরুণদের মানসিকতায় আমরা একটা পার্থক্য দেখতে পাব। এই দুঃসময়ে অনেকে সঞ্চয়ের গুরুত্ব বুঝেছে, জীবনে শৃঙ্খলার প্রয়োজনীয়তা বুঝেছে। এই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে তারা নিশ্চয়ই আরও পরিকল্পিতভাবে কাজ করতে শিখবে।

জারিফ তামান্না মতিন
জারিফ তামান্না মতিন

বিভিন্ন দেশ নিজেদের স্বার্থেই উচ্চশিক্ষার সুযোগ দেবে
জারিফ তামান্না মতিন, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, জেডটিএম কনসালট্যান্সি লিমিটেড এবং সাবেক কান্ট্রি ম্যানেজার, চার্টার্ড ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউন্টেন্ট

বিশ্বের অনেক দেশের অর্থনীতির একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ নির্ভর করে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীর ওপর। হোটেল, রেস্তোরাঁ, ব্যাংক, বিমা, অনেক কিছু শিক্ষার্থীদের ওপর নির্ভরশীল। অতএব এখন একটু অস্থিরতা তৈরি হলেও, বিভিন্ন দেশ নিজ স্বার্থেই আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের জন্য সুযোগ করে দেবে। যাঁরা ভিনদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পেয়েও বর্তমান পরিস্থিতির কারণে এখনো যেতে পারেননি, তাঁদেরও ভয় পাওয়ার কিছু নেই। অনেক বিশ্ববিদ্যালয় এরই মধ্যে অনলাইনে ভর্তি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে ক্লাসও শুরু করে দিয়েছে। অনলাইনে ক্লাস হচ্ছে বলে অনেক বিশ্ববিদ্যালয় টিউশন ফি কমিয়ে দিয়েছে, এটাও একটা ইতিবাচক দিক।

অনলাইনে ডিগ্রি নেওয়ার সুযোগ আগেই ছিল। সামনের দিনগুলোতে এটা আরও বাড়বে বলে মনে হয়। নিয়মিত বৃত্তিগুলো যে বন্ধ হয়ে গেছে, তা-ও কিন্তু নয়। বরং অনেক বিশ্ববিদ্যালয় বৃত্তির আবেদনের সময়সীমা বাড়িয়েছে। এসব সুযোগ কাজে লাগাতে হলে আগে সময়টাকে কাজে লাগাতে হবে।

শাহরিয়ার আহমেদ চৌধুরী
শাহরিয়ার আহমেদ চৌধুরী

গবেষণার সুযোগ বাড়বে
শাহরিয়ার আহমেদ চৌধুরী
পরিচালক, সেন্টার ফর এনার্জি রিসার্চ, ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, ঢাকা

শুধু গবেষণা খাতের কথা যদি বলি, আমার মনে হয় সব দিক দিয়েই আমরা ইতিবাচক প্রভাব দেখতে পাব। বর্তমান সময় গবেষণার গুরুত্ব বুঝতে আমাদের সাহায্য করেছে। অণুজীববিজ্ঞান, ফার্মাসির মতো বিষয়গুলোতে গবেষণা বাড়বে, সেটা স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে। আমাদের দেশে নানা সীমাবদ্ধতা নিয়েও কিন্তু এখন অনেক গবেষক কাজ করছেন। আবার স্বাস্থ্যসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো ছাড়া অন্য সব খাতেও গবেষণার প্রয়োজন হবে। কারণ, আমাদের জীবনধারায় একটা বড় পরিবর্তন এসেছে। প্রকৌশল, ব্যবসা, অর্থনীতি, সব খাতে আরও গবেষণার চাহিদা তৈরি হবে।

আমাদের দেশে গুটিকয়েক বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া গবেষণা খুব একটা হয় না। শুধু ইচ্ছাই যথেষ্ট নয়, গবেষণার তহবিল পাওয়াও একটা বড় ব্যাপার। আশা করি, সরকার, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষসহ সংশ্লিষ্ট সবাই এ ব্যাপারে আরও গুরুত্ব দেবে। এ ছাড়া আমাদের দেশের অনেক তরুণ বিদেশে গবেষণা সহযোগী হিসেবে কাজ করতে যান। এই সুযোগগুলো আরও বাড়বে বলে মনে করি।

এ কে এম ফাহিম মাশরুর
এ কে এম ফাহিম মাশরুর

চাকরিতে অনেক সুযোগ তৈরিও হবে
এ কে এম ফাহিম মাশরুর
প্রধান নির্বাহী, বিডিজবস ডটকম

করোনার কারণে হঠাৎ চাকরি পাওয়া কঠিন হয়ে যাবে, তা তো নয়। আমাদের দেশে চাকরি আগেও কঠিন ছিল। সে জন্যই গত কয়েক বছরে অনেক তরুণ বেকার বসে না থেকে পাঠাও, উবার চালিয়ে কিংবা ‘ডেলিভারি সার্ভিস’ দিয়ে আয় করতে শুরু করেছেন। তাঁদের আমি সম্মান জানাই। কারণ, প্রচলিত ধারণা ভাঙতে তাঁরা সাহায্য করেছেন। বিদেশে গিয়ে কিন্তু আমাদের দেশের ছেলেমেয়েরাই রেস্টুরেন্টে কাজ করছেন, ট্যাক্সি চালাচ্ছেন। অথচ দেশে এ ধরনের কাজ অনেকে অসম্মানজনক মনে করে। আমার মনে হয়, এই দুর্যোগ আমাদের এ ধরনের মানসিক বাধা দূর করতে সাহায্য করবে। পরিস্থিতি যেহেতু বদলে গেছে, শুধু যে চাকরি কমে যাবে, তা নয়, অনেক সুযোগ তৈরিও হবে। কিন্তু সেভাবে মনকে তৈরি রাখতে হবে। আমি বিবিএ করেছি বলে আমাকে ব্যাংকের চাকরিই করতে হবে, এই মানসিকতা থাকলে হবে না। আমি একটা কিছু শুরু করব, সুযোগ বুঝে সামনে এগোব।

স্বাস্থ্য খাতে হয়তো আরও চাহিদা তৈরি হবে। এ ছাড়া অনলাইন মার্কেটিং, সোশ্যাল মিডিয়া মার্কেটিং, সার্চ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন, কনটেন্ট লেখা, এ রকম অনেক কাজের সুযোগ আরও বাড়তে পারে। সে জন্য এই সময়টা কাজে লাগিয়ে নিজেকে দক্ষ করতে হবে।

পারিসা শাকুর
পারিসা শাকুর

সেই সব দক্ষতা চর্চার সুযোগ, যা রোবটের নেই
পারিসা শাকুর
পরিচালক, স্টুডেন্ট অ্যাফেয়ার্স, নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি

নির্বিঘ্নে জীবন চলতে থাকলে মানুষের জীবনে একধরনের যান্ত্রিকতা চলে আসে। বড় কোনো বাধাই কিন্তু আমাদের সৃজনশীলতা, উদ্ভাবনী ভাবনা চর্চার সুযোগ করে দেয়। আমি যখন বড় হয়েছি, তখন বিকেলবেলা বাসার সবাই মিলে চা খেয়েছি, গল্প করেছি। আমার শিক্ষার্থীদের মধ্যে অনেকের কিন্তু এই অভিজ্ঞতা ছিল না। কারণ, ওদের সময় নেই। যেটুকু সময় ওরা পায়, সেটুকু শুধু নিজেকে নিয়ে ভাবে। সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেক দূরের কোনো বন্ধু না; আমার পরিবার, আমার প্রতিবেশী, আমার চারপাশের প্রতি আমার কী দায়িত্ব, সেই দায়িত্ব চর্চার সুযোগ করে দিয়েছে এই সময়।

সৃজনশীলতা ও সমানুভূতি খুব গুরুত্বপূর্ণ। এই দুই দক্ষতা কিন্তু রোবটের নেই। এসব মানবিক গুণ চর্চার সুযোগ এখন, যা ভবিষ্যতে আমাকে এগিয়ে রাখবে। সৃজনশীলতা, সমানুভূতি, যেকোনো পরিস্থিতিতে মানিয়ে নেওয়া, এসবের সঙ্গে আরও অনেক দক্ষতা সম্পৃক্ত। যেমন কেউ যদি এই সময়ে ঘরে বসে ইন্টারনেট দেখে দেখে গ্রাফিকস ডিজাইন, কোডিং কিংবা গিটার বাজানো শেখে, তার কিন্তু মনোযোগের চর্চাটাও হবে।

গ্রন্থনা: মো. সাইফুল্লাহ