৯০ বছরের ক্যানসারজয়ী রাজিয়া কি পারবেন করোনা জয় করতে?

রাজিয়া খাতুন।  ছবি: সংগৃহীত
রাজিয়া খাতুন। ছবি: সংগৃহীত

জরায়ুর মুখে থাকা টিউমারটা কখন ক্যানসারে রূপ নিয়েছিল টেরই পাননি রাজিয়া খাতুন। ১৯৬৫ সালে যখন প্রথম টিউমারটির অস্তিত্ব অনুভব করেছিলেন, সেভাবে পাত্তা দেননি তিনি। তা ছাড়া বাঙালি নারী বড় সংসার সামলে নিজের শরীরের প্রতি নজর দেওয়ার সময় কই। তাই অস্ত্রোপচার করার সময় বের করতে লেগে যায় তিন বছর। ১৯৬৮ সালে অস্ত্রোপচারের পর জানা যায় ক্যানসার বাসা বেঁধেছে শরীরে। তখনই ভেবেছিলেন এই বোধ হয় জীবনের শেষ। সব এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল। সে সময় তাঁর বয়স ছিল মাত্র ৩৮ বছর। সন্তানেরা তখনো খুব বড় হয়নি, বিশাল এক পরিবার সামলান। কীভাবে কী করবেন, ভেবে পাচ্ছিলেন না। তবে সব শঙ্কাকে দূরে ঠেলে চিকিৎসা নিলেন তিনি। ক্যানসার জয় করলেন। নতুনভাবে ফিরে এলেন সন্তানদের কাছে।

এই ৫২ বছরের জীবনে অনেক কিছু দেখেছেন, নানা ধরনের শারীরিক সমস্যায়ও ভুগেছেন রাজিয়া খাতুন। তবে নিয়ম মেনে চলা শরীর, পরিবারের মানুষদের যত্নে সব বাধাই পেরিয়েছেন সহজভাবে। এখন সন্তান ও তাঁর পরিবারের সঙ্গে ধানমন্ডিতে থাকেন, চমৎকারভাবে দিন কেটে যাচ্ছিল ৯০ বছরের এই বৃদ্ধার । তাই এবার যখন তাঁর করোনা ধরা পড়ল, ঘাবড়াননি তিনি। ১৩/১৪ দিন ধরে লড়াই করে চলেছেন করোনার বিরুদ্ধে।

গত ২০ মে মোহাম্মদপুরের কাঁচাবাজার থেকে ফিরেই ভালো অনুভব করছিলেন না রাজিয়া খাতুনের ছেলে মোজাম্মেল হক ভুঁইয়া। কেমন জানি জ্বর জ্বর অনুভব করছিলেন। করোনার সময় খুব জরুরি প্রয়োজন ছাড়া বাসা থেকে বের হন না। তার পরও শঙ্কাটা মন থেকে তাড়াতে পারছিলেন না। পরদিন জ্বরটা চলেই এল, সেই সঙ্গে হালকা কাশি। শুধু তাঁর নয়, মোজাম্মেল হকের স্ত্রী ও এক ছেলেরও জ্বর এল। বুঝতে পারলেন, করোনার এই সময়ে এটা মামুলি জ্বর নয়। আইইডিসিআরের এক চিকিৎসকের সঙ্গে পরিচয় থাকায় তাঁকে ফোন দেন। তিনি জানালেন, লোক পাঠাবেন। একদিন পর ২৩ মে নমুনা সংগ্রহের জন্য লোক আসেন। নমুনা নেওয়া হলো মোজাম্মেল হক ভুঁইয়া (৬০) ও তাঁর স্ত্রী (৫১), এক ছেলে (৩২) ও পুত্রবধূ (২৯) এবং নাতিসহ (১৬ মাস) মোট পাঁচজনের। পরদিন ২৪ মে ফলাফল এল, বাড়ির পাঁচজনেরই করোনা পজিটিভ।

এর মধ্যে সবার শঙ্কাকে সঠিক প্রমাণ করে ৯০ বছরের রাজিয়া খাতুনের শরীরেও করোনার লক্ষণ প্রকাশ পেল। সেই সঙ্গে মোজাম্মেল হকের ছোট ছেলে ও বাড়ির কাজের সহকর্মীর। এই তিনজনের পরীক্ষা করা হলো ২৬ মে। তিনজনেরও ফলাফল পজিটিভ। অর্থাৎ এই বাড়ির ৮ জন মানুষেরই করোনা পজিটিভ হলো। এর মধ্যে মোজাম্মেল হক ভুগছেন কাশি ও জ্বরে। স্ত্রী ও দুই ছেলের জ্বর ছিল প্রথম কয়েক দিন। পরে কমে যায়। বাড়ির ছোট্ট শিশুটির করোনা পজিটিভ হলেও লক্ষণ নেই কোনো। মোজাম্মেল হক ধারণা করছেন, কাঁচাবাজার থেকে করোনার সংক্রমণ হয়েছে তাঁর। তাঁর থেকে পরিবারের বাকিদের।

ঠান্ডা জ্বর খুব বেশি না থাকলেও রাজিয়া খাতুন প্রথমে ছেড়ে দিয়েছিলেন খাওয়া দাওয়া। একদম ঘুমাতে পারছিলেন না এই বৃদ্ধা। ঠিকমতো বলতেও পারছিলেন না কতটা কষ্ট হচ্ছে তাঁর। পরিবারের সদস্যরা নানাভাবে চেষ্টা করতে থাকেন তরল খাবার খাওয়াতে। কিছুই মুখে তুলছিলেন না। বুকে বেশ ব্যথা। আইইডিসিআরের পরামর্শ অনুযায়ী কিছু ওষুধ খাওয়ানো হয়। একটু একটু করে সুস্থ হতে থাকেন তিনি। ভাত থেকে শুরু করে সবকিছু ব্লেন্ড করে নরম করে তাঁকে খাওয়ানো হয়। এখনো সেভাবেই খাচ্ছেন। তবে শরীর খুব দুর্বল। আগের মতো হাঁটাহাঁটি করেন না। শুয়েই থাকেন বেশি।

করোনাভাইরাস সম্পর্কে আগেই ধারণা পেয়েছিলেন রাজিয়া খাতুন। গত মার্চে তাঁর ছেলে ও পুত্রবধূ সুইডেন থেকে ফেরার পর হজ ক্যাম্পে ১৪ দিনের কোয়ারেন্টিনে ছিলেন। তাই নতুন এই ভাইরাসের ভয়াবহতা সম্পর্কে ভালোই ধারণা ছিল তাঁর। পরিবারের সদস্যরা বললেন, সব বুঝলেও করোনা হয়েছে শুনে একটুও ঘাবড়াননি তিনি। বরং সহজভাবে নিয়েছেন সব শারীরিক কষ্ট।

বাড়ির সবার যখন করোনা ধরা পড়ল, বৃদ্ধা মাকে নিয়েই বেশি চিন্তিত হয়েছিলেন মোজাম্মেল হক। তিনি বলেন, ‘মায়ের অনেক ধরনের শারীরিক সমস্যা আছে। এমনিতেই নানা ধরনের চিকিৎসা নিতে হয়। একদম খাওয়াদাওয়া করেননি প্রথম কয়েক দিন। হাতে ক্যানুলা করে যে স্যালাইন দেব, সে উপায়ও খুঁজে পাইনি। তবে এখন কিছুটা সুস্থ।’

মোজাম্মেল হক জানালেন, শুরু থেকেই লক্ষণ বেশি ছিল তাঁর নিজের। বেশ শ্বাসকষ্ট হয়েছে। তিনি বলেন, ‘প্রথমে আইইডিসিআরের হেল্পলাইনে ফোন করলে চিকিৎসক কিছু ওষুধ ও পরামর্শ দিয়েছিলেন। তবে শ্বাসকষ্টের জন্য কোনো হাসপাতালে ভর্তির বিষয়ে কোনো পরামর্শই দেননি তাঁরা। আইইডিসিআরের হেল্পলাইনে ফোন দিলে একেক দিন একেক চিকিৎসক ধরেন। প্রতিবারই প্রত্যেককে পুরো বিষয়টি জানাতে হয়েছে। একেকজন একেক চিকিৎসার কথা বলেছেন। জরুরি অবস্থার সৃষ্টি হলে কোথায় যাব, এ নিয়ে কোনো কূল কিনারাই খুঁজে পাইনি এ কদিন।’ তিনি জানান, কেবল মনের জোর ধরে রেখেছিলেন পরিবারের সবাই। আর সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করছেন এই বিপদ থেকে মুক্তির। আশা করছেন বাড়ির সবাই মিলে করোনা জয় করবেন তাঁরা।

ধানমন্ডিতে তাঁদের ফ্ল্যাটটা ১৫ দিন ধরে পুরো বাড়ি থেকে বিচ্ছিন্ন। বাসার সবার করোনা হওয়ায় একে অপরকে নিজেরাই দেখে রাখছেন। বাড়িতে নিজেরা গরম পানি খাচ্ছেন। গরম পানির ভাব নিচ্ছেন নিয়মিত। একে অপরকে ওষুধ খাইয়ে দিচ্ছেন। রান্নাও করছেন মিলেমিশে। রাজিয়া খাতুনের আরেক ছেলে ধানমন্ডিতেই থাকেন, খাবারসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস তিনি সরবরাহ করছেন।

মোজাম্মেল হকের ছেলে আকিভ জাভেদ জানান, ‘শুরু থেকেই আমরা চেষ্টা করেছি একটু আলাদা আলাদা থাকতে। আমার ভাইয়ের ছোট্ট বাচ্চাটার করোনা পজিটিভ হলেও লক্ষণ তেমন নেই, ভাবিরও লক্ষণ কম। তাই তাঁদের বাড়ির অন্যদের থেকে একটু আলাদা রেখেছি। দাদিকে সবাই মিলে খাওয়ানোর চেষ্টা করছি। প্রথম কয়েক দিন একদম খাওয়ানো যায়নি। এখন কিছুটা ভালো।’

তবে করোনার এই সময়ে মানুষের ব্যবহারে খুব কষ্ট পাচ্ছেন মোজাম্মেল হক। তিনি বলেন, ‘ভাইয়ের পাঠানো জিনিসগুলো বাসার দারোয়ানেরা ছুড়ে দিয়ে চলে যায়। অথচ প্যাকেটগুলো আস্তে করেই রাখা যেত। মানুষের এই বোধের পরিবর্তন আনা উচিত। আমাদের করোনা হয়েছে। যে কারও হতে পারে।’