বিকজ ইট ইজ দেয়ার

জর্জ ম্যালোরি। ফাইল ছবি
জর্জ ম্যালোরি। ফাইল ছবি

তিব্বতে এভারেস্ট বেস-ক্যাম্পে আমি মোট তিনবার গিয়েছি (২০১০, ২০১১ ও ২০১৮ সালে)। এখানে রয়েছে কিংবদন্তি পর্বতারোহী জর্জ ম্যালোরির স্মৃতিফলক।

জর্জ ম্যালোরির প্রতি আমার সব সময় একটা অন্য রকম ভালো লাগা কাজ করে। প্রতিবারই বেস-ক্যাম্পে থাকাকালীন প্রায় প্রতিদিনই তাঁর স্মৃতিফলকের কাছে যেতাম। সেখানে গেলে ভালোবাসা ও শ্রদ্ধায় দেহ-মন ভরে যায় এবং অনেক অনুপ্রেরণা পেতাম। বিএমটিসির পক্ষ থেকে জর্জ ম্যালোরির স্মৃতিফলকে শ্রদ্ধা জানিয়ে কিছু সময় সেখানে নীরবে বসে ছিলাম। জর্জ ম্যালোরি ছিলেন পাইওনিয়ার ব্রিটিশ পর্বতারোহী। তিনি পৃথিবীর সব পর্বতারোহীর পথিকৃৎ ও একজন অনুপ্রেরণাদানকারী পর্বতারোহী। তাঁর সেই বিখ্যাত উক্তি, ‘বিকজ ইট ইজ দেয়ার’ এভারেস্ট সমান কিংবদন্তি।

জর্জ ম্যালোরি। ফাইল ছবি
জর্জ ম্যালোরি। ফাইল ছবি

জর্জ ম্যালোরি ১৮৮৬ সালের ১৮ জুন ইংল্যান্ডের ম্যানচেস্টারের কাছে চেশায়ারের ছোট গ্রাম মর্বালিতে জন্মগ্রহণ করেন। ছেলেবেলা থেকেই ম্যালোরি বিশ্বাস করতেন, পৃথিবীতে এমন কোনো উঁচু জায়গা থাকতেই পারে না, যা চড়া বা বেয়ে উঠা অসম্ভব। তিনি ২৪ বছর বয়সে শিক্ষকতা পেশায় যোগ দেন। তিনি মনে করতেন, যে শিক্ষাব্যবস্থায় প্রকৃতি পাঠ অবহেলিত, যা শিশুদের সুকুমার বৃত্তিগুলোকে বিকশিত করতে আদৌ মনোযোগী নয়, সৌন্দর্যচেতনা বৃদ্ধির কোনো উদ্যোগ যেখানে চোখে পড়ে না, তা দিয়ে সত্যিকারের ভালো মানুষ গড়ে তোলা নিতান্তই অসম্ভব। তিনি ১৯২১, ১৯২২ ও ১৯২৪ সালে পরপর তিনবার এভারেস্ট অভিযানে অংশ নেন। যে পর্বতে ম্যালোরিকে দেখেনি, তার পক্ষে কল্পনাও করা ছিল অসম্ভব, আপাত নিরীহ এই মানুষটিই পর্বতে কী সাংঘাতিক ক্ষিপ্র এবং সাবলীল উঠতে পারেন। পর্বতারোহণ ছিল তাঁর কাছে নিজস্ব সৌন্দর্য চেতনার প্রকাশ। বিরলতম অসাধারণ নিসর্গের মধ্যে চলতে চলতে নিজেকে নতুন নতুন উপলব্ধির আলোয় আবিষ্কার করা। পর্বতে ওঠা তাঁর কাছে ছন্দময় এক শিল্পকর্ম। যে ছন্দের আঙিনায় প্রবেশ করলেই তিনি নিজেকে সার্থক, আনন্দিত, পূর্ণ মনে করতেন।

জর্জ ম্যালোরি ও এ্যান্ড্রু আরভিন। ফাইল ছবি
জর্জ ম্যালোরি ও এ্যান্ড্রু আরভিন। ফাইল ছবি

এভারেস্টে তাঁর তৃতীয় অভিযানের সময় ১৯২৪ সালের ৮ জুন বেলা ১২:৫০টায় তাঁকে ও সঙ্গী এ্যান্ড্রু আরভিনকে শেষবারের মতো দেখা যায় শিখর থেকে ৮০০ ফুট নিচে। মাত্র ৩৮ বছর বয়সে এভারেস্টের চিরশ্রেষ্ঠ প্রতিদ্বন্দ্বী চিরতরে হারিয়ে যান সেই এভারেস্টেই। ৭৫ বছর পর ১৯৯৯ সালের ১ মে অনুসন্ধানকারী আমেরিকার পর্বতারোহী দল তাঁর মৃতদেহ খুঁজে পায় চূড়া থেকে কিছুটা নিচে। অনুসন্ধানকারী দলের সবাই মিলে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেন জর্জ ম্যালোরির দেহ নামিয়ে না আনার। তাঁরা ভাবলেন, সারা জীবন তো বটেই এমনকি মৃত্যুর পরেও যিনি ছেড়ে দেননি মাউন্ট এভারেস্টকে, অন্তিম নিশ্বাসেও যিনি আঁকড়ে ধরে ছিলেন তাঁর প্রিয়তমা চুমলাংমাকে, কী লাভ তাঁর শান্তি বিঘ্নিত করে? জর্জ ম্যালোরির শরীরের ভঙ্গিটির মধ্যে মিলেমিশে একাকার অভিমান, লড়াই আর ভালোবাসা! যেন বলতে চাইছেন,

‘নাই বা ডাকো রইব তোমার
মুখ ফিরালে ফিরব না এইবারে।’

- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

জর্জ ম্যালোরি ও রুথ ম্যালোরি। ছবি: ফাইল ছবি
জর্জ ম্যালোরি ও রুথ ম্যালোরি। ছবি: ফাইল ছবি

ম্যালোরি এভারেস্টে আরোহণ করেছিলেন, কী করেননি, সেই প্রশ্নের সমাধান আজও পাওয়া যায়নি। তবে অনুসন্ধানকারী পর্বতারোহীরা তাঁর বুক পকেটে থাকা স্ত্রী রুথ ম্যালোরর আলোকচিত্রটি খুঁজে পাননি। প্রিয়তমা স্ত্রীকে কথা দিয়েছিলেন মাউন্ট এভারেস্ট শীর্ষে তাঁর ছবি রেখে আসবেন। রুথ ও ম্যালোরি পরস্পরকে পাগলের মতো ভালোবাসতেন। ভেনিসে প্রেম নিবেদনের দিন থেকে দাম্পত্যের শেষ দিন পর্যন্ত ভালোবাসায় কখনো ঘাটতি পড়েনি তাঁদের। মাত্র ১০ বছরের জন্য স্থায়ী হয়েছিল তাঁদের সম্পর্ক। এই ১০ বছরের বিবাহিত জীবন রঙে-রসে ভরে উঠেছিল। পরস্পরের প্রতি সত্যিকারের ভালোবাসায় আর টানে কানায় কানায় পূর্ণ ছিল সংসার। কিন্তু বুক পকেটে রুথের আলোকচিত্রটি না পাওয়ার থেকে যেটা পাওয়া জরুরি ছিল, সামারভেলের দেওয়া কোডাক ভেস্ট পকেট ক্যামেরাটা। নেগেটিভসহ ক্যামেরাটা পকেটবন্দী করে হয়তো চিরনিদ্রায় শায়িত আরভিন। যদি আরভিনের দেহটা খুঁজে পাওয়া যায়, তবে ক্যামেরাটাও পাওয়া যাবে।

তিব্বতে এভারেস্ট বেস-ক্যাম্পে জর্জ ম্যালোরির স্মৃতিফলকের পাশে এম এ মুহিত। ছবি: সংগৃহীত
তিব্বতে এভারেস্ট বেস-ক্যাম্পে জর্জ ম্যালোরির স্মৃতিফলকের পাশে এম এ মুহিত। ছবি: সংগৃহীত

তখন ক্যামেরার নেগেটিভ ডেভেলপ করে দেখা যাবে যে জর্জ ম্যালোরি দাঁড়িয়ে আছেন এভারেস্ট শীর্ষে, দু-হাত আকাশের দিকে তুলে। মুখ উদ্ভাসিত বিজয়ীর হাসিতে। হয়তো বা চোখের কোণ চিক চিক করছে আনন্দে।

*এম এ মুহিত, দুইবার এভারেস্ট বিজয়ী একমাত্র বাংলাদেশি