মহামারি থেকে মানবতার শিক্ষা

অমিত চাকমা। ছবি: সংগৃহীত
অমিত চাকমা। ছবি: সংগৃহীত

অস্ট্রেলিয়ার বাইরে, খোলা প্রান্তরে কালো রাজহাঁস খুব কমই দেখা যায়। এটি এক বিরল প্রজাতি। তাই বিরল, অবিশ্বাস্য কোনো ঘটনা থেকে যখন বিপর্যয়ের আশঙ্কা তৈরি হয়, তাকে বলা হয় ‘ব্ল্যাক সোয়ান ইভেন্ট’। আমরা আজ যে কোভিড–১৯ মহামারির মধ্য দিয়ে যাচ্ছি, তা একটি ‘কালো রাজহাঁস ঘটনার’ সমতুল্য। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত, এই মহামারি সম্পর্কে অনেক কিছু অজানাই থেকে যাবে। বিশ্বের বিজ্ঞানী সম্প্রদায়ের প্রচেষ্টায় আমরা যদিও কিছু কিছু জেনেছি—তবু অনেকটা অন্ধকারেই রয়ে গেছি। এটি আমাদের নিজেদের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে সচেতন করে তুলবে বলেই আমার প্রত্যাশা। এখন আমাদের অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন নিয়ে গভীরভাবে ভাবা দরকার। মানুষ হিসেবে আমরা কারা? মানবতা বলতে আমরা কী বুঝি? আমাদের জীবনযাত্রার লক্ষ্য কী? পরস্পরের সঙ্গে আমাদের আচরণ কেমন হওয়া উচিত?

আমরা কীভাবে এই ধরনের গভীর ও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উত্তর পেতে পারি? সব প্রশ্নের উত্তর আমার কাছে নেই। তবে একজন শিক্ষক হিসেবে আমার দৃষ্টিভঙ্গী, সীমিত জ্ঞান শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নেওয়া আমার কর্তব্য। সামাজিক প্রভাবের প্রেক্ষাপটে আমাদের তরুণ শিক্ষার্থীদের ওপর মহামারিটির প্রভাব সম্পর্কে আমি আমার মতামত তুলে ধরব। সেই সঙ্গে শিক্ষার্থীদের জীবনযাত্রায় সহায়তার উদ্দেশ্যে একটি ‘নৈতিক কম্পাস’ বা মানভিত্তিক দিকনির্দেশনা দেওয়ার চেষ্টা করব।

প্রথমেই স্পষ্টভাবে বলব, আমরা যে অনিশ্চয়তার মুখোমুখি হয়েছি, তা সত্ত্বেও আপনাদের ভবিষ্যত উজ্জ্বল, যদি আপনারা তা তৈরি করে নিতে পারেন। যুক্তরাষ্ট্র যখন মহামন্দার শীর্ষে ছিল এবং যখন লাখ লাখ মানুষ অনেক কষ্ট সহ্য করে দুর্বিষহ দিন কাটাচ্ছিলেন, তখন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট এই বলে জনগণের কাছে আশা নিয়ে এসেছিলেন, ‘আমাদের কেবল ভয় পাওয়ার বিষয়টাই ভয়’। এই সুন্দর কথা যথাযথভাবে আজও প্রযোজ্য। আমরা মানবজাতি হিসেবে এর আগে অনেক দুর্গতি পেরিয়ে এসেছি। তাই আমরা এই সঙ্কট থেকে বেরিয়ে আসার পথও খুঁজে পাব—এতে আমার কোনো সন্দেহ নাই। প্রতিবন্ধকতাগুলো কাটিয়ে ওঠার জন্য যা করনীয়, তা বাস্তবে রূপ দিতে নিজেকে প্রস্তুত করতে হবে। আপনারা যাঁরা আজকের তরুণ, তাঁরাই এই নতুন যাত্রায় সামনের সারিতে থাকবেন।

মারাত্মক ভাইরাসের সংক্রামক প্রভাব সম্পর্কে আমাদের অজ্ঞতা এই করোনাভাইরাস সামাল দিতে গিয়ে প্রকাশ পেয়েছে। উন্নত দেশগুলোর নেতারা ও উচ্চশিক্ষিত মানুষজনের বেলায়ও এমনটা দেখা গেছে। যখন শত শত মানুষ ইতালিতে মারা যাচ্ছিলেন, তখনও অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন ভাইরাসের হুমকিকে গুরুত্ব সহকারে নেননি। যার ফলে প্রাণ হারিয়েছেন হাজার হাজার ব্রিটিশ নাগরিক। বরিস জনসন নিজেও ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ভেবেছিলেন, এই ভাইরাস যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছাবে না। আজ বিশ্বের এই উন্নত দেশে প্রাণহানি হয়েছে সবচেয়ে বেশি। ফ্লোরিডার সৈকতগুলো মার্চ মাসে তরুণদের ভিড়ে জমজমাট ছিল। তাঁদের অনেকেই বিশ্বাসী ছিল যে তরুণেরা ভাইরাসে আক্রান্ত হবেন না। কিন্তু পরে দেখা গেল অনেক তরুণই এই ভাইরাসের আক্রমণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।

কোনো পরিস্থিতিতেই অজ্ঞতা মঙ্গল বয়ে আনে না। দুর্ভাগ্যক্রমে, আমরা নিজেদের সামনে দেখতে পাচ্ছি, কীভাবে অজ্ঞতার কারণে হাজার হাজার মানুষের প্রাণহানি হচ্ছে। আমরা কীভাবে এর পরিবর্তন করব? আমাদের সত্যিকার অর্থে শিক্ষিত হতে হবে। শুধু ডিগ্রিধারী হলেই শিক্ষিত হয় না। ভালো–মন্দের যাচাই করার, বিবেচনা করার যোগ্যতা; তথ্য, পরিস্থিতি খুঁটিয়ে বিশ্লেষণ করার এবং সঠিক তথ্যের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারার সক্ষমতা—সত্যিকার অর্থে শিক্ষিত ব্যাক্তিদের অলংকার। এসব গুণাবলী শুধু অর্জন করলে হবে না, এদের বাস্তবে কার্যকরী করতে হবে। যাঁরা উচ্চশিক্ষা অর্জন করে সমাজের উচ্চ আসনে আসীন, তাঁরা যদি দুর্নীতি করে আয় করতে দ্বিধাবোধই না করেন, তাহলে বুঝতে হবে যে তাঁরা সঠিক শিক্ষা পাননি। রোগীর সেবা করার শপথ নিয়ে যিনি ডাক্তারি প্রশিক্ষণ পেয়েছেন, তিনি যখন করোনা রোগীকে চিকিৎসা করতে অপারগতা প্রকাশ করেন, তখন বুঝতে হবে তাঁর শিক্ষা যথার্থ হয়নি।

নিজেকে সত্যিকার অর্থে শিক্ষিত করুন, অন্যদের শিক্ষার আলোতে আলোকিত করুন, জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠন করুন। বিজ্ঞানের বিষয় সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করুন। অজ্ঞতা বিপজ্জনক। সংকট থেকে মুক্তি পেতে এবং উজ্জ্বল ভবিষ্যত গঠনের জন্য আমাদের জ্ঞান ও প্রজ্ঞার ওপর নির্ভর করতে হবে। অজ্ঞতার আঁধার মুছে দিতে হবে জ্ঞানের মশাল জ্বালিয়ে। কে বহন করবে এই জ্ঞানের মশাল? সেই কর্তব্য আপনাদের মতো তরুণ শিক্ষানবিশদের ওপরই বর্তেছে। আপনারা আমাদের ভবিষ্যত। মানবতার ভবিষ্যত আপনাদের হাতে। প্রস্তুতি নিন, এই বিশ্বের এখন আপনাকে খুব প্রয়োজন। আমরা পুরোনো প্রজন্ম আপনাদের দিকেই অনেক আশা নিয়ে তাকিয়ে আছি।

আপনাদের জ্ঞান অর্জনের যাত্রা সফল হোক, সবার মঙ্গল হোক।

অমিত চাকমা: অমিত চাকমার জন্ম রাঙামাটিতে, ১৯৫৯ সালে। দীর্ঘদিন কানাডার ইউনিভার্সিটি অব ওয়েস্টার্ন অন্টারিওর উপাচার্য ও প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। সম্প্রতি ইউনিভার্সিটি অব ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়ার উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫০তম সমাবর্তনের বক্তা ছিলেন তিনি। সেই অনুষ্ঠানে তাঁকে সম্মানসূচক ডক্টর অব সায়েন্স ডিগ্রি দেওয়া হয়।

প্রকৃত শিক্ষা ও সনদ ভিত্তিক শিক্ষা বিষয়ে অমিত চাকমার লেখা পড়ুন স্বপ্ন নিয়ের আগামী সংখ্যায়।