যৌথ রান্নাঘরের রসদ ফুরিয়ে আসছে

রান্নার রসদ ফুরিয়ে আসায় ডাল আর আলু ভর্তাই ভরসা।  ছবি প্রথম আলো
রান্নার রসদ ফুরিয়ে আসায় ডাল আর আলু ভর্তাই ভরসা। ছবি প্রথম আলো

বাগার দেওয়া মসুরের ডাল, শর্ষের তেলের ঝাল আলুভর্তা আর মোটা চালের গরম ভাত। দুপুরের খাবারের মেনুতে এর বাইরে আর কিছু নেই। তবে যে মানুষগুলো লাইনে দাঁড়িয়ে বাটি, ডিশ বা পাতিলে করে খাবারগুলো নিচ্ছেন, তাঁদের চোখে-মুখে তৃপ্তি আর কৃতজ্ঞতার প্রকাশ। এই খাবারেই পরিবারের সদস্যরা ভরপেট খাবে, খাওয়ার পর বাড়তি থাকলে তা দিয়ে হয়তো আরেক বেলাও চালিয়ে দেওয়া যাবে। দুই মাসের বেশি সময় ধরে এভাবেই দুপুরের রান্না করা খাবার নিচ্ছে ১০০টি নিম্ন আয়ের পরিবারের সদস্যরা।

রাজধানীর আফতাবনগরে গিয়ে এ দৃশ্য দেখা যায়। খালি জায়গায় অস্থায়ী চুলাতেই চলছে রান্না। আর রান্নার কাজে নারী-পুরুষ সবাই হাত লাগিয়েছেন। এই রান্না করা খাবারের উদ্যোক্তা সংস্কৃতিকর্মী ইশরাত শিউলি পুরো সময়টাতেই খাবারের তদারকি করছিলেন। ডাল বাগার বা আলু ছিলতে যাঁরা ব্যস্ত ছিলেন, তাঁদের সঙ্গে ইশরাত কোন গাছে ছাই দিতে হবে, কোন জায়গায় বীজ লাগাতে হবে, এসব দরকারি কথাও সেরে নিচ্ছিলেন। এই সদস্যরা যেমন একসঙ্গে রান্না করেন, তেমন একসঙ্গে চাষাবাদ করে শাক-সবজি ফলাচ্ছেন। এই শাক-সবজিই পরে খাবারের মেনুতে যোগ হয়।

করোনাভাইরাসের বিস্তারে নিম্ন আয়ের মানুষের কাজ নেই। বেতন নেই। এই অবস্থায় এক বেলা খাবারের নিশ্চয়তা পরিবারগুলোর কাছে অনেক বড় পাওয়া।

ইশরাত সমগীত সংস্কৃতি প্রাঙ্গণ নামের একটি সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত। নাটক, ডকুমেন্টারি ও সিনেমা বানানোর পাশাপাশি আবৃত্তিকার হিসেবেও তিনি পরিচিত।

জানালেন, তিনি যেহেতু সমগীতের সদস্য, তাই তিনি তাঁর উদ্যোগের নাম দিয়েছেন ‘সমগীত যৌথ রান্নাঘরে সমগীত যৌথ খেত-খামার’। তিনি তাঁর ফ্ল্যাটের আশপাশের নিম্ন আয়ের ১০০টি পরিবারকে নিয়েই যৌথ রান্নাঘরের কার্যক্রম চালাচ্ছেন।

ইশরাত। ছবিঃ প্রথম আলো
ইশরাত। ছবিঃ প্রথম আলো

ইশরাত জানালেন, শুরুতে উদ্যোগটি তিনি নিজে শুরু করলেও বর্তমানে বীথি ঘোষ, জায়ান হাসান চৌধুরীর, নাহিদ নজরুল, হাসিবা আলী, মার্জিয়া প্রভাসহ অনেক বন্ধু, স্বজন, সমগীতের অন্যান্য সদস্য এগিয়ে এসেছেন। আফতাবনগরে অনেক মালিক এখনো বাড়ি বানাননি, বাউন্ডারি দেওয়া জায়গা খালি পড়ে আছে। মালিকদের সঙ্গে কথা বলে খালি জায়গায় নিম্ন আয়ের মানুষ যৌথভাবে চাষাবাদ করছেন। মূলত মালিক, বন্ধু, স্বজনদের সহযোগিতায় এগিয়ে চলছে কার্যক্রম। তবে সহায়তাকারীদের অনেকেই এখন নিজেরাই সমস্যার মধ্যে আছেন। ফলে চাল, তেল, নুন কেনার সহযোগিতা কমে এসেছে। দুদিন রান্না বন্ধও ছিল।

ইশরাত বললেন, ‘শুরুতে আমাদের রান্নাঘরের রসদ ছিল প্রচুর। তেহারি, ডিম, মাংস, সেমাইও রান্না হয়েছে আগে। কিন্তু তা আস্তে আস্তে কমছে। ডাল, আলুভর্তা বা শাক দিয়েই চালানো হচ্ছে বেশির ভাগ সময়। তারপরও সবাই মিলে ভাগ করে একবেলা খেয়ে হলেও বাঁচার চেষ্টা চালানো হচ্ছে।’

ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন ইশরাত। বললেন, মানুষের জন্য, শিশুদের জন্য কিছু একটা করার যে ইচ্ছা ছিল, করোনা এসে সেই সুযোগ করে দিয়েছে। বেকার বসে থাকা নারীদের দিয়ে হাতে ভাজা মুড়ি বানিয়ে তা এলাকায় বিক্রি করা, শিশুদের আদর্শ লিপি পড়ানোসহ বিভিন্ন পরিকল্পনার কথা জানালেন এ উদ্যোক্তা।

ইশরাতের পরিবারের সদস্যরা এ কাজে বাধা দেন না; শুধু নিজে যাতে করোনাভাইরাসে সংক্রমিত না হন, সে জন্য সতর্ক থাকতে বলেন। ফ্ল্যাটের বাসিন্দা ইশরাত আর টিন বা ছাপড়া ঘরে থাকা নিম্ন আয়ের মানুষের মধ্যে বন্ধুত্ব তৈরি হয়েছে। খাবার নিতে আসা এক নারী ছোট একটি প্লাস্টিকের বাটি ইশরাতের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন, ‘আপা, আপনার জন্য কচুশাক রান্না করে আনছি, খাইবেন কিন্তু।’