'গৃহকর্মী'রা মাস্ক বানাচ্ছেন

গৃহকর্মীদের বানানো মাস্ক পরেছেন সাদিয়া নাসরিন।  ছবি: সংগৃহীত
গৃহকর্মীদের বানানো মাস্ক পরেছেন সাদিয়া নাসরিন। ছবি: সংগৃহীত

রাজধানীর কড়াইল বস্তিতেই ২৮ বছর বয়সী জুলিয়ার জন্ম, বিয়ে, সংসার। এখন তিনি দুই সন্তানের মা। ছোটটার বয়স মাত্র ১৫ মাস। রাজধানীতে করোনাভাইরাস বিস্তারের আগে জুলিয়া কয়েকটি বাসায় ‘ছুটা বুয়া’ হিসেবে কাজ করে পেতেন ছয় হাজার টাকা। আর স্বামী পিকআপ ভ্যান চালিয়ে পেতেন আট হাজার টাকা। দুজনের আয়ে ঘরভাড়া তিন হাজার টাকা, ছোট সন্তানের জন্য মাসে দুই কৌটা গুঁড়া দুধ কেনা, শাশুড়িসহ পরিবারের পাঁচজনের খাওয়া-পরা হয়ে যেত। তবে মার্চের শেষ সপ্তাহ থেকে সরকারের সাধারণ ছুটি, লকডাউনে জুলিয়া ও তাঁর স্বামীর কাজ বন্ধ হয়ে যায়। তিন বেলার খাবার এক বেলায় নামিয়ে আনতে হয়। না খেয়ে থাকার অভিজ্ঞতাও হয়েছে। কিন্তু হাত পাতার তো অভ্যাস নেই। ঘরে অভাব থাকলে যা হয়—জুলিয়া স্বামীর হাতে মার খেয়ে ছোট সন্তানকে নিয়ে ঘর থেকে বেরও হয়ে গিয়েছিলেন। পরে আবার ফিরেছেন সংসারে।

তবে এক মাসের বেশি সময় ধরে জুলিয়া কাপড়ের মাস্ক বানানোর কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। হেলপার হিসেবে কাজ করে চার ঘণ্টায় দিনে ২০০ টাকা নিয়ে ঘরে ফিরছেন।

রাজধানীর বনানীতে গত ১৭ মে থেকে জুলিয়ার মতো লকডাউনে কাজ হারানো গৃহকর্মীরা এখন গেঞ্জি কাপড়ের মাস্ক বানাচ্ছেন। আর এ সুযোগ করে দিয়েছেন সংযোগ বাংলাদেশ নামের বেসরকারি একটি সংস্থা। আর এই ৫০ নারী ঢাকা ও টঙ্গীর বিভিন্ন বস্তিতে পরিচালিত সংস্থাটির ‘আলোর পথে’ কমিউনিটি স্কুলের শিক্ষার্থীদের মা। মোট ১৫০টি শিক্ষার্থী পরিবার থেকে ৫০ জন নারীকে মাস্ক বানানোর কাজের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে। এখন এই নারীরা নিজেদের ‘কর্মী’ বলে পরিচয় দেন। জানালেন, মাস্ক বানানোর কাজ করে সম্মান পাচ্ছেন। ভালো মজুরি পাচ্ছেন। এই নারীরা গৃহশ্রমিক হিসেবে আর কাজ করতে চান না।

সম্প্রতি সংযোগ বাংলাদেশের অফিসে গিয়ে কথা হয় এই নারীদের সঙ্গে। সংস্থার নিজস্ব পাঁচটি মেশিনে পাঁচজন অপারেটর ও তাঁদের সঙ্গে হেলপার হিসেবে অন্য নারীরা কাজ করছেন। আর টঙ্গীর কাছে ভাড়া করা জায়গায় ভাড়া করা সাতটি মেশিনে কাজ করছেন অন্য নারীরা। সকাল থেকে রাত আটটা পর্যন্ত কয়েকটি শিফটে কাজ করেন তাঁরা।

মাস্কের আড়ালে মুখ ঢেকে জুলিয়া বললেন, ‘আগে একেক বেলায় চাউল লাগত দেড় কেজি। এখন অল্প অল্প কইরা রাইন্ধ্যা তিন বেলাই খাইতে পারতেছি। এ টাকা থেইক্যা জমাইয়্যা ঘরভাড়া শোধ করতাছি।’

 সংযোগ বাংলাদেশের প্রধান নির্বাহী সাদিয়া নাসরিন বললেন, একটি মাস্ক তৈরিতে তিনজন অপারেটর কাজ করেন। একেকটা মাস্কের জন্য তাঁরা পান সাত টাকা। এ হিসাবে একেকজনের কাছে গড়ে দিনে ৫০০ টাকার মতো থাকে। এই নারীরা এ পর্যন্ত ৭২ হাজার পিস মাস্ক তৈরি করে ফেলেছেন। সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও প্রতিষ্ঠান, বেসরকারি সংস্থাসহ আমেরিকা, লন্ডন, কানাডা আর কলকাতায় পৌঁছে গেছে নারীদের তৈরি এ মাস্ক। এই মাস্ক বিক্রির লভ্যাংশের ৩০ ভাগ সরাসরি পাচ্ছেন অপারেটর হিসেবে কর্মরত নারীরা।

সাদিয়া বলেন, ‘ এ মাস্ক সাধারণ মানুষের ব্যবহারের জন্য। এটি হাসপাতালে চিকিৎসকসহ স্বাস্থ্যকর্মীদের ব্যবহারের জন্য নয়।’

সাদিয়া আরও বলেন, ‘কাপড়ের মাস্ক ধুয়ে অনেক দিন পর্যন্ত ব্যবহার করতে পারছেন। ২০ থেকে ৩০ টাকার মধ্যে লাল, সাদা, কালো, কমলাসহ বিভিন্ন রঙের মাস্ক কিনতে পারছেন। আর এটি করোনাভাইরাস বিস্তার রোধে প্রায় ৯৫ ভাগ ক্ষেত্রেই ড্রপলেট আটকাতে সক্ষম।’