তাঁদের লড়াই কোভিডের বিরুদ্ধে

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এক হবু মা এসেছেন চিকিৎসার জন্য। একজন স্বাস্থ্যকর্মী ওই মাকে দেখছেন৷  ছবি: সাজিদ হোসেন
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এক হবু মা এসেছেন চিকিৎসার জন্য। একজন স্বাস্থ্যকর্মী ওই মাকে দেখছেন৷ ছবি: সাজিদ হোসেন

রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জ্যেষ্ঠ স্টাফ নার্স ইসরাত জাহান দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে কোভিড-১৯–এ আক্রান্ত হন। তাঁর থেকে সংক্রমণ ছড়িয়ে দুই শিশুসন্তান ও স্বামীও আক্রান্ত হন। ইসরাত সুস্থ হয়ে গত ৩০ মে হাসপাতালের করোনা ইউনিটে আবার যোগ দিয়েছেন।

 ইসরাত বললেন, ‘নিজেকে যুদ্ধজয়ী সৈনিকের মতো মনে হয়। কাজে ফিরে আসার পর কোভিড রোগীদের কষ্ট আরও বেশি করে উপলব্ধি করতে পারছি। ভয় না পেয়ে এগিয়ে যাই তাঁদের দিকে।’

কোভিড-১৯–এ আক্রান্ত হওয়ায় আট মাসের সন্তানকে ১৪ দিন কোলে তুলে নিতে পারেননি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের স্ত্রীরোগ ও প্রসূতি বিভাগের চিকিৎসক জাকিয়া আক্তার। সন্তানের কান্না শুনে ঘরের বন্ধ দরজার ওপাশ থেকে ছটফট করতেন শুধু। ২৩ মে তিনি আবার কাজে ফিরেছেন।

কোভিড-১৯ ঘোষিত ঢাকা মহানগর জেনারেল হাসপাতালের আয়া ফাল্গুনি ইসলাম করোনা ইউনিটে কাজ করছেন বাড়ি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে। গত ২৫ এপ্রিল থেকে ঢাকার কাঁটাবনে অবস্থিত জাতীয় পরিকল্পনা ও উন্নয়ন একাডেমির ডরমিটরি থেকে আসা-যাওয়া করছেন কর্মস্থলে।

এমন কত শত গল্প যে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে রয়েছে সম্মুখ সারির এই যোদ্ধা বা ফ্রন্টলাইনারদের। তাঁরা লড়ছেন, আক্রান্ত হচ্ছেন, সুস্থ হচ্ছেন, আবার উঠে ছুটছেন। তাঁদের কেউ কেউ এ লড়াইয়ে প্রাণ দিচ্ছেন। সহযোদ্ধাদের মৃত্যুতে কপোল গড়িয়ে পড়া অশ্রু দুহাতে মুছে আবার হাত বাড়িয়ে ধরছেন রোগীদের।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) বলছে, সমাজের মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও উন্নয়নকাজে নিযুক্ত ব্যক্তিরাই হচ্ছেন স্বাস্থ্যকর্মী। এ দলে রয়েছেন চিকিৎসক, নার্স (নারী-পুরুষ), মেডিকেল টেকনোলজিস্টসহ অন্যান্য সেবাদানকারী কর্মীরা। স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয় প্রকাশিত ‘বাংলাদেশ স্বাস্থ্য জনবল কৌশলপত্র ২০১৫’ অনুসারে, দেশে স্বাস্থ্য খাতের মোট জনবল সাড়ে তিন লাখ। গত মার্চ মাস থেকে দেশে ফ্রন্টলাইনার চিকিৎসক, নার্সসহ স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের হার বাড়ছে।

বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) তথ্য অনুসারে এ পর্যন্ত (২৩ জুন) দেশে ৩ হাজার ৭১৪ জন স্বাস্থ্যকর্মী আক্রান্ত হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে চিকিৎসক ১ হাজার ১৪৩ জন এবং নার্স ১ হাজার ২৩ জন। চিকিৎসকদের মধ্যে কোভিড-১৯ আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ৪০ জন এবং উপসর্গ নিয়ে মারা গেছেন ৫ জন। ১৮ জুন প্রথম আলো কোভিড-১৯ আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া চিকিৎসক, নার্স, আয়াসহ ৪৮ জন স্বাস্থ্যকর্মীর ছবি প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশ করে শ্রদ্ধা জানিয়েছে। এঁদের মধ্যে পাঁচজন নারী চিকিৎসক এবং চারজন নারী নার্স ও আয়া ছিলেন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক নাসিমা সুলতানা বলেছেন, স্বাস্থ্যকর্মীরা নিজেরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অন্যের জীবন বাঁচাচ্ছেন। দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে নিজেরাও অনেক সময় আক্রান্ত হচ্ছেন। স্বাস্থ্যকর্মীদেরও স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করতে হবে। স্বাস্থ্যকর্মীদের কাজের ধরন অনুযায়ী পিপিই সরবরাহ করা হচ্ছে। এখন পিপিইর সংকট কমে গেছে।

সাহসের সঙ্গে লড়ছেন স্বাস্থ্যকর্মীরা

মহামারির সঙ্গে স্বাস্থ্যকর্মীদের লড়াই নতুন ঘটনা নয়। মহামারির আতঙ্ক, অবিশ্বাস আর অনিশ্চয়তার মধ্যে আশা জিইয়ে রাখার ঘটনা আগেও ঘটিয়েছেন স্বাস্থ্যকর্মীরা। স্বাস্থ্যকর্মীদের সাহসিকতার গল্প এলে নিশ্চিতভাবে চোখের সামনে ভেসে ওঠে নাইনটি থ্রি ডেজ সিনেমার কথা। ২০১৪ সালে নাইজেরিয়ায় ইবোলা প্রাদুর্ভাবে কীভাবে প্রাণ দিয়ে স্বাস্থ্যকর্মীরা ল্যাগোস শহরে রোগটির সংক্রমণ ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়া ঠেকিয়েছিলেন, সেই গল্প বলা হয়েছে সিনেমাটিতে।

করোনাভাইরাসের কারণে রাতারাতি পাল্টে যাওয়া চেনা পরিবেশকে ফিরিয়ে আনার কঠিন লড়াইয়ের বড় ভার এখন স্বাস্থ্যকর্মীদের ঘাড়ে।

বিডিএফের পরিচালক (ট্রাস্ট) এবং নেত্রকোনার খালিয়াজুরী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসক মিলি দে বলেন, মূলত আক্রান্ত রোগীদের কাছাকাছি যাওয়ার কারণেই চিকিৎসকেরা আক্রান্ত হচ্ছেন। অ্যানেসথেশিয়ার চিকিৎসকেরা বেশি ঝুঁকিতে। কারণ, সংকটাপন্ন রোগীদের খুব কাছাকাছি তাঁদের যেতেই হয়।

বাংলাদেশ নার্সেস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি (বিএনএ) ইসমত আরা পারভীন বলেছেন, প্রতিদিন ঝুঁকি নিয়ে নার্সরা রোগীদের সেবা দিয়ে যাচ্ছেন।

বাংলাদেশে কোভিড-১৯–এর প্রভাব নিয়ে জাতিসংঘের নারীবিষয়ক সংস্থা ইউএন উইমেনের লিঙ্গভিত্তিক বিশ্লেষণবিষয়ক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে ৯৪ শতাংশের বেশি নার্স এবং ৯০ শতাংশের বেশি কমিউনিটি স্বাস্থ্যকর্মী নারী। তাঁরা সংক্রমণের ঝুঁকিতে রয়েছেন। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নারী স্বাস্থ্যকর্মীদের কর্মক্ষেত্রে কাজের চাপ সামলানোর পাশাপাশি সন্তান পালনসহ পারিবারিক দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে। ফলে এই কর্মীদের শারীরিক নিরাপত্তার পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টিতেও চাপ পড়ছে।

করোনাভাইরাস বিস্তারের সময়ও স্বাস্থ্যকর্মীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে বারবারই সব দেশের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। ২৮ এপ্রিল সংস্থাটি বলেছে, স্বাস্থ্যকর্মীরা সংক্রমণের ঝুঁকির পাশাপাশি দীর্ঘ কর্মঘণ্টার ক্লান্তি ও মানসিক চাপের মধ্যে রয়েছেন। তাঁরা শারীরিক ও মনস্তাত্ত্বিক সমস্যারও মুখোমুখি হচ্ছেন।

মার্কিন নারী চিকিৎসক লরনা ব্রিন (৪৯) গত ২৬ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়ায় বোনের বাসায় আত্মহত্যা করেন। পরিবারের বক্তব্য তুলে ধরে সিএনএন জানায়, লরনা নিউইয়র্কে হাসপাতালে জরুরি বিভাগের দায়িত্ব পালন করা অবস্থায় কোভিড-১৯–এ আক্রান্ত হন। সুস্থ হয়ে কাজে ফিরলেও সহকর্মীদের কাছে ১৮ ঘণ্টার ডিউটি, ক্লান্তিতে হলওয়েতে ঘুমিয়ে পড়া, আক্রান্ত রোগীদের আধিক্য নিয়ে মানসিক চাপ বোধ করার কথা প্রায়ই বলতেন। পরিবারের মতে, এই চাপই তাঁকে আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দিয়েছে।

করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে স্বাস্থ্যকর্মীদের লড়াইয়ের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে সারা বিশ্ব আজ স্যালুট জানায় তাঁদের। সবার প্রত্যাশা, স্বাস্থ্যকর্মীদের সাহসিকতাই এ লড়াইয়ে জয়ী করবে বিশ্বকে।