আমার রবিউল ভাইয়েরা

গুলশানের হোলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গিদের হামলায় নিহত পুলিশ কর্মকর্তা রবিউল করিম
গুলশানের হোলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গিদের হামলায় নিহত পুলিশ কর্মকর্তা রবিউল করিম

গ্রেনেডের স্প্লিন্টারে ক্ষতবিক্ষত দেহ। একটু আগেই দায়িত্ববোধ, সমাজ, মানুষ, পরিবার নিয়ে ভাবনায় বিভোর থাকা মানুষটির দেহে আর প্রাণ নেই। মা, স্ত্রী-সন্তান, ভাইয়ের কাছে আর কোনো দিন ফেরা হবে না তাঁর। সন্তানদের নিয়ে খুনসুটি, মায়ের কোলে মাথা রেখে ঘুমানো, আদরমাখা স্মৃতি কোনো কিছুই আর বোনা হবে না। অসহায় মানুষের জন্য হৃদয়ে লালিত স্বপ্নগুলোও অধরাই রয়ে গেল। ২০১৬ সালের আজকের এই দিনটিতে এমনই এক দেশপ্রেমিক, সাহসী যোদ্ধা, স্বপ্নবাজের বিদায় দেখেছি আমরা।

স্বাধীনতার ৪৫ বছরের পর এমন নৃশংস-বর্বরোচিত ঘটনায় সেদিন স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল সমগ্র বাঙালি জাতি। বিশেষ কারণে তাই আজকের এই দিনটি আমাদের কাছে শোকাবহ। আজকের এই দিনে আমরা হারিয়েছি আমাদের ভাইকে। যার অনেক বড় অবদানের কারণে আমরা গর্ব করে কেউ কেউ একই বাহিনীর সদস্য, ভাই, বন্ধু হিসেবে নিজেদের পরিচয় দিই। তিনি আমাদের ভাই শহীদ রবিউল করিম। ঢাকার গুলশানের হোলি আর্টিজান বেকারিতে নিরপরাধ মানুষদের সশস্ত্র জঙ্গিদের হাত থেকে উদ্ধার করতে গিয়ে জঙ্গিদের ছোড়া গ্রেনেডের স্প্লিন্টারের আঘাতে শহীদ হন সিনিয়র সহকারী পুলিশ কমিশনার (ডিবি উত্তর) রবিউল করিম (বিপিএম)। সেদিন দেশ যেমন হারায় তার এক সাহসী সন্তানকে আর আমরা হারিয়েছি আমাদের ভাই-অভিভাবককে।

১৯৮১ সালের ৩০ নভেম্বর মানিকগঞ্জ জেলার কাটিগ্রামে জন্মগ্রহণ করা এই মানবিক মানুষটি ধীরে ধীরে তাঁর মেধা ও মননের বিকাশ ঘটিয়ে নিজেকে প্রস্তুত করেছিলেন এক সাহসী সন্তান হিসেবে। নন্দিত হয়ে কেউ জন্মগ্রহণ করে না। জন্মগ্রহণ করে নিজ কর্মের মাধ্যমেই নন্দিত হতে হয়। এরই প্রতিচ্ছবি আমাদের রবি ভাই।

রবি ভাই হয়তো কখনো ভাবেননি তাঁর কর্ম, দায়িত্ববোধ, আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে একদিন পুলিশ বাহিনীর প্রতি মানুষের নেতিবাচক ধারণার মুক্তিসনদ রচনা করে পুলিশ বাহিনীর ভাবমূর্তি নিয়ে যাবেন অনন্য উচ্চতায়। বাংলাদেশের মানুষের কাছে অবিস্মরণীয় নাম হয়ে থাকবেন চিরদিন। তাঁর স্মৃতিকে বুকে লালন করবেন এ বাহিনীর সদস্যরা। সংকটকালে নিজেদের জীবন বাজি রেখে প্রয়োজনে উৎসর্গ করবেন অবলীলায়।

রবি ভাই প্রত্যন্ত অঞ্চলের পিছিয়ে পড়া অসহায় মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা, যন্ত্রণাকে নিজের চেতনায় আত্মস্থ করেছিলেন। তাঁর জীবদ্দশায় বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের জন্য গড়ে তোলা স্কুল ব্লুমস কাটিগ্রাম, অন্যদের জন্য নজরুল বিদ্যা সিঁড়ি এবং শেষবেলায় অন্যের জীবন রক্ষার্থে নিজের রক্তাক্ত দেহে যেন সার্বিক মুক্তির আকাঙ্ক্ষাই প্রতিধ্বনিত হয়েছে।

ব্যক্তিজীবনে তিনি সব সময় মানুষের ভালোবাসার সন্ধান করেছেন। একজন আদর্শবাদী ও নীতিমান সাধারণ মানুষ হিসেবে সবার সঙ্গে মিশে ছিলেন। তাঁর মানবিক ও সাহসী অবদানে তিনি সবার কাছে অর্জন করেছেন বিশেষ ও সম্মানজনক স্থান।

পুলিশ বাহিনীতে এমন রবির সংখ্যা যে কম নয়, সেটি আমরা প্রত্যক্ষ করেছি হোলি আর্টিজানের পর সিলেট, শোলাকিয়াসহ বিভিন্ন স্থানে জঙ্গি দমনে সফল অভিযানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে। অসহায় মানুষের জন্য কাজ করার যে চেতনা আমরা রবি ভাইয়ের মধ্যে দেখেছি তারই প্রতিচ্ছবি আমরা দেখি বর্তমান পুলিশ সদস্যদের মধ্যে।

বৈশ্বিক দুর্যোগ করোনা আমাদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছে মানবিক পুলিশের নানামুখী প্রশংসনীয় উদ্যোগের সঙ্গে। সংকটকালীন এ মুহূর্তে আজ চারদিকে আমরা মানুষ দেখি না আমরা যেন শুধু পুলিশ দেখি। করোনায় আক্রান্ত মৃত ব্যক্তির পাশ থেকে যখন সবাই সরে যাচ্ছে তখন পাশে দাঁড়াচ্ছেন পুলিশ সদস্যরা। কবরের জন্য জমির ব্যবস্থা, দাফনসহ সবই করছেন তাঁরা। কথায় কথায় যাঁদের আমরা গালি দিয়েছি, নেতিবাচক মন্তব্য করেছি শেষ বিদায়ে সারা জীবন ভালোবাসার চাদরে আগলে রাখা স্ত্রী-সন্তানদের পরিবর্তে আজ তাঁরাই দাঁড়াচ্ছেন পাশে।

সব পুলিশ সদস্যের রেশনসামগ্রী অসহায় মানুষের ত্রাণ বলে ঘোষণাও দিয়েছেন গাজীপুরের পুলিশ সুপার। করোনাযুদ্ধে ডিউটি শেষ হলেই খাবার নিয়ে বেরিয়ে পড়তে দেখেছি পুলিশ কর্মকর্তাদের। প্রসূতির সেবা, ডোর টু ডোর শপ, গৃহহীনকে বাড়ি বানিয়ে দেওয়ার অনন্য দৃষ্টান্তও যে এই পুলিশ সদস্যদেরই। পিপিই পরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দায়িত্ব পালন করে সহকর্মীরা সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়ার পর জাতীয় প্রেসক্লাবের টেনিস কোর্টে কর্মক্লান্ত পুলিশ সদস্যকে মাথা গুঁজে বসে থাকতে দেখি আমরা। আমরা দেখি নৌকায় নামাজ আদায়ের সময় সেজদায় থাকা ব্যক্তির মাথার ওপর ছাতা ধরে রেখেছেন পুলিশ কর্মকর্তা। মনে মনে যেন প্রতিটি পুলিশ সদস্যই নিজেকে রবিউল ভাবেন। তাঁকে অনুসরণ কতজন করেন, তা নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও পুলিশের সাম্প্রতিক সময়ের মানবিক কর্মকাণ্ড এত বেশি চোখে পড়েছে, রবিউলের পরিবারের সদস্য হিসেবে আমরা এই দাবি করতেই পারি পুলিশ ‘রবিউল’ হতে শুরু করেছে।

মানবিক এ কাজ করতে গিয়ে পরিবার থেকে একরকম বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকতে হচ্ছে পুলিশ সদস্যদের। বাসার নিচ থেকে ছোট্ট সন্তানকে হাত নেড়ে দ্রুতই ফিরব বলে সান্ত্বনা দিয়ে বিদায় জানাচ্ছেন অনেকেই। এ যুদ্ধে ইতিমধ্যে এ বাহিনীর ৪০ জন সদস্য মারা গেছেন। আক্রান্ত হয়েছেন ১০ হাজারেরও বেশি সদস্য। নিজের জীবন বাজি রেখে সামনের সারিতে বুক পেতে সবাইকে রক্ষার অঙ্গীকারে উদ্বুদ্ধ হয়ে উঠেছেন এ বাহিনীর প্রতিটি সদস্য।

যাঁরা পেশা হিসেবে পুলিশ বাহিনীতে যোগ দিয়ে সেবায় অনন্য স্বাক্ষর রাখছেন তাঁরা সবাই আমার ভাই রবিউল। প্রতিটি পুলিশ সদস্য একদিন চিন্তা ও কাজে রবিউল হলেই মানুষ আর কাউকে সম্মান শ্রদ্ধা আর ভালোবাসার নাম ‘পুলিশ’ হলেও নেতিবাচক ধারণা নিয়ে পুলিশ বলে অপমান করবে না। আর পুলিশকে সত্যিকারের পুলিশ বা রবিউল করে তুলতে হলে প্রতিষ্ঠান হিসেবেও বাহিনীটিকে দেশপ্রেমী হতে হবে আগাগোড়া।

আর হ্যাঁ, একজন পুলিশ রবিউলের গড়া বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের স্কুল ব্লুমস–এর পাশেও দাঁড়াতে হবে এই মানবিক পুলিশকেই। অথবা নিজ নিজ এলাকায় মানবিক কাজের প্রমাণ রাখতে হবে পুলিশের সব সদস্যকে।

শামসুজ্জামান শামস, শহীদ রবিউল করিমের ছোট ভাই