'এ তো আমার প্রতিদিনের যুদ্ধ'

গুলশানা আক্তার
গুলশানা আক্তার

রাজধানীর একটি হোটেলে থেকে যাতায়াত করে ১০ দিন একটানা হাসপাতালে দায়িত্ব পালন করতে হয়। এরপর হোটেলে ১৪ দিনের কোয়ারেন্টিনে থাকতে হয়। পরে হাসপাতালে গিয়ে করোনা পজিটিভ-নেগেটিভ কি না, তা জানার জন্য নমুনা দিতে হয়। এ পরীক্ষায় করোনা নেগেটিভ হলে তবেই ছয় দিনের জন্য বাড়ি যেতে পারেন। আর করোনা পজিটিভ হলে আবার সেই হোটেলে ফিরতে হয়।

কথাগুলো বলছিলেন চিকিৎসক গুলশানা আক্তার (টগর)। তিনি গত ১২ মে থেকে করোনা রোগীদের চিকিৎসার জন্য রাজধানীতে ৫০০ শয্যার কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে মেডিকেল অফিসার হিসেবে কর্মরত। এর আগে দায়িত্ব পালন করেছেন ঢাকা শিশু হাসপাতালে। সেখানেও করোনা সন্দেহ বা উপসর্গ নিয়ে ভর্তি হওয়া শিশুদের ওয়ার্ডে দায়িত্ব পালন করেছেন।

গুলশানা আক্তার বললেন, তাঁর এখন তিন জায়গায় সংসার—হাসপাতাল, হোটেল আর বাসা। হাসপাতালে যতক্ষণ ডিউটি থাকে, ততক্ষণ 

চারপাশে করোনার গুরুতর রোগীদের সঙ্গে দীর্ঘ সময় থাকতে হয়। আর হোটেলের ১৪ দিনের কোয়ারেন্টিন–জীবন তো পুরোই বন্দী জীবন। এক ঘরে একা থাকতে হয়। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ভিডিও কল ছাড়া যোগাযোগ হয় না। হোটেলের কর্মীরা সুরক্ষা পোশাক পিপিই পরে ঘরের দরজার বাইরে খাবার রেখে যান। করোনা পরীক্ষার জন্য নমুনা দেওয়ার পর্বটি আরও ভয়ংকর। কষ্টের পাশাপাশি মনে অজানা ভয় কাজ করে। এরপর যদি বাড়ি ফেরার অনুমতি পাওয়া যায়, তাহলেই কেবল মুক্ত মনে হয় নিজেকে। সামাজিক জীবন বলতে ওই ছয় দিন। গুলশানা বললেন, ‘এ তো আমার প্রতিদিনের যুদ্ধ’।

গুলশানা আক্তার এ পর্যন্ত দুবার করোনা পরীক্ষা করিয়েছেন, দুবারই ফলাফল নেগেটিভ এসেছে। হোটেলে ১৪ দিনের কোয়ারেন্টিন–জীবন পার করার সময় মুঠোফোনে কথা হয় তাঁর সঙ্গে।

মনে ভয় থাকলেও হাসিমুখে দায়িত্ব পালন করেন গুলশানা আক্তার।  ছবি: সংগৃহীত
মনে ভয় থাকলেও হাসিমুখে দায়িত্ব পালন করেন গুলশানা আক্তার। ছবি: সংগৃহীত

গুলশানা আক্তার বললেন, ‘হাসপাতালে পিপিই, তিনটি মাস্কসহ অন্যান্য সুরক্ষাসামগ্রী দিয়ে নিজেকে প্রস্তুত করে রোগীর কাছে বা ওয়ার্ডে যেতে চিকিৎসকসহ স্বাস্থ্যকর্মীদের কম করে হলেও ২০ থেকে ৩০ মিনিট সময় লাগে। মাস্কে মুখ ঢাকা থাকে বলে আমরা হেসে কথা বলছি কি না, তা–ও রোগীরা বুঝতে পারেন না। আমরা আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা দিয়ে রোগীর সেবা করছি। এরপরও অনেক সময় ভুল বুঝছেন রোগী ও রোগীর স্বজনেরা। সম্প্রতি এক চিকিৎসককে পিটিয়েই মেরে ফেলা হলো। আমি শুধু বলতে চাই, এখন পরিস্থিতি স্বাভাবিক নয়। রোগীর শ্বাসনালিতে টিউব লাগানোসহ আমাদের রোগীর একদম কাছে যেতে হচ্ছে। দীর্ঘ সময় রোগীর কাছে থাকতে হচ্ছে। সুরক্ষা নেওয়ার পরও অনেক চিকিৎসক করোনায় মারা গেছেন। সারাক্ষণ আতঙ্ক আমাদের মধ্যেও কাজ করে।’

গুলশানা আক্তার বলেন, ‘মাস্কসহ অন্যান্য সুরক্ষা পোশাকের কারণে নিজেরই অনেক সময় শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। ওয়ার্ড থেকে ফিরে নির্দিষ্ট রুমে গিয়ে পিপিইসহ অন্যান্য পোশাক পাল্টাতে হয়। ওয়ার্ডে যেতে হলে আবার নতুন করে পোশাক পরতে হয়। এ যুদ্ধ প্রতিদিনের। রমজানের ঈদ করেছি হাসপাতালে ডিউটি পালন করে। এখন আমাদের কাছে প্রতিদিনই এক রকম, ঈদ বা উৎসব বলে আমাদের জীবনে কিছু নেই। গত ১০ দিনে কেবিন ব্লকে দায়িত্ব পালন করা অবস্থায় আমার ওয়ার্ডে একজন রোগীও মারা যাননি, স্বস্তি বা তৃপ্তি বলতে এটুকুই।’

রাজধানীর লালমাটিয়া বাসায় স্বামী সাদমান খান নাবিল, শ্বশুর, শাশুড়ি, দেবরসহ অন্য সদস্যরা আছেন। গুলশানা আক্তার বললেন,‘পরিবার আমার পাশে আছে বলেই দেশের এই পরিস্থিতিতে আমি আমার দায়িত্ব পালন করতে পারছি।’

৩৯তম বিসিএসের গুলশানা আক্তার যখন ঢাকা শিশু হাসপাতালে দায়িত্ব পালন করছিলেন, তখনকার একটি ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে আলোচনায় আসে। বিবিসি নিউজে (বাংলা) গুলশানাকে নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।

গুলশানা আক্তার বললেন, ‘১২ ঘণ্টার ডিউটি শেষে মুখের মাস্ক খুলে ক্লান্ত এবং বিধ্বস্ত অবস্থায় নিজের ছবি তুলে পারিবারিক মেসেঞ্জার গ্রুপে পাঠিয়েছিলাম। স্বামী তা ফেসবুকে শেয়ার দেন। এরপর ফেসবুকে শেয়ার আর কমেন্টের জন্য ছবিটি আলোচনায় আসে। আমি আসলে এত কিছু চিন্তা করে ছবিটি পাঠাইনি। শুধু আমি নই, দায়িত্ব পালন শেষে যখন শরীর থেকে সুরক্ষা পোশাক খোলা হয়, তখন সব স্বাস্থ্যকর্মীর চেহারাই এমন বিধ্বস্ত থাকে।’