কাজের প্রয়োজনেই ছুটতে হয়

করোনাভাইরাসের ভয়ে ঘরে বসে থাকার উপায় নেই এঞ্জেলা সিজুকার।  ছবি সংগৃহীত
করোনাভাইরাসের ভয়ে ঘরে বসে থাকার উপায় নেই এঞ্জেলা সিজুকার। ছবি সংগৃহীত

মার্চের শেষ দিকে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে সরকার সাধারণ ছুটি ঘোষণার পাশাপাশি সবাইকে ঘরে থাকার পরামর্শ দেয়। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো ঘরে বসে অফিস কার্যক্রম শুরু করে। কিন্তু এঞ্জেলা সিজুকার ঘরে বসে কাজের উপায় নেই। মানুষের খাদ্যের জোগান দিতে তাঁকে রাস্তায় বের হতে হয়েছে।

ব্র্যাক ডেইরি অ্যান্ড ফুড প্রোজেক্টের একজন বিক্রয় প্রতিনিধি এঞ্জেলা সিজুকা (২৩)। তিন বছর ধরে এই প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন। একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিবিএ শেষ বর্ষে পড়ছেন তিনি। এঞ্জেলার কর্মক্ষেত্র রাজধানীর কারওয়ান বাজার। ওই এলাকার দোকানগুলোয় ব্র্যাক ডেইরির খাদ্যপণ্য সরবরাহের দায়িত্ব তাঁর।

এঞ্জেলা বলেন, ‘সকাল সাড়ে আটটায় বের হই। কারওয়ান বাজার গিয়ে ডিলার পয়েন্টে থেকে মেমোসহ প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নিয়ে বাজারের বিভিন্ন দোকানে গিয়ে অর্ডার নিই। পরে ওগুলোর ডেলিভারি দেখভাল করি। এরপর দোকানগুলো থেকে আবার টাকা সংগ্রহের জন্য যাই এবং তা এনে আবার ডিলারদের দিতে হয়। কাজ শেষ হতে ছয়টা বেজে যায়।’

করোনার কারণে অনেকে ঘরে বসে কাজের সুযোগ বা ছুটি পেলেও এঞ্জেলাকে বের হতে হয়েছে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রথম যেদিন থেকে ছুটি শুরু হলো, সেদিন বের হয়ে দেখি রাস্তায় কোনো গাড়ি নেই। কী করব, চিন্তায় পড়ে গেলাম। রিকশা পেলেও ভাড়া কয়েক গুণ বেশি। ঢাকা উদ্যানে বাসা। সেখান থেকে সেদিন হেঁটে কারওয়ান বাজারে যাই। তখন দেখি বাজারেও লোক কম। অনেক দোকানও বন্ধ ছিল। অল্প কিছু অর্ডার পাই। চারদিকে মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছিল।’

যত দিন সাধারণ ছুটি ছিল, হেঁটে, রিকশাসহ বিভিন্ন উপায়ে কর্মস্থলে পৌঁছান এঞ্জেলা। তিনি বলেন, ‘এই সময়টাতে বেশির ভাগই বাসা থেকে অফিস করেছেন। কিন্তু আমার কাজের ক্ষেত্রটা এমন যে আমাকে বের হতেই হবে। যেহেতু প্রতিদিন বের হই, তাই শ্বশুরবাড়িও যেতাম না। পাশেই আমার বাসা। সেখানে মা, বোন, ভাই থাকেন। মা ডায়বেটিসের রোগী, বোনের হার্টের সমস্যা আছে। তাই নিজেকে একদম আলাদা করে ফেলি। আমি এখনো সম্পূর্ণ আলাদাই থাকছি। কেউ যেন আমার সংস্পর্শে না আসে, সে চেষ্টা করি। বের হলে আমি সব সুরক্ষা মেনেই চলার চেষ্টা করি।’

লকডাউন ঘোষণার পর প্রথম এক মাস বলতে গেলে, কারওয়ান বাজার এলাকার সব কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধিদের মধ্যে সিজুকা একাই ছিলেন মাঠে। লকডাউনের অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করে এঞ্জেলা বলেন, বেশির ভাগ দোকান বন্ধ, মার্কেটগুলোর ভেতরটা অন্ধকার। অন্যান্য বেশির ভাগ কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধিরা আসেননি। দোকানিদের কৌতূহলী জিজ্ঞাসা, আপা আপনি একা একটা মেয়ে মানুষ এর মধ্যে কেন আসলেন, কীভাবে আসলেন?

করোনাভাইরাসের বিস্তারের শুরুর দিকে অন্য অনেকের মতো এঞ্জেলাও ছুটি কাটাতে পারতেন, কিন্তু নেননি নিজের দায়িত্ব বোধ থেকেই। বিশেষ করে তখন সামনে ছিল রমজান। মাঠে না থাকলে দোকানগুলোতে প্যাকেটজাত দুধের ঘাটতি দেখা দেবে। দাম বেড়ে যাবে, ন্যায্য মূল্যে মানুষের ঘরে দুধ পৌঁছাবে না।

এঞ্জেলা গর্ব করেই জানালেন, করোনাকালীন দুর্যোগে বিভিন্ন পণ্যের দাম বাড়লেও খুচরা পর্যায়ে ক্রেতাদের কাছে প্যাকেটজাত দুধের দাম এক টাকাও বাড়েনি। পুরো সময়টাতে আগের দামেই দুধ বিক্রি করতে পেরেছেন গ্রামের ক্ষুদ্র খামারিরা।

এঞ্জেলা সিজুকার সহজ বিশ্বাস, পরস্পর পরস্পরের কল্যাণ ও উপকারের মাধ্যমে গড়ে উঠেছে যে মানব সভ্যতা, শত দুর্যোগেও তা এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে মানুষকেই।

 সাধারণ ছুটি শেষ হওয়ার পর সড়ক ও বাজারে আবার সেই চিরচেনা চিত্র। এঞ্জেলার মনেও শঙ্কা। কর্মক্ষেত্র এলাকায় অনেক ভিড়, এ ছাড়া সংক্রমণও বাড়ছে। কিন্তু তিনি বলেন, বাস্তবতা মেনেই তাঁকে কাজ করতে হবে।