মায়ের চোখেই বিশ্ব দেখেন সুজন

মা তাসলিমা বেগম ও ছেলে সুজন রহমান।  ছবি: সংগৃহীত
মা তাসলিমা বেগম ও ছেলে সুজন রহমান। ছবি: সংগৃহীত

 সুজন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী। সুজন বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি, কুষ্টিয়ার জেলা সাংস্কৃতিক কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত। সুজনের এ কঠিন পথচলাকে সহজ করেছেন তাঁর মা তাসলিমা। সুজন বললেন, ‘আমি আজ যা কিছু অর্জন করেছি, তা সব করেছি  আমার মায়ের চেষ্টায়।’

গত বছর রাজধানীর মিরপুরে জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশনে ২৮তম আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবস ও ২১তম জাতীয় প্রতিবন্ধী দিবসের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ‘প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সফল পিতা–মাতা’ ক্যাটাগরিতে সুজনের মা তাসলিমা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত থেকে সম্মাননা স্মারক গ্রহণ করেছেন।

তাসলিমা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছেন। তারপর তাঁর বিয়ে। আর স্কুলমুখো হওয়ার সুযোগ পাননি। বিয়ের তিন বছরের মাথায় তাসলিমার কোল আলো করে জন্মান সুজন। মাত্র দেড় বছর বয়সে ডায়রিয়ায় সুজনের চোখের দৃষ্টি হঠাৎ করে কমে যায়। নিজ জেলা ছাড়িয়েও যে যেখানে চিকিৎসকের সন্ধান দিয়েছেন, তাসলিমা ছেলেকে নিয়ে ছুটে গেছেন। কিন্তু ছেলের চোখের দৃষ্টি ফেরানো যায়নি।

সুজনকে স্কুলে ভর্তি থেকে শুরু করে প্রতি পদে পদে সংগ্রাম করেছেন বা করছেন তাসলিমা। স্কুলে, শিল্পকলা একাডেমি, শিশু একাডেমি, গানের শিক্ষক, স্টেজ, স্টুডিও থেকে শুরু করে চাকরি—সব জায়গায় সুজনের সঙ্গে তাসলিমা ছিলেন ছায়া হয়ে। সারা দিনের সংসারের কাজের ফাঁকে সুজনকে নিজে পড়ে শোনাতেন। সুজন ব্রেইল পদ্ধতিতে তা লিখে নিতেন।

তাসলিমা বললেন, ‘আমার তো মনে হয়, সুজন আমার চোখ দিয়েই বিশ্ব দেখে। আমি দুচোখে যা দেখি, যেভাবে দেখি, ঠিক সেভাবেই পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা করতে থাকি। একবার সুজনকে নিয়ে লঞ্চে যাচ্ছি। সুজন জানতে চাইল, মা লঞ্চ কেমন? আমি পুরো লঞ্চের সামনে থেকে পেছন পর্যন্ত কোথায় কী আছে বললাম। বাড়ি ফিরে শক্ত কাগজ কেটে কুটে সে একটা লঞ্চের আকৃতি দিয়ে ফেলল।’

 হাসতে হাসতে তাসলিমা বললেন, ‘দুই সন্তানের বাবা হয়েছে, অথচ এখনো সুজন বাইরে যাওয়ার সময় জানতে চায়, মা দেখো তো এই জামাটাতে মানাচ্ছে নাকি অন্যটা পরব?’

তাসলিমার স্বামী মতিয়ার রহমান একটি কোম্পানিতে মৌসুমি কর্মচারী হিসেবে কাজ করতেন। বছরের চার থেকে পাঁচ মাস কাজ করতেন অফিসে, বাকি সময় কাজ না থাকায় বসে থাকতে হতো। তাই সেই অর্থে কখনোই সচ্ছলতার মুখ দেখা হয়নি তাসলিমার। বললেন, ‘এমনও হয়েছে, সুজনকে নিয়ে ঢাকা গেছি সকালে, কুষ্টিয়া ফিরেছি মধ্যরাতে। সেলাই করে, সংসারের কাজ গুছিয়ে আবার পরদিন ঢাকা রওনা দিয়েছি। যত কষ্টই হোক, সুজনের গান বা লেখাপড়ার ক্ষতি হতে দিইনি। ছোট মেয়েটার যত্ন কম নিতে পারলেও মেয়েকেও  স্নাতকোত্তর পর্যন্ত পড়িয়েছি। ৫৫ বছরের এই জীবনে মনে হয়, কষ্টটা হয়তো বিফলে যায়নি।’

টেলিফোনেও তাসলিমার খুশির কান্নার রেশ বোঝা যাচ্ছিল। বললেন, ‘কলকাতা থেকে সুজনের এক ভক্ত শুধু কে সুজনের মা, তা দেখার জন্য কুষ্টিয়ায় চলে এসেছিলেন। অনেকেই আমাকে যখন দেখতে চান, কথা বলেন, মনে হয় আমি সত্যিকারের সফল মা। এটাই আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ অর্জন। তবে এ যুদ্ধে জেতার জন্য পেছন থেকে রসদ জুগিয়েছেন স্বামী, আমার মা আর ছোট মেয়ে মৌ।’