সাফল্যের সূত্র নিজের হাতেই: রাহুল দ্রাবিড়

ভারতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক রাহুল দ্রাবিড়ের জন্ম ১৯৭৩ সালের ১১ জানুয়ারি। তিনি টেস্ট ক্রিকেটে ৩৬টি সেঞ্চুরিসহ ১৩,২৮৮ রান ও ওয়ানডেতে ১২টি সেঞ্চুরিসহ ১০,৮৮৯ রানের মালিক। ক্রিকেটার হিসেবে অসামান্য এই অর্জনের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি পদ্মভূষণ ও স্যার ব্র্যাডম্যান অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন। ২০১৩ সালের ১১ আগস্ট ভারতের গোয়ায় অবস্থিত বিড়লা ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি অ্যান্ড সায়েন্সের (বিআইএসটি) সমাবর্তন অনুষ্ঠানে তিনি এই বক্তব্য দেন।

রাহুল দ্রাবিড়
রাহুল দ্রাবিড়

তোমাদের সঙ্গে এই সমাবর্তন অনুষ্ঠানে থাকতে পেরে আমি খুবই সম্মানিত বোধ করছি। বিআইটিএস নিঃসন্দেহে ভারতের অন্যতম সেরা একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। দেশের অগ্রযাত্রায় এই প্রতিষ্ঠানের ভূমিকাও অনস্বীকার্য। এখানে পড়তে চাইলে একজন শিক্ষার্থীকে গণিত ও পদার্থবিজ্ঞানে সর্বনিম্ন ৭৫ শতাংশ নম্বর পেতে হয়। কিন্তু আমি অনেক ভাগ্যবান কারণ, সমাবর্তন অনুষ্ঠানের প্রধান বক্তা নির্বাচনের ক্ষেত্রে এই নিয়ম মেনে চলা হয় না!
আমার অবসরের পরের সময়টি ছিল আত্ম-অনুসন্ধান ও নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে ভাবার জন্য সুন্দর একটি সময়। এ সময়ে আমি আবিষ্কার করেছি যে ক্রিকেট আমাকে আরও পরিণত করেছে, মানুষ হিসেবে যোগ্যতর বানিয়েছে। এর মাধ্যমেই আমি সুযোগ পেয়েছি সাফল্য ও ব্যর্থতাকে খুব কাছ থেকে দেখার, তা থেকে শিক্ষা নেওয়ার এবং জীবনের অংশ হিসেবে এগুলোকে মানিয়ে নেওয়ার। আমাকে প্রায়ই অনুরোধ করা হয়, জীবনে সফল কীভাবে হতে হয়, তা ব্যাখ্যা করার জন্য। সত্য কথাটি হলো, সফল হওয়ার হাজারো সমীকরণ রয়েছে, কিন্তু নিজেদেরই আমাদের সমীকরণ মিলিয়ে নিতে হবে। অন্য একজন কখনোই বলতে পারে না, তুমি কীভাবে সফল হবে? সেটা তোমার নিজেকেই খুঁজে নিতে হবে।
তোমাদের সামনে কথা বলার সুযোগ পেয়ে আমি চাই আমার নিজের জীবনের কিছু গল্প তোমাদের জানাতে, যাতে তোমরা বুঝতে পারো, আমার পথচলাটা কেমন ছিল। আমি তোমাদের একটি সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারে বেড়ে ওঠা বালকের গল্প বলতে চাই, যে বালকটি ছিলাম আমি। আমার বাবা ছিলেন একজন ক্রিকেট-পাগল মানুষ, তিনি প্রতিটি ম্যাচ রেডিওতে শুনতেন, তা ভারতের হোক বা অন্য কোনো দলের। যখনই তিনি সুযোগ পেতেন, আমাকে ও আমার ভাইকে নিয়ে মাঠে খেলা দেখতে যেতেন। তাঁর কাছে এটাই ছিল সময়ের সর্বোৎকৃষ্ট ব্যবহার।
বাবাই ছিলেন আমার ছোটবেলার নায়ক। তাঁকে দেখে দেখেই আমার ক্রিকেটের প্রতি আগ্রহ তৈরি হলো। তাঁর সঙ্গে খেলা দেখতে দেখতে, বাড়ির উঠানে, পাড়ার রাস্তায় খেলতে খেলতে সেই আগ্রহটা আরও বাড়তে থাকল। এই আগ্রহটাই একদিন ভালোবাসায় বদলে গেল।
আবিষ্কার করলাম, আমি কী হতে চাই? আমি বুঝতে পারলাম, দ্রাবিড় পরিবারে জন্ম নেওয়াটা কোনো নিছক ঘটনা নয়, এটাই আমার জীবনের অনুপ্রেরণা। স্কুলজীবন থেকেই আমার জগৎটা ছিল ক্রিকেটকেন্দ্রিক। যখন আমি আন্তস্কুল টুর্নামেন্ট জিতলাম, আমি ভাবলাম বিশ্বকাপ জিতে গেছি! তখন আমার সবচেয়ে বড় মিশন ছিল স্কুল ও রাজ্য দলকে নেতৃত্ব দেওয়া। অন্য সব মা-বাবার মতো আমার মা-বাবাও আমার ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত ছিলেন। তাঁরা ভাবতেন, আমি যদি শুধু ক্রিকেট নিয়েই পড়ে থাকি, তাহলে আমার অন্য সব বিষয়ের কী হবে? যখন আমি অষ্টম শ্রেণীর শিক্ষার্থী, তাঁরা আমাকে নিয়ে স্কুল অধ্যক্ষের কাছে গেলেন। আমি তখন অনূর্ধ্ব ১৫ রাজ্য দলের জন্য নির্বাচিত হয়েছি; কিন্তু টুর্নামেন্টটি ছিল আরেকটি রাজ্যে এবং সে সময় আমার স্কুলের ক্লাস চলতে থাকবে। তাঁরা অনেক দ্বিধায় ছিলেন, কারণ ক্রিকেটের কারণে আমার স্কুলের পড়ালেখার অনেক ক্ষতি হচ্ছিল এবং তাঁরা চাইছিলেন না আমি এই টুর্নামেন্ট খেলতে যাই। কিন্তু ফাদার কোয়েলহো তাঁদের বোঝালেন এবং বললেন, ‘ওর পড়ালেখার দায়িত্ব আমার। আপনারা শুধু ওকে ক্রিকেট খেলতে দিন।’ যদি অধ্যক্ষ আমার মা-বাবার কথায় রাজি হতেন, তাহলে আমি হয়তো ক্রিকেট নিয়ে আর কখনো সেভাবে ভাবতাম না, হয়তো আমার জীবনের গল্পটা অন্যভাবে লেখা হতো। জীবন থেকে আমি এই শিক্ষা পেয়েছি, কখনো কখনো খুব অপ্রত্যাশিত জায়গা থেকে সাহায্য আসে এবং সেগুলোই জীবনের বড় বড় পরিবর্তন আনে। বন্ধুদের কাছ থেকে ক্লাস নোট ধার নিয়ে এবং স্কুল ও কলেজজীবনে শেষ মুহূর্তে পরীক্ষার প্রস্তুতি নিয়ে আমি ক্রিকেটার হওয়ার পথে হেঁটেছি। সে সময় আমাকে প্রচুর লিগের খেলা খেলতে হতো, যার অনেকগুলোই হতো বাউন্সি উইকেটে। সারা দেশে আমি ট্রেনে করে ঘুরেছি, কখনো কখনো ছোট এক রুমে পাঁচ থেকে ছয়জন করে রাতে থেকেছি। ক্রিকেট খেলতে গিয়ে এভাবেই আমি আমার দেশকে চিনেছি, অনেক মানুষের সঙ্গে পরিচিত হয়েছি। শুরুতে আমাদের আন্তর্জাতিক মানের ফাস্ট বল খেলার সে রকম কোনো সুযোগ ছিল না। আমি নিজের মতো করে একটি প্র্যাকটিস-পদ্ধতি মেনে চলতাম, টিমমেটদের আমি বলতাম, ৪৫ ফুট (১৫ ইয়ার্ড) দূর থেকে ভেজা টেনিস বল ছুড়ে মারতে, যাতে আমি বুঝতে পারি যে একজন বিশ্ব মানের পেসারকে খেলতে কেমন লাগে। অনেকে আমার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকাত, অনেকে মনে করত, এটা শুধুই সময়ের অপচয়। কিন্তু, এটাই ছিল আমার করা সবচেয়ে দরকারি প্র্যাকটিস। এর মধ্যে আমার জাতীয় দলে খেলার সম্ভাবনা দেখা দিল, এমনকি আমি ভারতের অনূর্ধ্ব ১৯ দলকেও নেতৃত্ব দিলাম। দেখা হলে সবাই আমাকে জিজ্ঞাসা করত, কখন তুমি জাতীয় দলের হয়ে খেলছ? কিন্তু এ ব্যাপারটি তো আসলে আমার হাতে ছিল না; ফলে আমার জীবন ও খেলার ওপরে এর প্রভাব পড়তে শুরু করল। জাতীয় দলে ডাক পাওয়ার আগে আমি ঘরোয়া লিগে পাঁচ বছর খেলেছি। সে সময়টি ছিল আসলেই অনেক হতাশার। আমার মনে পড়ে, আমি আমার বাইকের ওপরে একটা স্টিকার লাগিয়েছিলাম, যাতে লেখা ছিল, ‘গড’স ডিলেস আর নট গড’স ডিনায়ালস’।
পেছন ফিরে তাকালে আমি বুঝতে পারি, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আমার সাফল্য আসলে ঘরোয়া ক্রিকেটে প্রতীক্ষারই ফসল। রঞ্জি ট্রফিতে দক্ষ স্পিনারদের খেলেই আমি ওয়ার্ন ও মুরালিধরনকে খেলার আত্মবিশ্বাস পেয়েছি। টেনিস বল নিয়ে করা প্র্যাকটিস থেকেই আমি বুঝতে পেরেছি, কী করে খারাপ উইকেটে ম্যাকগ্রা, আকরাম, ডোনাল্ডদের মতো পেসারদের খেলতে হয়। যখন আমি তরুণদের সঙ্গে কথা বলি, জীবনের এই গল্পটা আমি সব সময়ই তাঁদের শোনাই। আমি আমার ক্যারিয়ারের চড়াই-উতরাইগুলো নিয়ে সন্তুষ্ট। আমি আমার স্বপ্নের পাহাড়ে চড়েছি, যে স্বপ্ন আমি একটি ছোট বালকের চোখ দিয়ে দেখেছিলাম। সেই পাহাড়ে চড়াটাই ছিল আমার জীবনের সবকিছু এবং আমি যতই চূড়ার কাছে যাচ্ছিলাম, আমার লক্ষ্যে অবিচল থাকতে পেরেছি। যখন আমি পাহাড়ের শীর্ষে পৌঁছলাম, আমি সময়টাকে উপভোগ করেছি এবং গভীর আনন্দ পেয়েছি। কারণ, সে সময়ই আমি উপলব্ধি করেছি, শান্তি লাভের জন্য আমাকে বিশ্বের এক নম্বর হওয়ার প্রয়োজন নেই, আমাকে শুধু নিজের কাছে এক নম্বর হতে হবে। একজন ভালো পর্বতারোহীর মতো, আমি এখনো নতুন আরেকটি পাহাড়ে চড়ার স্বপ্ন দেখছি। জীবনের অনিশ্চয়তা আমাকে চিন্তিত করে তোলে, আবার আনন্দও দেয়। মাঝেমধ্যে আমি আমার শৈশবে ফিরে যাই, বাবার ট্রানজিস্টরে শোনা ক্রিকেটের ধারাভাষ্য এখনও কানে বাজে।
২০১৩ সালের সমাবর্তন ক্লাস, তোমাদের সবাইকে আমার হূদয়ের উষ্ণ শুভেচ্ছা। আমি প্রার্থনা করি, যাতে তোমরা চড়ার জন্য নিজেদের স্বপ্নের পাহাড় খুঁজে পাও। চলার পথে একে অন্যকে সাহায্য করো, বিপদে ধৈর্যশীল হও, জীবনের সাফল্য-ব্যর্থতাকে হাসিমুখে মেনে নেওয়ার শক্তি অর্জন করো। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো জীবনের পথচলার প্রতি মুহূর্ত উপভোগ করো। ভালো থেকো।

ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ: মনীষ দাশ