তাঁর ক্যামেরার মন

তাসলিমা আখতার
তাসলিমা আখতার

কবি জীবনানন্দ দাশ লিখেছিলেন, ‘কেবলই দৃশ্যের জন্ম হয়’। আমরা সেই যুগে এসে পড়েছি, যখন দৃশ্যের বন্যা চতুর্দিকে। কাগজে কি ইন্টারনেটে জীবন ছবিময় হয়ে আছে। এ রকম অজস্র ছবির মধ্যে একটি ছবি যখন বিশ্বের কোটি কোটি পাঠক-দর্শককে থমকে দেয়, তখন সেই ছবির স্রষ্টাকে খুঁজতে হয়। মাত্র একটি ছবিতে রানা প্লাজা ধসের বীভৎস বাস্তবতার মর্ম বিশ্ব মানবতার সামনে চিৎকার করে জানায়, জীবন আমাদের নয়।
এটি হতে পারত পৃথিবীর কোনো অমর ভালোবাসার আলিঙ্গনের ছবি। দুটি তরুণ-তরুণী আঁকড়ে আছেন পরস্পরকে। মেয়েটির জামার হাতায় সাদা ফুলের ছাপ, হাতে সোনালি চুড়ি। ছেলেটির শক্ত-সবল দেহে নীল টি-শার্ট। মৃত্যুতে দুজন দুজনকে বুকে জড়িয়ে এক হয়েছেন। একটা পুরো ভবন ধসে পড়ে মেরে ফেলেছে তাঁদের; নিষ্ঠুর মুনাফার আয়োজন পিষে ফেলেছে তাঁদের—তবু তাঁরা দুটি মানুষ পরস্পরকে ছাড়েননি। মৃত্যুও তাঁদের আলাদা করতে পারেনি।
রানা প্লাজায় যখন কাজ চলত, তখন হয়তো তাঁরা স্বামী-স্ত্রী ছিলেন, কিংবা ছিলেন প্রেমিক-প্রেমিকা বা বন্ধু এবং তাঁরা ছিলেন সহকর্মী। সে জীবনে অনেক গল্প ছিল, যা আমরা কোনো দিনই জানব না। ধসের পরের মুহূর্তে সেই নারকীয় ধ্বংসস্তূপে নারকীয় মৃত্যুর বিরুদ্ধে হাজারো শ্রমিকের হাজারো নিরুপায় চেষ্টা ছিল। রানা প্লাজার সুড়ঙ্গে, কংক্রিটের স্লাব, থাম, মেশিনপত্রে চাপা পড়ে যতক্ষণ শ্বাস ছিল, ততক্ষণ চলেছে মৃত্যুর বিরুদ্ধে জীবনের লড়াই। পরস্পরকে বাঁচাতে মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসার সেই সব মহান মুহূর্তের গল্পও আমাদের জানা হবে না। কিন্তু এই একটি ছবি দেখার পর আমরা জেনে যাই, বীভৎসতা আর মানবতার কী ভয়াবহ ট্র্যাজেডি ঘটেছে সেখানে।
এই ছবির দ্রষ্টা তাসলিমা আখতার। আলোকচিত্রীর চোখের প্রশংসা করা হয়, যেমন শিল্পীর তারিফ হয় গলার। সবারই তো চোখ আছে; কিন্তু বাস্তবতার গভীর মর্ম ধরে টান দিতে পারে কজনের ছবি? রানা প্লাজার ঘটনারও আগের কিছু ছবি আছে তাসলিমার তোলা। তাঁর ছবির একটি সিরিজের নাম ‘জীবন ও স্বপ্ন’। পোশাকশিল্পের নারী শ্রমিকদের প্রতিদিনের ছবি। জোড়ায় জোড়ায় পাশাপাশি রাখা সেই ছবিগুলোর একটি বলে তাঁদের স্বপ্নের কথা, অন্যটি দেখায় বাস্তব। মেয়েরা তাঁদের বন্ধু-বান্ধবী অথবা আত্মীয়-সন্তানদের নিয়ে সেজেগুজে স্টুডিওতে গিয়ে কিংবা কোনো উদ্যানে ছবি তুলছেন। এগুলো তাঁদের স্বপ্ন। স্টুডিওর রং করা নকল বিলাসী পরিবেশে তাঁদের মনে হয় বিত্তবানদের মতো ঝলমলে, সুখী মানুষের মতো উচ্ছল। পাশের ছবিতেই দেখা যায় এক ঘরে গাদাগাদি করে ২০-২২ জনের ঘুমানোর ছবি। কানে ফুল গুঁজে যে মেয়েটি স্টুডিওর ক্যামেরার সামনে স্বপ্নবিভোর হাসিতে ফুটে ওঠেন, সেই মেয়েকেই বাস্তবে দেখি মর্গে নিথর হয়ে শুয়ে থাকতে। তাসলিমার ছবিগুলো এমনই করুণ ও কঠিন।
তাসলিমার বিশ্বাস, ছবির বিষয় বাছাই করা বা সেই বিষয়ের ছবি তুলে যাওয়াটা কেবল দক্ষতা ও পেশাদারির ব্যাপার হতে পারে না। গভীর ব্যক্তিগত নিষ্ঠা ও দরদ ছাড়া তাঁর ক্যামেরা কথা বলে না। তাঁর কাছে ছবি জীবন ও স্বপ্নের দলিল, পরিবর্তনের হাতিয়ার, সংগ্রামের প্রেরণা। পোশাকশ্রমিকদের ছবি তুলতে শুরু করার আগে তিনি তাঁদের মধ্যে কাজ করেছেন শ্রমিক সংগঠক হিসেবে—এখনো করছেন। মিশেছেন, থেকেছেন, সম্পর্ক গড়েছেন। তারও আগে ছিলেন বাম ধারার ছাত্রসংগঠন ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতি। শ্রমজীবী মানুষের প্রতি অটুট দায়িত্ববোধ আর বাস্তবতাকে মানবিকভাবে বদলে দেওয়ার যে সংকল্প থেকে তিনি রাজনীতিতে জড়িয়েছিলেন, সেই সংকল্পই তাঁকে করেছে আলোকচিত্রী। এখন তিনি গার্মেন্টস শ্রমিক সংহতির সমন্বয়ক এবং নারী সংহতির সহ-সমন্বয়ক। বহু পুরোনো শখের বশে আলোকচিত্র প্রশিক্ষণের বিখ্যাত কেন্দ্র পাঠশালায় ভর্তি হন এক মাসের একটি কোর্সে। সেই এক মাসের কোর্স এক বছরে গড়াল। এক বছরের কোর্স তিন বছরে গ্র্যাজুয়েশন দিয়ে শেষ হলো। তাসলিমা আখতার এখন শ্রমিক ও নারী সংগঠকের পাশাপাশি পাঠশালার ভিজ্যুয়াল অ্যানথ্রপলজি কোর্সের শিক্ষক।
এদিকে তাসলিমার ছবি পেয়েছে আন্তর্জাতিকভাবে বহুল প্রচারিত ব্রিটিশ সাময়িকী টাইম সাময়িকীর বছরের সেরা ছবির পুরস্কার। পেয়েছে চীনে আয়োজিত ডালি ইন্টারন্যাশনাল ফটো কনটেস্টের সেরা ফটোর পুরস্কার। অর্জন করেছেন ওয়ার্ল্ড প্রেস ফটো অ্যাওয়ার্ড।
এই লেখার জন্য যখন তাসলিমার সঙ্গে কথা বলতে ফোন করি, তখনো তিনি সাভারের শ্রমিক এলাকায় কাজে ব্যস্ত। ছবি, সংগঠন ও আন্দোলন মিলিয়ে তাসলিমা আমাদের সময়ের অন্য এক তারুণ্যের জীবনযাত্রার কথা বলেন, যে জীবন ব্যক্তির সঙ্গে সমষ্টির দুঃখ-বেদনা ভাগাভাগির। তাসলিমার ছবি জানায়, এত এত বিপর্যয়ের পরও ‘আমরা মরে যাইনি আজও, তবু কেবলই দৃশ্যের জন্ম হয়।’