মার্কেসনামা

পরিবারের সঙ্গে অন্তরঙ্গ মুহূর্তে
পরিবারের সঙ্গে অন্তরঙ্গ মুহূর্তে

পাণ্ডুলিপি নিয়ে যত কাণ্ড
গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের সাড়া জাগানো উপন্যাস হানড্রেড ইয়ার্স অব সলিটিউড-এর পাণ্ডুলিপি নিয়ে রয়েছে মজার এক কাহিনি। বিশালাকার এই উপন্যাসটি লিখে শেষ করার পর মার্কেস ডাবলস্পেস দেওয়া ৫৯০ পৃষ্ঠার মূল পাণ্ডুলিপিটি আর্হেন্তিনার প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান সুদামেরিকানায় পাঠানোর জন্য স্ত্রী মের্সেদেসসহ যান পোস্ট অফিসে। সেখানে পাণ্ডুলিপি ওজন করে দেখা যায়, ডাকখরচ বাবদ মোট ৮২ পেসো দিতে হবে। কিন্তু এ পরিমাণ অর্থ তখন মার্কেসের কাছে ছিল না। স্ত্রী ও তাঁর কাছে সাকল্যে ছিল ৪৩ পেসো।

হানড্রেড ইয়ার্স অব সলিটিউড-এর প্রচ্ছদ
হানড্রেড ইয়ার্স অব সলিটিউড-এর প্রচ্ছদ

এ অবস্থায় পাণ্ডুলিপিটি দুই ভাগ করে প্রথম অংশটি পোস্ট করলেন মার্কেস। পাণ্ডুলিপির দ্বিতীয় অংশ তখনো পোস্ট করা বাকি। কী করা যাবে! তাঁরা ফিরে এলেন বাসায়। বিক্রি করে দিলেন তাঁদের বিয়েতে উপহার হিসেবে পাওয়া পছন্দের ফুড প্রসেসরটি। এরপর ফুড প্রসেসর বিক্রির অর্থ নিয়ে আবার গেলেন পোস্ট অফিসে। পাণ্ডুলিপির বাকি অংশ পোস্ট করলেন। উল্লেখ্য, মূল পাণ্ডুলিপির কপি ছিল চারটি: প্রথমটি পোস্ট করলেন প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানে, দ্বিতীয়টি ছিল লেখকবন্ধু আলবারো মুতিসের কাছে, তৃতীয়টি বিলি করেন মেহিকান বন্ধুদের মধ্যে আর চতুর্থটি পাঠালেন কলাম্বিয়ার বাররানকিইয়ায়, বন্ধুদের কাছে। মজার ব্যাপার হলো, এই চতুর্থ পাণ্ডুলিপিই বর্তমানে টিকে আছে। অন্যগুলো হারিয়ে গেছে কালের গর্ভে। আরও বিচিত্র তথ্য হলো, এই উপন্যাস যখন লেখা হচ্ছে সে সময় যেসব নোট করেছিলেন মার্কেস, পরে সেসবের কিছুই আর রাখেননি তিনি—ফেলে দিয়েছিলেন সবকিছু।

গাবোর পছন্দ-অপছন্দ
কাউন্ট ড্রাকুলা আর গার্গানতুয়াগার্সিয়া—এরা হলো মার্কেসের প্রিয় সাহিত্যিক চরিত্র। প্রিয় ঐতিহাসিক চরিত্র জুলিয়ো সিজার। প্রিয় সংগীতস্রষ্টা হিসেবে তিনি নাম নিতেন বেলা বাতকের। আর সবচেয়ে অপছন্দ করতেন ক্রিস্টোফার কলম্বাসকে। তাঁর প্রিয় খাবার ছিল ফরাসি ‘কানা অ লরাঞ্জ’, এটি কমলার সসে রান্না করা হাঁসের রোস্ট। আর গাবোর জীবন ও লেখালেখিতে

যেটি ছিল অবিচ্ছেদ্য অনুষঙ্গ, সেটি আর কিছুই নয়—কলম্বিয়ার ক্যারিবীয় উপকূলের বাইয়েনাতো সংগীত।

পুরস্কারের অর্থ

.
.

ওয়ান হানড্রেড ইয়ারস্ অব সলিচ্যুড উপন্যাসের জন্য ভেনেজুয়েলা সরকার প্রদত্ত ১৯৭২ সালে রোমুলো গাইয়েগোস পুরস্কারে ভূষিত হন গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস। ওই বছরের আগস্টে ভেনেজুয়েলার রাজধানী কারাকাসে গিয়ে পুরস্কারটি গ্রহণ করেন তিনি। এরপর সেদিনই ২২ হাজার ৭৫০ ডলারের পুরস্কারের চেকটি ভাঙিয়ে সমুদয় অর্থ দিয়ে দেন ভেনেজুয়েলার সমাজতান্ত্রিক সংগঠন মোবিমিয়েন্তো আল সোশিয়ালিজমোর (মুভমেন্ট টু সোশিয়ালিজম) ফান্ডে।

মার্কেসের ‘মাকোন্দো’
গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের লেখায় বারবার এসেছে ‘মাকোন্দো’ নামের গ্রামটি। চমকপ্রদ বিষয় হলো, বাস্তবে এই গ্রামের অস্তিত্ব ক্যারিবীয় কলম্বিয়ার মাগদালেনা প্রদেশের কোথাও নেই! ১৯৫০ সালে হলদে ট্রেনে চেপে মায়ের সঙ্গে জন্মস্থান আরাকাতাকায় যাওয়ার সময় মার্কেস ট্রেনের জানালা দিয়ে দেখলেন একটি খামারবাড়ি—যার প্রবেশদ্বারে লেখা ছিল ‘মাকোন্দো’। পরে এই নামটি তাঁর এত পছন্দ হয়ে যায়, হানড্রেড ইয়ার্স অব সলিটিউড উপন্যাসে গ্রামের নামই রাখেন ‘মাকোন্দো’। ‘মাকোন্দো’ আফ্রিকান উৎসজাত শব্দ, যার অর্থ এক ধরনের গাছ। তবে মার্কেস তাঁর উপন্যাসে ‘মাকোন্দো’ নামে এ গ্রামের বর্ণনা দেওয়ার পর এখন গ্রামটি ক্যারিবীয় কলম্বিয়ার মাগদালেনা প্রদেশে আছে, আবার নেইও!

খ্যাতির পেছনে যাঁর অবদান

মার্কেস ও তাঁর স্ত্রী মের্সেদেস বার্চা
মার্কেস ও তাঁর স্ত্রী মের্সেদেস বার্চা

মার্কেসের জীবনে সাফল্য আর খ্যাতির পেছনে সবচেয়ে যাঁর বেশি অবদান, তিনি মিশরীয় বংশজাত তাঁর কলম্বিয়ান স্ত্রী মের্সেদেস বার্চা, ঘনিষ্ঠজনেরা যাঁকে ডাকেন ‘গাবা’ নামে। মের্সেদেসকে তিনি প্রথম দেখেছিলেন উত্তর কলম্বিয়ার মাগদালেনা তীরবর্তী ছোট শহর মাগানগেতে। তখন মার্কেসের বয়স ছিল ১৪ বছর আর মের্সেদেসের ৮। সেই প্রথম দেখাতেই প্রেম; মজার বিষয় হলো, সেদিনই তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, ‘এই বালিকাই একদিন আমার স্ত্রী হবে।’ ১৯৪৫ সালে মের্সেদেসকে নিয়ে কবিতাও লিখেছিলেন তিনি। তাঁদের বিয়ে হয় ১৯৫৮ সালে।

৪০ বছর কাউকে চিঠি লেখননি মার্কেস
বিখ্যাত হয়ে যাওয়ার পর বন্ধুবান্ধবদের কাউকে আর চিঠি লেখেননি মার্কেস। এমনকি অতীতে লেখা বেশির ভাগ চিঠিই ফেলে দিয়েছিলেন। বিস্ময়কর তথ্যহলো, গত ৪০ বছরে কাউকে কোনো ব্যক্তিগত চিঠি লেখেননি তিনি। এর কারণ বলতে গিয়ে মার্কেস বলেছিলেন, ‘আমার লেখা চিঠি বন্ধুরা বিক্রি করে দেয়।’ উল্লেখ্য, স্ত্রী মের্সেদেসকে লেখা তাঁর প্রেমপত্রগুলো স্ত্রীর কাছ থেকে কিনে নিয়েছিলেন গাবো।
 গ্রন্থনা: তিতাস চৌধুরী
সূত্র: গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের আত্মজীবনী বিবির পারা কোন্তারলা, দাসেসা সালবিদারের লেখা বিয়াহে আ লা সেমিইয়া, এল তিয়েম্পো ও অনান্য