শিশু নির্যাতন চলছেই

আঁকাঃ তুলি
আঁকাঃ তুলি

মফিজুলের বয়স ১০ বছর। কাজ করত রাজধানীর একটি ভাতের হোটেলে। একদিন একটি কাচের গ্লাস ভেঙে ফেলে সে। এ অপরাধে হোটেলের মালিক তাকে লাঠি দিয়ে বেদম মারে। মারের চোটে মফিজুল একসময় অজ্ঞান হয়ে যায়। পরে জ্ঞান ফিরে এলে মফিজুল সেখান থেকে পালিয়ে আসে।
বাড়ির কাজ করে নিয়ে আসেনি সায়েম (৮)। এ জন্য শ্রেণীশিক্ষক ব্ল্যাকবোর্ড মোছার ডাস্টার দিয়ে তার মাথায় জোরে আঘাত করেন। শুধু তা-ই নয়, কানে ধরে ১০ বার উঠবস করান। রাজধানীর একটি স্কুলে সম্প্রতি এ ঘটনা ঘটেছে। সায়েমের বাবা-মা স্কুল কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ করলেও কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি ওই শিক্ষকের বিরুদ্ধে।
রানী (১২) দুই বছর ধরে কাজ করছে রাজধানীর মালিবাগের একটি বাড়িতে। এই দুই বছরে প্রায় প্রতিদিনই সে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে। কাজে সামান্য ভুলচুক হলেই গৃহকর্তা-গৃহকর্ত্রী ও তাঁদের দুই ছেলেমেয়ে তাকে মারধর করে। তবু সে এই বাড়িতে কাজ করছে। কারণ তা না হলে যে তার বাবা-মাকে না খেয়ে থাকতে হবে।
পাঁচ বছরের মেয়েকে পাশের বাড়ির ভাবির জিম্মায় রেখে কাজে গিয়েছিলেন মা। ওই ভাবির ভাই এক ফাঁকে মেয়েটিকে নির্জন কক্ষে নিয়ে ধর্ষণ করে। সামাজিক কেলেঙ্কারির ভয়ে মেয়েটির পরিবার কোনো মামলা-মোকদ্দমার ঝামেলায় যায়নি।
আমাদের দেশে শিশুরা প্রতিনিয়ত এ ধরনের নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। তবে দিন বা বছরে আসলেই কত শিশু নির্যাতিত হচ্ছে, সে বিষয়ে সরকারি কোনো তথ্য নেই। তবে বিভিন্ন এনজিও এবং সরকারের বিভিন্ন সংস্থার কাছ থেকে কিছু খণ্ডিত চিত্র পাওয়া যায়।
মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন ছয়টি জাতীয় পত্রিকার খবর পর্যালোচনা করে ‘বাংলাদেশ শিশু পরিস্থিতি ২০১৩’ প্রতিবেদনে বলছে, বছরটিতে ২৬৭ শিশু ধর্ষণের শিকার হয়। এর মধ্যে মারা যায় ১২ জন। গুরুতর আহত হয় ২৩৯ জন শিশু। ধর্ষণ ছাড়া অন্যান্য যৌন নির্যাতনের খবর প্রকাশিত হয় ১৫০টি। তবে ২০১২ সালে ১৫৫ জন শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছিল। অর্থাৎ সংখ্যাটি না কমে বরং বেড়েছে।
মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের পর্যালোচনা অনুযায়ী, বছরটিতে ৯০ শিশু অপহরণের শিকার হয়। অপহরণের পর খুন করা হয় দুজনকে। পারিবারিক কলহ, মুক্তিপণ না পেয়ে, জমিজমা নিয়ে বিরোধ ও মা-বাবার পরকীয়ার জেরে ৩৩৫ শিশু খুন হয়। অশ্লীল ভিডিওচিত্র ছড়ানোর ভয়ে বা অন্যান্য কারণে আত্মহত্যা করে ১৬৬ শিশু। বিভিন্ন অপরাধী কর্মকাণ্ডে ২৪৫ শিশুকে সম্পৃক্ত করা হয়। এর মধ্যে মারা যায় ১৭৬ জন। বছরটিতে পাচার হয় ৪২ শিশু। অ্যাসিডদগ্ধ হয় ১০ শিশু। রাজনৈতিক সহিংসতার শিকার হয়ে ৪১ শিশু মারা যায়। ১০৭ শিশু গুরুতর আহত হয়।
তবে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব তারিক-উল ইসলাম শিশু নির্যাতনের ঘটনাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, দেশে শিশু নির্যাতনের যেসব ঘটনা

ঘটছে তা বিচ্ছিন্ন ঘটনা। নির্যাতনের চেয়ে শিশুরা ঝুঁকির ভেতরেই বেশি থাকছে। ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রমে কোটি কোটি শিশু জড়িত। সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে বিভিন্ন কাজ হচ্ছে, তবে বিশাল সংখ্যক শিশুকে কর্মসূচির আওতায় আনা কঠিন কাজ। এই শিশুদের কথা চিন্তা করে আগামী বাজেটে শিশুদের জন্য বরাদ্দ বাড়ানোর সুপারিশ করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের চেয়ারম্যান এমরানুল হক চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, শিশু নির্যাতনের ঘটনা যাতে না ঘটে বা ঘটার পর যথাযথ যে ধরনের প্রক্রিয়া থাকা প্রয়োজন সরকার সেদিকে নজর দেয়নি। থানায় শিশুবান্ধব কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয়নি। মহিলা অধিদপ্তরের মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তাদের শিশুদের বিষয়টি দেখার বাধ্যবাধকতা নেই। ইউনিয়ন পর্যায়ে নারী ও শিশুবিষয়ক যে কমিটি আছে তা সক্রিয় নয়।

মেয়েশিশুরা বেশি নির্যাতনের শিকার হয়:
শুধু মেয়ে হয়ে জন্মানোর কারণে সাত মাসের বাবলিকে অ্যাসিড খাইয়ে দেয় তার বাবা। এখন বাবলির বয়স ১৪ বছর। ঘটনার পর মামলা করা হলেও আসামিকে এখন পর্যন্ত গ্রেপ্তার করা হয়নি।
২০১৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসের শেষের দিকে ডাস্টবিনের পাশ থেকে নির্যাতনের শিকার গৃহকর্মী আদুরিকে উদ্ধার করা হয়। তার ওপর নির্যাতনের ভয়াবহতা দেখে অনেকেই আঁৎকে ওঠে। তার পরও বন্ধ হয়নি নির্যাতন। খুলনায় ১৩ বছরের সীমাকে গৃহকর্তা ও গৃহকর্ত্রী শুধু হত্যাই করেনি, দীর্ঘ নয় মাস ডিপ ফ্রিজে রেখে দিয়েছিল।
গৃহকর্মীদের সুরক্ষায় সরকার গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণ নীতিমালার একটি খসড়া করে রেখেছে। ২০০৯ সাল থেকেই সরকার খসড়াটি চূড়ান্ত করার ঘোষণা দিলেও তা চূড়ান্ত হয়নি। সরকারের খসড়া নীতিমালাতেই বলা হয়েছে, বর্তমানে ২০ লাখেরও বেশি শ্রমিক গৃহকর্মে নিয়োজিত। এদের বেশির ভাগই মেয়েশিশু। গৃহকর্মীদের নির্যাতন করে উল্টো বাসার মালিক সেই গৃহকর্মীর নামেই থানায় চুরির মিথ্যা মামলা দেন। গৃহকর্মীদের মেরে ফেলার পর থানায় আত্মহত্যা বা অপমৃত্যুর মামলা করে। ২০১০ সালে কিশোরী ফিন্নি বারিধারার মেলরোজ অ্যাপার্টমেন্টে (বাড়ি ১৭, সড়ক ১৩) ২/বি নম্বর ফ্ল্যাটেই মারা গেলে গুলশান থানায় একটি অপমৃত্যুর মামলা করা হয়।
২০১১ সালের মে মাসে বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের করা এক গবেষণা অনুযায়ী, নগরের মিরপুর, মোহাম্মদপুর ও ধানমন্ডিতে কর্মরত ৮৪৯ জন গৃহকর্মীর ১৭ শতাংশই যৌন নির্যাতনের শিকার। এর মধ্যে ৫২ শতাংশ প্রতিদিনই এ ধরনের নির্যাতন সহ্য করছে।
সেভ দ্য চিলড্রেন, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন এবং প্ল্যান বাংলাদেশ শিশু গবেষকদের মাধ্যমে প্রতিবেদন তৈরি করা শুরু করেছে ২০১০ সাল থেকে। ২০১২ সালের নভেম্বরে প্রকাশিত চতুর্থ প্রতিবেদনে সরকারি সূত্রের বরাত দিয়ে বলা হয়েছে, দেশে পথশিশুর সংখ্যা ১০ লাখ। এদের ২০ ভাগ শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়। ১৪ শতাংশের বেশি শিশু যৌন নির্যাতনের শিকার। দেশের বিভিন্ন বস্তিতে যেসব শিশু বড় হচ্ছে তাদের অবস্থা আরও নাজুক।

শিশু সুরক্ষায় কিছু উদ্যোগ:
২০১১ সালে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে স্কুল ও মাদ্রাসাসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিক শাস্তির নামে নির্যাতনকে অসাংবিধানিক বলে রায় দিয়েছেন হাইকোর্ট। যৌন হয়রানি বন্ধে হাইকোর্টের গাইডলাইন, বাল্যবিবাহ রোধ এবং পথশিশুদের অধিকার সুরক্ষায় হাইকোর্টে পৃথক দুটি জনগুরুত্বপূর্ণ রিট মামলা দায়ের করা হয়েছে। গত বছর শিশুদের সুরক্ষায় পাস হয়েছে শিশু আইন ২০১৩। তার পরও শিশুদের ওপর নির্যাতন বন্ধ হচ্ছে না।