কম খরচে আধুনিক চিকিৎসাযন্ত্র

অন্যান্য দিনের মতো গৃহকর্মী মা কাজে বেরিয়েছেন৷ আর শিশুসন্তান রাজিয়ার খেলাও শুরু হয়৷ কিন্তু মাটিতে থাকা একটি জর্দার কৌটা ধরতেই ঘটে বিস্ফোরণ৷ প্রাণে বেঁচে গেলেও ডান হাতের কবজির নিচের অংশ উড়ে যায় রাজিয়ার৷
রাজধানীর কামরাঙ্গীরচরে ২০০৫ সালের এ ঘটনাকে ছোট্ট রাজিয়া ভবিতব্য মেনে নিয়ে বড় হতে থাকে৷ ২০১২ সালে রাজিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োমেডিকেল ফিজিকস ও টেকনোলজি বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক খোন্দকার সিদ্দিক-ই-রাব্বানীর৷ তিনি ভাবলেন, ওকে ঈদে উপহার হিসেবে একটা কৃত্রিম হাত বানিয়ে দেবেন৷ কয়েকজন শিক্ষার্থীকে সঙ্গে নিয়ে তৈরি করলেন রাজিয়ার নতুন হাত৷
এখন ওই বিভাগেই কাজ করে রাজিয়া৷ লিখতে পারে, কম্পিউটারে টাইপ করতে পারে, এমনকি ইলেকট্রনিকসের গুরুত্বপূর্ণ ঝালাইয়ের কাজও করতে পারে। দুই হাজার টাকার কম খরচে একটি প্লাস্টিকের হাতের বুড়ো আঙুলটি স্প্রিং দিয়ে যুক্ত করে রাজিয়ার জন্য হাতটি বানিয়েছেন অধ্যাপক খোন্দকার সিদ্দিক-ই-রাব্বানী।

খোন্দকার সিদ্দিক-ই-রাব্বানী
খোন্দকার সিদ্দিক-ই-রাব্বানী

প্রযুক্তি নিয়ে নাড়াচাড়া ও গবেষণা করার বদৌলতে এমন নানা কিছু বানিয়েছেন তিনি৷ লক্ষ্য কম খরচে চিকিৎসার যন্ত্রপাতি তৈরি এবং তা সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজ গবেষণাগারে বসে প্রথম আলোকে বলেন, ‘এক্স-রে ও ইসিজি আবিষ্কারের ১০০ বছর পরেও পৃথিবীর ৮০ শতাংশ মানুষ এই সুবিধা থেকে বঞ্চিত৷’ এ জন্য উন্নত বিশ্বের উদ্ভাবিত চিকিৎসা উপকরণের উচ্চমূল্যকে দায়ী করেন রাব্বানী৷ তাঁর ধারণা, ‘আমরা নিজেরা যদি এই যন্ত্রগুলো বানাতে পারি, তাহলে সেগুলো সাশ্রয়ী হবে এবং তা আমাদের সংস্কৃতিবান্ধবও হবে।’
হৃদ্যন্ত্রের ওঠা-নামা পর্যবেক্ষণ করার জন্য তাঁর দলের উদ্ভাবিত কম্পিউটারাইজড ইসিজি যন্ত্র এর একটি উদাহরণ৷ মাত্র সাত ইঞ্চি আকারের এই যন্ত্র যেকোনো কম্পিউটারের সঙ্গে লাগিয়ে নিলে সেটি সম্পূর্ণ ইসিজি যন্ত্র হয়ে যায়। হৃদ্যন্ত্রের উত্থান-পতনের ছবি সাধারণ কাগজেই প্রিন্ট করা যায়। শুধু তা-ই নয়, ইন্টারনেটের সঙ্গে যুক্ত থাকলে রোগীর ইসিজি পৃথিবীর যেকোনো প্রান্ত থেকে সরাসরি পর্যবেক্ষণ করা যায়৷ কম্পিউটার ছাড়া সম্পূর্ণ যন্ত্রটির দাম পড়ে মাত্র ৪০ হাজার টাকা৷
নিউমোনিয়ার ক্ষেত্রে শিশুদের শ্বাস-প্রশ্বাসের হিসাব নেওয়ার প্রয়োজন হয়৷ কিন্তু প্রচলিত যন্ত্রের বিভিন্ন কেব্ল ও বিদঘুটে জিনিসপত্র শিশুদের শরীরে লাগানো হলে শিশুরা ভয় পেয়ে যায়৷ এ কারণে তার শ্বাস-প্রশ্বাসের প্রকৃত চিত্র পাওয়া যায় না৷ অধ্যাপক রাব্বানী এই সমস্যার সমাধান করেছেন সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে৷ তাঁর উদ্ভাবিত স্বয়ংক্রিয় শ্বাস-প্রশ্বাস মনিটরিং ডিভাইসটিতে ইলেকট্রোড প্যাড (অনেকটা রক্তচাপ মাপার প্যাডের মতো) শিশুর মা তার হাতে পরে নিতে পারেন৷ তারপর সেটি শিশুর বুকে বা পিঠে স্পর্শ করলে কম্পিউটারের পর্দায় শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে ফুসফুসের পরিবর্তনের গ্রাফ ফুটে ওঠে, যেখান থেকে অন্যান্য হিসাব-নিকাশও করা যায়৷ এই কাজটি করার জন্য রাব্বানী একটি নতুন কৌশল উদ্ভাবন করেছেন, যার নাম ‘ফোকাসড ইমপিড্যান্স মেথড’৷ শরীরের ভেতর খুবই অল্প স্থানে সামান্য পরিমাণ বিদ্যুৎ প্রবাহিত করে সেটির পরিবর্তন থেকে কাঙ্ক্ষিত বিষয় বের করা এই কৌশলের মূল সূত্র৷ এখন ফুসফুসে পানি জমা বা স্তন ক্যানসার শনাক্তকরণে এই পদ্ধতি প্রয়োগের চেষ্টা করছেন গবেষকেরা৷
ইসিজি ও স্বয়ংক্রিয় শ্বাস-প্রশ্বাস মনিটরিংয়ের যন্ত্র দুটিই কার্যকারিতার সাপেক্ষে অতিসম্প্রতি সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগের সনদ লাভ করেছে৷
এ দুটি যন্ত্র সরাসরি কম্পিউটার-ইন্টারনেটে যুক্ত করা যায় বলে এর মাধ্যমে টেলিমেডিসিনের বিস্তার হওয়া সহজ৷ এ লক্ষ্যে এরই মধ্যে

ইলেকট্রনিক স্টেথিস্কোপ তৈরি করা হয়েছে৷ ইন্টারনেট-সুবিধা আছে, এমন স্থানে রোগীর গায়ে স্টেথি ধরলে সেটির সংকেত পৌঁছে যাবে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কানে৷
অধ্যাপক রাব্বানীর উদ্ভাবিত আরও কিছু স্বল্পমূল্যের কিন্তু অত্যাধুনিক চিকিৎসাযন্ত্রের মধ্যে রয়েছে ডায়াবেটিসের রোগীদের পায়ের চাপের বিস্তার পরিমাপের জন্য ডায়নামিক পেডোগ্রাফ, এক্স-রে ভিউবক্সের ওপর ডিজিটাল ক্যামেরা লাগিয়ে সেটি সরাসরি দূরবর্তী চিকিৎসকের কাছে পাঠানো কিংবা হাত-পা অতিরিক্ত ঘামা থেকে পরিত্রাণের বৈদ্যুতিক যন্ত্র৷ এর কয়েকটি ইতিমধ্যে দেশের সীমানা ছাড়িয়ে পাকিস্তান, নেপালের মতো দেশেও ব্যবহৃত হচ্ছে৷
আমাদের দেশে রোগব্যাধির বিস্তারের একটি বড় কারণ বিশুদ্ধ পানির অভাব। লবণাক্ততা, আর্সেনিক দূষণের কারণে অনেক ক্ষেত্রেই বিশুদ্ধ পানির সংকট রয়েছে। সূর্যের আলো ও তাপ ব্যবহার করে বৃষ্টির পানিকে জীবাণুমুক্ত করার একটি সহজ কৌশল বের করেছেন অধ্যাপক রাব্বানীর নেতৃত্বে গবেষকেরা৷ এই পদ্ধতিতে মাত্র দুই ঘণ্টার তাপে ১০-১২ লিটার পানিকে জীবাণুমুক্ত করা যায়।
প্রকৌশলী স্ত্রী গুলশান আরা বেগম, মেয়ে অণুজীববিজ্ঞানী পিউল সানজানা রাব্বানী ও কম্পিউটার প্রকৌশলী ছেলে হ্রাদ মুআসির রাব্বানীকে নিয়ে ফরিদপুরের সন্তান অধ্যাপক রাব্বানীর সংসার৷ সেই সংসারেরই বর্ধিত অংশ হলো তাঁর নেতৃত্বে গবেষণায় নিয়োজিত ৩০ জনের বেশি এমএসসি ও পিএইচডি ছাত্র এবং সহশিক্ষক৷ এর আগে আরও প্রায় ৮০ জন এমএসসি ও পিএইচডি করেছেন তাঁর তত্ত্বাবধানে। উদ্ভাবন, উন্নয়ন ও প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে আমাদের দেশের প্রযুক্তিবৈষম্য কমিয়ে আনার স্বপ্ন দেখেন তিনি।
আমিই বাংলাদেশ নিয়ে পরামর্শ ও তথ্য যোগাযোগ: [email protected]