আমার জীবনটাই যেন সিনেমা

সর্বকালের অন্যতম সেরা ফুটবলার ডিয়েগো ম্যারাডোনা৷ জন্ম ১৯৬০ সালের ৩০ অক্টোবর আর্জেন্টিনার বুয়েনস এইরেসে। ম্যারাডোনার নেতৃত্বে আর্জেন্টিনা ১৯৮৬ সালের বিশ্বকাপ ফুটবলের শিরোপা জেতে। ওই বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে তাঁর জোড়া গোলের একটি ‘গোল অব সেঞ্চুরি’র মর্যাদা পায়, আর অন্যটি ‘হ্যান্ড অব গড’ হিসেবে ব্যাপক আলোচিত। ফিফার বিশ শতকের সেরা ফুটবলারের তালিকায় তিনি ও ব্রাজিলের পেলে যৌথভাবে প্রথম স্থান অধিকার করেন৷

ডিয়েগো ম্যারাডোনা
ডিয়েগো ম্যারাডোনা

মাঝেমধ্যে আমি চিন্তা করি, আমার পুরো জীবনই যেন এক সিনেমা৷ সিনেমার রিলে যেন আমার জীবনের সব ছবি ধারণ করে রাখা আছে৷ সবাই ছোটবেলায় বিখ্যাত কাউকে অনুসরণ করে৷ আমার ছোটবেলায় আর্জেন্টিনায় সত্যিকারের বিখ্যাত অনুকরণীয় ফুটবলার কেউ ছিল না৷ ফুটবল ছিল তখন আর্জেন্টিনার গরিব আর বস্তিতে থাকা ছেলেদের মুক্তির একটা বড় উপায়৷ দারিদ্র্যের হাত থেকে বাঁচতে আমরা ফুটবলকে বেছে নিতাম৷ বুয়েনস এইরেসে আমরা খুব ছোট্ট একটা বাড়িতে থাকতাম৷ ছাদ দিয়ে বৃষ্টির পানি ঘরে ঢুকে যেত৷ আমার বয়স যখন তিন, তখন আমার এক কাজিন আমাকে একটা চামড়ার বল উপহার দেয়৷ সেটাই ছিল আমার প্রথম বল৷ আমি সেই বলটিকে বুকে জড়িয়ে ঘুমাতাম।
আমার বাড়ির পেছনেই ছিল চতুর্থ লিগের এক ফুটবল দলের স্টেডিয়াম৷ আমি সারা দিন এলাকার আনাচকানাচে ফুটবল খেলতাম৷ সন্ধ্যায় অন্য সব ছেলেপেলে বাড়ি ফিরে গেলে আমি আরও খেলতাম৷ অন্ধকার হওয়ার ঘণ্টা দুয়েক পরও আমার পায়ে ফুটবল থাকত৷ অন্ধকারে আমি চোখে কিছুই দেখতাম না৷ সে জন্য আমি শুধু সামনের দিকে বল কিক করে যেতাম৷ আমি দুটি কাঠি দিয়ে গোলপোস্ট বানাতাম৷ অন্ধকারে সেই গোলপোস্টের অদৃশ্য জালে কিকের পর কিক করে যেতাম৷ এর বছর দশেক পর, যখন আমি প্রথম ক্লাব আর্জেন্টিনো জুনিয়র্সের হয়ে চুক্তি করি, তখন বুঝেছিলাম অন্ধকারে সেই ফুটবলচর্চা আমার কত কাজে লেগেছে৷ আমার প্রথম আয় করা টাকা দিয়ে আমি এক জোড়া ট্রাউজার কিনেছিলাম৷
আমার জন্ম বুয়েনস এইরেসের সবচেয়ে দারিদ্র্যপীড়িত অংশ ফ্যাবেল ফিওরিটোতে৷ সেই অঞ্চলের দারিদ্রের মাত্রা আর আমার ছোটবেলার বন্ধুরা এখনো সেই আগের মতোই আছে৷ শুধু রাজনীতিবিদ আর সরকারি লোকেরাই দিনকে দিন ধনী হচ্ছে৷ আমার সামনেও ধনী হওয়ার অনেক সুযোগ ছিল৷ কিন্তু আমি সেই সুযোগকে ‘না’ করে দিই৷ আমার ‘না’ বলার পেছনে যুক্তি ছিল, আমাকে ধনী হতে হলে গরিবের কাছ থেকে চুরি করতে হবে৷
আমি একবার গরিবদের কথা বলার জন্য আর্জেন্টিনার রাজনীতিতে যোগ দিয়েছিলাম, কিন্তু কেউ আমার একটি কথাও শোনেনি৷ আর্জেন্টিনা, ভেনেজুয়েলা, ব্রাজিল কিংবা কিউবা সব জায়গাতেই একই সমস্যা—দারিদ্র। ধনী দেশগুলো জন্য আমাদের এই দীনতা৷
এটা সত্য, কোনো কিছু বদলে দেওয়া বেশ কষ্টকর৷ কিন্তু এটাও গুরুত্বপূর্ণ যে আমরা সেই কুশাসনের বিরুদ্ধে কথা বলতে জানি৷ কেউ গরিবদের পক্ষে কথা বলে না৷ সেটা স্বয়ং পোপ থেকে শুরু করে সব দেশের রাজনীতিবিদেরা৷ বার্লিন ওয়াল ধ্বংসের পরে সারা পৃথিবীতে দারিদ্র্যের সংখ্যা বেড়েছে নয় গুণ৷ এদের দেখার কেউ নেই৷
আমি সব সময় আমার বাবার কথা মনে আনি৷ বাবা যখন কাজ শেষ করে বাড়ি ফিরতেন, আমরা তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকতাম৷ আট সন্তানের জন্য তিনি বেশি কিছু আয়ও করতে পারতেন না৷ আমরা চুপ করে বাড়িতে বসে থাকতাম৷ আমাদের কোনো খাবার থাকত না৷ আমাদের কষ্ট কেউ বুঝবে না৷ আপনি যদি ক্ষুধার্ত না হন, তাহলে আমার কষ্ট বুঝতে পারবেন না৷ আমার বোন কম খেত, যেন আমি রাতের বেলায় বেশি খেতে পারি৷ এমন পরিস্থিতিতে আপনার অন্য মানুষের প্রতি মায়া, মমতা আর ভালোবাসা তৈরি হবে৷ আমার মা পেটব্যথার ভান ধরে কিছু খেতেন না৷ তিনি সেই খাবার তাঁর সন্তানদের জন্য রেখে দিতেন৷ পাত্রের শেষ দানাটুকু পর্যন্ত তিনি আমাদের দিয়ে দিতেন৷ এই কষ্ট নিয়েই আমার বেড়ে ওঠা৷ আমার মা আমাকে মিথ্যা বলে খাওয়াতেন৷ কেউ কেউ একে কল্পকাহিনি বলে উড়িয়ে দেয়৷ কিন্তু আমার কাছে দরিদ্রতাই সত্য, বাস্তবতা৷ আমি সেসব কষ্টের সময়ের কথা ভুলিনি৷ আমি যে ভুলতে পারব না৷ আমার বাবা কাভানটাকা মার্কেটে কাজ করতেন৷ তিনি সব সময় ভারী ব্যাগ বহন করতেন৷ বৃদ্ধ বয়সেও তিনি ঘাড়ে ব্যাগ টানতেন৷ বাবা যখন বাড়ি ফিরতেন, তাঁর পিঠ আর ঘাড়ে বরফের ব্যাগ রেখে দিতেন মা৷ আমরা ভাইবোনেরা অবাক হয়ে তা দেখতাম৷
আমি ছোটবেলায় কখনো জন্মদিন উদ্‌যাপন করতে পারতাম না৷ আমাদের কখনোই টাকাপয়সা হাতে থাকত না৷ জন্মদিনে আমার পরিবার, বন্ধু, আত্মীয়স্বজন আমার গালে চুমু দিত৷ সেই চুমুই ছিল আমার জন্য বড় উপহার৷
আমি ম্যারাডোনা, যে কিনা গোল করতে পারে, আবার ভুল করতে জানে৷ আমি সব বাধা নিজের মতো করে লড়তে জানি৷ আমার মা সব সময় চিন্তা করতেন আমিই সেরা৷ নিজের ওপর বিশ্বাস রাখাই সবচেয়ে কঠিন শ্রমের কাজ৷ আমি ছোটবেলা থেকে আমার মায়ের বিশ্বাসকে শক্তভাবে ধারণ করেছি৷ ফুটবল মাঠে বলে পেছনে দৌড়ানোই ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে বড় সুখের স্মৃতি৷ সমালোচকেরা আমার নামে অনেক কিছুই বলে৷ কিন্তু কেউ বলতে পারবে না আমি ঝুঁকি নিতে পারি না৷
ম্যারাডোনার আত্মজীবনী এল ডিয়েগো ও সার্বিয়ান সংবাদপত্র পলিটিকায় দেওয়া ম্যারাডোনার সাক্ষাৎকার অবলম্বনে লিখেছেন জাহিদ হোসাইন খান