স্বেচ্ছাসেবক হয়ে ব্রাজিলের মাঠে

এবারের ফিফা বিশ্বকাপ ফুটবলের অংশীদার ছিলেন বাংলাদেশের এক শিক্ষার্থী। স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিএর শিক্ষার্থী রেজাউল হোসেন ৪৮দিন ব্রাজিলে কাটিয়ে দেশে ফিরলেন। শুনুন সেই গল্প।

ব্রাজিলে এক আনন্দ–আড্ডায় লেখকসহ বিভিন্ন দেশের স্বেচ্ছাসেবীরা
ব্রাজিলে এক আনন্দ–আড্ডায় লেখকসহ বিভিন্ন দেশের স্বেচ্ছাসেবীরা

৪ জুন ২০১৪। ঘড়িতে দুপুর ১২টা হলেও আবহাওয়া দেখে মনে হচ্ছে সকালের মিষ্টি রোদ। একটুতেই মন ভালো হয়ে গেল। ভাবছেন জুন মাসে তো ছিল কাঠফাটা রোদ— নিশ্চয়ই এমন আবহাওয়া আমি স্বপ্নে দেখেছি? না। স্বপ্ন নয়। বরং এক বছর ধরে দেখা স্বপ্নকে সত্যি করার অভিজ্ঞতাই বলছি আপনাদের। এটা ছিল লাতিন আমেরিকার দেশ ব্রাজিলের রিও ডি জেনিরো শহরের আবহাওয়া। সেখানে আমি গিয়েছিলাম ‘গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ’-এ (ফুটবল বিশ্বকাপ ২০১৪) ফিফা মনোনীত একজন স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে।
রিওতে পা রেখেই ভুলে গেলাম আমি ৩৭ ঘণ্টা বিমান (ট্রানজিটসহ) ভ্রমণ করে বাংলাদেশ থেকে উড়ে এসেছি ব্রাজিলে। উড়ে এলেও জুড়ে বসার জন্য একটা ট্যাক্সি ঠিক করতে গিয়ে হাঁপিয়ে উঠলাম। ড্রাইভারের সঙ্গে ইংরেজিতে কথা বলছি, কিছুই সে বুঝতে পারছে না! মনে হচ্ছিল এই ব্রাজিলে আমি বুঝি অন্য গ্রহের কেউ। বাংলা না হয় বোঝে না, তবে ইংরেজি জানবে না সেটা ভাবিনি। অথচ ফিফার ইন্টারভিউ দেওয়ার সময় ইংরেজিতে চটাং চটাং কথা বলতে পারাতেই আমাকে নির্বাচন করেছে তারা। আসলে এখানে পর্তুগিজ ভাষার বাইরে বাংলা আর ইংরেজিতে তেমন ফারাক নেই। এরপর ব্রাজিলে থেকেছি পুরো ৪৮ দিন। রিও ডি জেনিরোতে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপের ফাইনালসহ মোট সাতটি খেলার সবগুলো দেখেছি গ্যালারিতে কর্তব্য পালন করতে করতেই। এর মধ্যে প্রয়োজনীয় কিছু পর্তুগিজ শব্দ শিখে নিয়েছি। যেমন ধন্যবাদ বলতে ব্যবহার করেছি ‘ওবরিগাদো’, ‘বেম ভিন্দ’ বলেছি দর্শকদের স্বাগত জানাতে।

ব্রাজিলের সাবেক ফুটবলার জুনিনহোর  সঙ্গে লেখক (ডানে)
ব্রাজিলের সাবেক ফুটবলার জুনিনহোর সঙ্গে লেখক (ডানে)

ব্রাজিল ফুটবল বিশ্বকাপে মোট ১৪ হাজার স্বেচ্ছাসেবকের ১৩ হাজারই ছিলেন ব্রাজিলের তরুণেরা। বাকি এক হাজার স্বেচ্ছাসেবক ছিলেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশের। এক হাজার জনের একজন হতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে হচ্ছিল। বাংলাদেশ থেকে আমি ছাড়া দক্ষিণ এশিয়ার অন্য কোনো দেশের স্বেচ্ছাসেবক আমার চোখে পড়েনি। শুনেছি নেপালের একজন ছিলেন, তবে অন্য শহরে। এই এক হাজার স্বেচ্ছাসেবক ফিফা বেছে নেয় পাঁচ ধরনের পরীক্ষার মাধ্যমে।
প্রতি বিশ্বকাপ শুরুর এক বছর আগে ফিফা স্বেচ্ছাসেবক বাছাই-প্রক্রিয়া শুরু করে। অনলাইনে ফিফার (www.fifa.com) ওয়েবসাইটে গিয়ে নির্ধারিত সময়ে আবেদন করতে হয়। আমি খবরটি পেয়েছিলাম একটি ফেসবুক গ্রুপের মাধ্যমে। যেখানে বিভিন্ন দেশের ফুটবল-ভক্তরা সারা বছরের ফুটবল নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা করে থাকে। এখানেই দক্ষিণ আফ্রিকা ২০১০ বিশ্বকাপে স্বেচ্ছাসেবক থাকা এক বিদেশির সঙ্গে পরিচয় হয় আমার। তাঁর কাছে জেনেই আমি অনলাইনে ফিফার ওয়েবসাইটে সাত পাতার একটি আবেদন ফরম পূরণ করি। এরপর হঠাৎ একদিন দেখলাম আমার ই-মেইলে ফিফার একটি মেইল। পড়ে বুঝলাম তারা আমাকে প্রাথমিকভাবে নির্বাচন করেছে পরীক্ষার জন্য। এরপর নির্ধারিত তারিখে অনলাইনে স্কাইপে ২৮ মিনিটের ভিডিও ইন্টারভিউ দিলাম ইংরেজি ভাষায়। তবে দুই লাখ আবেদনকারী শুনে নির্বাচিত হওয়ার আশা ছেড়েই দিয়েছিলাম। কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে এক মাস পর একটি মেইল এল যে আমি এই ধাপেও নির্বাচিত হয়েছি। এবার অনলাইন ট্রেনিং নামে মোট চারটি (ফিফা বিশ্বকাপ, ব্রাজিল ফুটবল, স্বেচ্ছাসেবকের কাজ ও ব্রাজিলের স্টেডিয়াম) বিষয়ের ওপর পড়তে হলো। এরপর সেই বিষয়গুলোর ওপর বসলাম আবার পরীক্ষা দিতে। এবারও নির্বাচিত হয়ে ফাইনাল পরীক্ষা দিলাম ভাষা দক্ষতা বিষয়ে। এখানে মূলত ইংরেজির দক্ষতা যাচাই করল। পাশাপাশি আমি কোন সময় পর্যন্ত কাজ করতে পারব, কোন শহরের কোন পজিশনে কাজ করতে চাই লিখে দিতে হলো।
এরপর আবারও দেড় মাসের অপেক্ষা। সবশেষ এক হাজারজনের মধ্যে আমি নিজেকে আবিষ্কার করলাম ৯৭ ভাগ নম্বর পেয়ে উত্তীর্ণ হিসেবে। আরও জানলাম আমাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শহর রিও ডি জেনিরোতে।
হাতে বাংলাদেশের পতাকা। ৭-৯ জুন ব্রাজিলের রিও শহরে আমাদের কাজের একটা প্রশিক্ষণও হলো। স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে আমার দায়িত্ব ছিল গ্যালারির একটি নির্ধারিত জায়গায় আগত দর্শকদের স্বাগত জানানো এবং আসন খুঁজে দেওয়া। আগেই দর্শকেরা চলে আসত বলে আমার কাজ মোটামুটি খেলা শুরুর আগেই শেষ হয়ে যেত। এর পরও দায়িত্বে থাকতে হতো দর্শকদের নানা সমস্যার সমাধান করতে। তবে এর ফাঁকে খেলাগুলোও দেখা হতো ঠিকঠাক।
যাদের খেলা টেলিভিশনের পর্দায় দেখেই চোখ জুড়িয়েছি, তাদেরই দেখছি সামনে থেকো—এ এক বিরাট বিস্ময়!
রিওতে প্রথম খেলা ছিল ১৫ জুন, আর্জেন্টিনা বনাম বসনিয়ার। এরপর একে একে দেখেছি চিলি-স্পেন, ফ্রান্স-ইকুয়েডর, রাশিয়া-বেলজিয়াম, কলম্বিয়া-উরুগুয়ে, ফ্রান্স-জার্মানি ম্যাচ। আর সব শেষে ১৩ জুলাই সমাপনী অনুষ্ঠান ও আর্জেন্টিনা-জামার্নির ফাইনাল। হাজার হাজার মাইল দূর থেকে উড়ে গিয়ে ব্রাজিলের রিও ডি জেনিরোর মারাকানা স্টেডিয়ামে আমি যেন জুড়েই বসলাম। পুরো ৪৮টা দিন কাটালাম খেলার মাঠ আর ব্রাজিলের দর্শনীয় স্থানগুলোতে।
ফিফার শর্ত মেনে চলায় হাতের কাছে এত্ত সব তারকার দেখা পেয়েও ছবি তুলতে পারিনি। তবে বন্ধুত্ব হয়েছে অনেক দেশের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে। নিয়মিত কথা হচ্ছে। খেলা শেষ হয়ে গেছে। আমিও ফিরে এসেছি বাংলাদেশে।
তবে ঘোর যেন কাটছেই না। আলো ঝলমলে রাত আর লাখ লাখ দর্শকের গর্জন বারবার আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে মারাকানার সবুজ ঘাসে, কোপাকাবানা সৈকতে, হাজার হাজার ফুট উঁচুর ক্রাইস্ট রেডিমার মূর্তির সামনে, রিও ডি জেনিরোর পথে পথে। আমি হাঁটছি আর আমার গলায় ঝুলছে ফিফা অফিশিয়াল ভলান্টিয়ার লেখা কার্ড।