চা-বাগানের উইপোকা দমন

মাইনউদ্দীন আহমেদ
মাইনউদ্দীন আহমেদ

চা-বাগানের শত্রু উইপোকা। আর তা নিধন করতে পারলে উৎপাদনও বাড়ে। এ জন্য সবচেয়ে ভালো পদ্ধতি হলো উইপোকার রানিকে ধ্বংস করা। কিন্তু এই ‘সহজ’ কাজটি করাটাই কঠিন। কারণ উইপোকার রানি খু্ব সহজে পাওয়াটাই কঠিন।
তাই কঠিন কাজটি বাদ দিয়ে বছরে তিনবার চা-বাগানে উইপোকানাশক রাসায়নিক দিয়ে বছর বছর উইপোকার বিরদ্ধে লড়াই করা বেশির ভাগ চা-বাগানের রীতি।
তবে সেই কঠিন কাজটি সহজ করে দিয়েছেন বিজ্ঞানী মাইনউদ্দীন আহমেদ। তাঁর উদ্ভাবিত পদ্ধতিতে সহজেই উইপোকার রানি খুঁজে বের করে নির্মূল করা যায়। এই পদ্ধতিতে রানি উইপোকার পছন্দের খাবার দিয়ে খাদ্য ফাঁদ (ফুড ট্র্যাপ) তৈরি করে মাটির কয়েক ফুট নিচে উইপোকার ঢিবি শনাক্ত করা হয়। এরপর কীটনাশক, গরম পানির মিশ্রণ দিয়ে রানি ধ্বংস করে উইপোকার পুরো আবাস নির্মূল করা সম্ভব হয়।
উইপোকার কলোনিতে শুধু একটিই রানি থাকে। যা অন্য সাধারণ উইপোকা থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। আকারে প্রায় ১০-১২ সেন্টিমিটার। এটি প্রতিদিন, অর্থাৎ প্রতি ২৪ ঘণ্টায় প্রায় ৮০ হাজার ডিম পাড়ে। একটি রানি উইপোকা প্রায় ৫০ বছর বাঁচে। উইপোকার সাম্রাজ্যে একক কেন্দ্র হলো এই রানি। একে চিহ্নিত ও ধ্বংস করতে পারলে উইপোকার পুরো কলোনিই নষ্ট করা সম্ভব। আলাদাভাবে বারবার উইপোকা মারার জন্য কীটনাশক প্রয়োগের আর প্রয়োজন থাকে না।
বিশিষ্ট চা গবেষক মাইনউদ্দীন আহমেদ বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালকের দায়িত্ব পালন করছেন। উইপোকা দমনে এই বিশেষ পদ্ধতি উদ্ভাবন করে তিনি পেয়েছেন আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি।
মাইনউদ্দীনের উদ্ভাবনী প্রযুক্তি বা কৌশলগুলো হচ্ছে চায়ের কোন জাতে উইপোকা কম ধরে, তা খুঁজে বের করা। চায়ের নতুন আবাদ এলাকায় উইপোকা আছে কি না, থাকলে কী ধরনের উইপোকা আছে, তা শনাক্ত করা। এরপর চা-গাছ রোপণ। ভূমির গঠনশৈলী বুঝে কোন মাটিতে চা-গাছের কোথায় উইপোকা কেমন ধরে, তা বিবেচনায় রেখে নির্বাচিত জাত রোপণ করা। চায়ের প্রধানতম পোকা চায়ের মশা, লাল মাকড়সা (রেড স্পাইডার), উইপোকাসহ অন্যান্য ক্ষতিকর পোকামাকড় নিয়ন্ত্রণে টেকসই প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও তা সরেজমিনে ব্যবহার করতেই মাইনউদ্দীনের আগ্রহ। তিনি সমন্বিত বালাইনাশক পদ্ধতি অবলম্বন করেন। এতে রয়েছে আবর্জনা পরিষ্কার ও সুষ্ঠু নালা তৈরি, উইপোকার জাত শনাক্ত এবং উইপোকাকে অন্য পোকা দিয়ে খাওয়ানো ইত্যাদি। এই কৌশলসমূহ উদ্ভাবন করেই তিনি দায়িত্ব শেষ করেননি। বিভিন্ন বাগান পরিদর্শন, চা-আবাদকারীদের নিয়ে কর্মশালা, সেমিনার-সিম্পোজিয়ামের মাধ্যমে তাঁর এই কৌশল পৌঁছে দিয়ে থাকেন।
উইপোকা দমনে মাইনউদ্দীনের নতুন কলাকৌশল চা উৎপাদনে ভালো ভূমিকা রেখে চলেছে। বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তাঁর উদ্ভাবিত পদ্ধতি ব্যবহার করে চা উৎপাদন বৃদ্ধির সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।
ভারতের আসাম রাজ্যের টোকলাই টি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের শতবর্ষ উৎসব উদ্যাপিত হয় ২০১১ সালের ২২ থেকে ২৪ নভেম্বর। ভারত ছাড়াও শ্রীলঙ্কা, কেনিয়া, চীন, জাপান, যুক্তরাষ্ট্রসহ ২৭-২৮টি দেশের চা বিজ্ঞানী, গবেষক ও কর্মকর্তারা সম্মেলনে যোগ দেন। সেখানে মাইনউদ্দীন তাঁর গবেষণাপত্রে চা-বাগানে পোকামাকড় দমন ব্যবস্থাপনায় পরিবেশসম্মত উপায় সম্পর্কে তাঁর নিজের উদ্ভাবিত পদ্ধতি ব্যাখ্যা করেন। সর্বমহলে তাঁর গবেষণাপত্র প্রশংসিত হয়। আন্তর্জাতিক এ সম্মেলনে তিনি দ্বিতীয় পুরস্কারে ভূষিত হন।
উইপোকা ছাড়াও চা-গাছের শত্রু মশা, লাল মাকড় প্রভৃতি চায়ের উৎপাদন প্রায় ১৫ শতাংশ কমিয়ে দেয়। পোকামাকড় দমনে বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করলে পরিবেশ দূষণ ও ব্যবহৃত রাসায়নিকের ঝুঁকি তো আছেই, সেই সঙ্গে আছে খরচের বোঝা। বিজ্ঞানী মাইনউদ্দীনের আবিষ্কার এ দুই সমস্যার সমাধান এনে দিয়েছে। এখানেই তাঁর ব্যতিক্রমী অর্জন।
মাইনউদ্দীন আহমেদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৮৫ সালে প্রাণিবিদ্যার কীটতত্ত্বে প্রথম শ্রেণিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি ও ১৯৯১ সালে যুক্তরাজ্যের লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইম্পেরিয়াল কলেজ অব সায়েন্স, টেকনোলজি অ্যান্ড মেডিসিন থেকে ফলিত কীটতত্ত্বে এমএস ডিগ্রি লাভ করেন। ‘চায়ের উইপোকা দমন কৌশল’ বিষয়ে গবেষণার মাধ্যমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৯৯ সালে তিনি পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এবং খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী তাঁর তত্ত্বাবধানে এমএস এবং এমফিল ডিগ্রি লাভ করেন। বতর্মানে তাঁর অধীনে তিনজন গবেষক বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি গবেষণারত আছেন। এরই মধ্যে বিভিন্ন প্রকাশনাপত্রে তাঁর ৫৯টি পূর্ণাঙ্গ গবেষণা প্রবন্ধ ও অন্য আরও ৩১টি বৈজ্ঞানিক প্রকাশনাসহ মোট ৯৪টি প্রবন্ধ-নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর ‘টি পেস্ট ম্যানেজমেন্ট’ গ্রন্থটি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের সব কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়সহ অস্ট্রেলিয়ার সিডনি, উজবেকিস্তান ও ভারতের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠের অন্তর্ভুক্ত।
মাইনউদ্দীন প্রথম আলোকে বললেন, ‘শিক্ষক বা গবেষক হব এ রকমই ইচ্ছা ছিল। আকাঙ্ক্ষা ছিল নীরবে-নিভৃতে, সৎ ও ভালোভাবে গবেষণা করা। যাতে আমার কাজ মানুষের কল্যাণে লাগে। আমি প্রতিষ্ঠানের কাজটাকে নিজের মনে করি। চায়ের সেবা করা মানে দেশকেই সেবা করা।’
আমিই বাংলাদেশ নিয়ে পরামর্শ ও তথ্য যোগাযোগ : [email protected]