রং হারানো বিবর্ণ এক জীবন (তিন)

(পূর্ব প্রকাশের পর)
তখন সৌদি আরবজুড়ে চলছে উন্নয়নের মহোত্সব। সে কাজ কবে যে শেষ হবে তার বিন্দুবিসর্গও বোঝার কোনো উপায় নেই। মাইলের পর মাইল মরুভূমি ঘিরে গড়ে তোলা হচ্ছে আধুনিক সব শহর। কী নেই সেখানে। মাঝে মাঝে মনে হতো, অকারণেই বুঝি এত সব। সৌদি আরব সরকারের টাকার তো আর কোনো সীমা পরিসীমা নেই। সরকার-রাজপরিবার সর্বত্র টাকার ছড়াছড়ি।
টাকার অপব্যয় দেখে আমার বুকের ভেতর ভীষণ হা-হুতাশ শুরু হয়। ভাবি, আমাদের দেশে যদি এর ছিটেফোঁটাও থাকত, তাহলে তরতর করে কোথায় এগিয়ে যেতাম আমরা। তখনো দেশ নিয়ে ভাবি। ভাবতে খুবই ভালো লাগে আমার। কিন্তু সে ফুরসত আর থাকে না।
নিজের কত রকম সমস্যা সমানে এসে দাঁড়ায় পাহাড়ের মতো। দেশের ভাবনাটা একেবারেই মন থেকে উবে যায়। নানা কষ্টের মধ্যেও উত্সাহ নিয়ে কাজ করে যাই। কিন্তু বেতন ঠিকঠাকমতো মেলে না। মাস গেলে অল্পবিস্তর টাকা পাই। তখন কিছুটা ভালো লাগলেও উত্কণ্ঠা কাটে না। কিছুদিন পর পর বাবা-মার সঙ্গে ফোনে কথা হয়। যখনই কথা বলি, তাঁরা বলেন, ঋণের টাকা ফেরত দিতে হবে। তাঁরা বন্ধকী ব্যবসার নানা রকম কথা শোনান।
কিন্তু দেশে টাকা পাঠাবার জো থাকে না। কারণ, এখানেও থাকা-খাওয়া বাবদ আমার বেশ কিছু টাকা ঋণ হয়েছে। সে টাকা না দিয়ে উপায় থাকে না। আবার নিজেরও তো চলতে হয়। দ্রুত ছয় মাস উড়ে যায় চোখের পলকে। সৌদি আরবের যে শহরে আমার কর্মস্থল সেই শহরের গলিঘুজি চিনে নিতে থাকি। কেউ কেউ আবার মনে করিয়ে দেয়, এখন থেকেই টাকা জমিয়ে রাখো। তোমার ইকামার তো আর ছয় মাস বাকি। নইলে পরে বিপদ হবে।
ভেবে দেখলাম, শুভাকাঙ্ক্ষীরা ঠিক কথাই বলেছে। এসেই শুনেছিলাম, এ দেশে প্রতিবছরই ইকামা নবায়ন করতে হয়। এ জন্য বাংলাদেশিদের প্রায় দেড় লাখ টাকা খরচ পড়ে। এ টাকাও তো জমাতে হবে। আমি নতুন মানুষ, প্রবাসে এত টাকা আমাকে ঋণই দেবে কে।
স্বপ্নগুলো চোখের সামনে সব মিচমার হতে থাকে ধীরে ধীরে। চঙচঙে সময় বলতে আর কিছুই থাকে না। রাতে ঘুমানোর আগে হিসাব কষে দেখি, এখানে থাকা-খাওয়া আর প্রতিবছর ইকামা নবায়ন করে যা জমবে, তাতেও প্রায় চার থেকে সাড়ে চার বছর লেগে যাবে আমার বিদেশ আসার খরচের টাকা তুলতে। সব সময়ই যে ঠিকঠাকমতো কাজ মিলবে, তারও নিশ্চয়তা নেই।
পরিশ্রমের ব্যাখ্যা না-ই বা দিলাম। শেষ রাতে কাজে যেতে হয়। কাজ শেষ হয় আবার রাত নামার পর। বাসায় ফিরে এসে প্রায় প্রতিদিনই কাপড় ধোয়া অনিবার্য হয়ে পড়ে। নির্মাণ সাইডে গেলেই ধুলাবালিতে একেবারে একাকার হয়ে থাকে সব। আবার বাসায় রান্না করতে হয়। বিড়ম্বনার যেন আর শেষ নেই।
যে পরিশীলিত জীবনের খোঁজে বিদেশে আসা, তার আর দেখা মেলে না। সব কিছুই ফ্যাকাশে, বিবর্ণ হয়ে পড়ে। তবুও মাঝে মাঝেই কে যেন স্বপ্ন বুনে দিয়ে যায় বুকের ভেতর। টের পাই, সুবজ বীজতলার মতো অবিন্যস্ত স্বপ্নরা গজিয়ে উঠতে শুরু করেছে আবার।
প্রথম বছরে তেমন কিছুই করতে পারিনি। দ্বিতীয় বছরে কিছু কিছু ঋণের টাকা পরিশোধ করতে শুরু করি। মায়ের গহনা বন্ধক রেখে নেওয়া টাকা পরিশোধ করা হয়নি। চক্রসুদে টাকার অঙ্ক তর বর করে বাড়তে থাকে। তখন আর কোনো ভাবনা নেই মাথায়। শুধু কাজ আর কাজ। কাজ শেষ করে ঘরে ফিরে প্রতিদিনই মনে হতো, অনর্থক এ জীবন। দু-চারটি স্বপ্ন যা-ও গজিয়ে ওঠে, এক মুহূর্তেই মরুর কর্কশ রোদে তা-ও মিইয়ে যায় লাল বালুর গায়ে। তারপর থেকে আর স্বপ্ন দেখতাম না।
আমার এখনো স্পষ্ট মনে পড়ে, শুধু সংসারের জন্য খুবই সামান্য টাকা, দুই ঈদে খরচের জন্য অল্পকিছু টাকা, মায়ের গহনা বন্ধক রেখে নেওয়া টাকা আর ঋণের টাকা শোধ করতে চার বছর আট মাস লেগে গিয়েছিল আমার।
তার পরই স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়তে পেরেছিলাম। মনে হয়েছিল এখন মরে গেলেও আর কোনো কষ্ট নেই। বাবা-মাকে কেউ এসে টাকার জন্য বাজে কথা বলতে পারবে না। মার কথা মনে হতো সবচেয়ে বেশি। কত রাত যে চোখের গলিঘুজি বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়েছে তা আর গুনে শেষ করা যাবে না।
ঋণ পরিশোধের পর আমার বুকের ভেতর নতুন একটি আনন্দের জোয়ার ছিল বেশ কদিন। মুক্তির সাধ তখনো আমার মুখময় লেপ্টানো। এ সময় হঠাত্ একদিন নিচু আর দ্বিধা জড়ানো কণ্ঠে মা বললেন, ‘বাবারে, তোর আব্বা তো অবসরে যাবে সামনের মাসেই।’
আর কিছুই বোঝাতে হলো না। বুঝে নিলাম সামনের মাস থেকেই সংসার দেখা আমার কর্তব্য। তার পর থেকেই অদ্ভুত রকমের এক চাপ বোধ করতাম বুকের ভেতর। বেতন পেতে দেরি হলেই পাগলের মতো হয়ে যেতাম। যে ভাবেই হোক বাবার কাছে টাকা পাঠাতে হবে। কিন্তু কীভাবে টাকার জোগাড় হয়, আর কী কাজে দিন চলে আমার, তার সবই গোপন রেখেছি সবার কাছে। জানি, সে জীবনের কথা বললে হয়তো কেঁদেই মরে যাবেন আমার মা। বাবাও কি কম কষ্ট পাবেন। (ক্রমশ)

কাজী সাইফুল ইসলাম
রিয়াদ, সৌদি আরব