অটোয়ায় পঞ্চকবির গান

সংগীত পরিবেশন করছেন শিল্পী অর্পিতা দাস
সংগীত পরিবেশন করছেন শিল্পী অর্পিতা দাস

ধনুকের টান টান ছিলায় যদিও সৌন্দর্য ও উত্তেজনার আনন্দ থাকে। কিন্তু

সংগীত পরিবেশন করছেন শিল্পী অপূর্ব দাস
সংগীত পরিবেশন করছেন শিল্পী অপূর্ব দাস

তাতে বোধকরি স্বস্তি থাকে না। স্বস্তি পেতে হলে ধনুককে স্থিতাবস্থায় ফিরে আনতে হয়। তেমনই এই সুদূর কানাডার রাজধানী অটোয়ায় প্রবাসী বাঙালিদের অবস্থা। তাদেরকে কর্মব্যস্ততা ও পারিবারিক প্রয়োজনে ধনুকের ছিলার মতোই টান টান থাকতে হয় সবসময়। তাতে প্রাপ্তি আছে বটে। কিন্তু দিনের শেষে সেই স্বস্তি ও শান্তিটুকুর ষোল আনার চার আনা যেন অধরাই থেকে যায়। আর তা মিলতে পারে শুধু বাংলা সাহিত্য, সংস্কৃতি ও সংগীতে। যা তাদের অস্তিত্বের গভীরে প্রোথিত, অন্তরের মণিকোঠায় খোদাইকৃত ও চিন্তা-ভাবনায় আচ্ছন্ন। এর প্রমাণও তারা রেখেছেন বরাবরের মতোই বাংলা ত্রৈমাসিক জার্নাল আশ্রম আয়োজিত বাংলার পঞ্চকবির গানের ব্যতিক্রমধর্মী অনুষ্ঠানে। সেপ্টেম্বরের সাত তারিখে অটোয়ার কার্লটন বিশ্ববিদ্যালয়ের কৈলাস মিতাল থিয়েটার হলে অনুষ্ঠানটি অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠানে যেমন ছিল গান, নাচ, তেমনই ছিল পঞ্চকবিদের সম্পর্কে অতি সংক্ষিপ্ত বিবরণী।
অনুষ্ঠানটি ব্যতিক্রমধর্মী ছিল, এতে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই। কারণ, রক অ্যান্ড রোল, জ্যাজ, হেভি মেটাল গানের বর্তমান এই সময়ে রাশভারী ও গুরুগম্ভীর গান শোনার মতো রুচি ও ফুরসত খুব কম মানুষেরই আছে। এর জন্য দশর্কদেরও সেই মানসিক ধাত ও মেজাজ থাকতে হয়। আর তা যদি হয় স্থানীয় সংস্কৃতিচর্চার প্রতিকূল পরিবেশে, তা হলে তো কথাই নেই। সহজ কাজও জটিল হয়ে পড়ে। যেখানে সংগীত এমনিতেই গুরুমুখী বিদ্যা, তার ওপর নিত্যনৈমিত্তিক প্রয়োজন মিটিয়ে, নানা প্রতিকূলতাকে পেরিয়ে, সময় ও অর্থ খরচ করে এবং সবার ওপরে পঞ্চকবির গানের মতো রাগাশ্রয়ী গানের পরিবেশনায় স্থানীয় কণ্ঠশিল্পী, নৃত্যশিল্পী, যন্ত্রী ও কলাকুশলীরা যে শ্রম, সময় ও আত্মনিবেদন করেছেন এবং সফলভাবে দর্শকদের মাতিয়েছেন তা সত্যিই এক কথায় প্রশংসনীয় বললেও তাদের অবমূল্যায়ন করা হবে।
সংগীতসন্ধ্যাটি ব্যতিক্রমধর্মী হওয়ার আরেকটি কারণ হলো কানাডায় জন্ম নিয়েও শিশুশিল্পী অর্পিতা দাসের পঞ্চকবির গান সহজ, স্বচ্ছন্দ ও সাবলীলভাবে পরিবেশন করা। অর্থাত্ প্রবাসীদের প্রাণান্ত ইচ্ছা থাকলে তাঁদের ছেলেমেয়েদেরও মধ্যেও নিজেদের ফেলে আসা শেকড় প্রোথিত করা যায়। তবে তার জন্য অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষা যে প্রয়োজন তা বলাই বাহুল্য।
অনুষ্ঠানটিতে প্রত্যাশাতীত দর্শকদের উপস্থিতি এটাও প্রমাণ করে যে পরিবেশ পরিস্থিতি যতই প্রতিকূলে থাকুক না কেন, মানুষের কাছে যথোপযুক্ত ভাবে পৌঁছাতে পারলে শেকড়ের সংস্কৃতি, সংগীত তাদের মন ও মননে প্রবিষ্ট করানো বা তা দিয়ে বিমোহিতও করানো যায়। কিন্তু তার জন্য পৃষ্ঠপোষকতা যেমন প্রয়োজন, তেমনই প্রয়োজন নিবেদিত কিছু মানুষ। আরও প্রয়োজন এর ধারাবাহিকতা রক্ষা করার মন, মানস ও দৃঢ়-প্রতিজ্ঞা।

অনুষ্ঠান শেষে শিল্পীদের সঙ্গে কয়েকজন দর্শক
অনুষ্ঠান শেষে শিল্পীদের সঙ্গে কয়েকজন দর্শক

অটোয়ার স্থানীয় কণ্ঠশিল্পী অপূর্ব দাস ও তাঁর মেয়ে অর্পিতা দাসের যৌথ সঙ্গীতসন্ধ্যাটি দুটি পর্বে বিভক্ত ছিল। প্রথম পর্বে পঞ্চকবির গান করেন যৌথভাবে অপূর্ব দাস ও তাঁর মেয়ে অর্পিতা দাস এবং দ্বিতীয় পর্বে লোকজ গান করেন অপূর্ব দাস। উভয় পর্বে উপস্থাপনা করেন ঝলক মজুমদার ও তাপসী দাস। অনুষ্ঠানের শুরুতে আশ্রম এর সম্পাদক কবির চৌধুরীর সূচনা বক্তব্যের পর খুদে নৃত্যশিল্পীসহ অনুষ্ঠানের মূল শিল্পীদের ক্রেস্ট প্রদান করেন ড. মিজান রহমান। এরপর অর্পিতা দাসের কণ্ঠে রবীন্দ্রনাথের ‘আগুনের পরশমনি ছোঁয়াও প্রাণে’ গান দিয়ে মূল অনুষ্ঠান শুরু হয়। উপস্থিত দর্শকদের মূহুর্মূহু করতালির মধ্য দিয়ে পরপর পরিবেশিত হয় রবীন্দ্রনাথের ‘আকাশ ভরা সূর্য তারা’, ‘আমি মারের সাগর পাড়ি দেব’, ‘হার মানা হার পরাব তোমার গলে’, নজরুলের ‘দূর দীপ বাসিনী’, ‘আজো কাঁদে কাননে কোয়েলিয়া’, ডি. এল, রায়ের ‘আজি নুতন রতনে ভূষণে যতনে’, ‘বেলা বয়ে যায়’, অতুল প্রসাদের ‘মেঘেরা দল বেঁধে যায় কোন দেশে’, ও রজনীকান্তের ‘তুমি নির্মল কর মঙ্গল কর’ গানগুলি। এ পর্বে ‘ও আমার দেশের মাটি’ গানটির সঙ্গে দলীয় নৃত্য পরিবেশন করেন খুদে নৃত্যশিল্পীবৃন্দ। নৃত্যশিল্পী আফরোজা খান লিপিও একক নৃত্য পরিবেশন করেন এ পর্বে।
দ্বিতীয় পর্বে ছিল অপূর্ব দাসের একক পরিবেশনা। তিনি মাটির গান, বাঙালির শেকড়ের গানের কয়েকটি গেয়ে দর্শকদেরকে মাতিয়ে তোলেন। ফকির লালন শাহ্, হাছন রাজা ও শাহ্ আবদুল করিমের মোট আটটি জনপ্রিয় গান গেয়ে নিজেও দর্শকদের কাছে প্রিয় হয়ে যান। এ পর্বে যেমন ছিল ‘মানুষ ভজো, মানুষ ধরো’ তেমনই ছিল ‘লোকে বলে, বলে রে ঘর-বাড়ি ভালা না আমার’ এর মতো জনপ্রশংসিত ও সবর্জননন্দিত গানগুলি। অনুষ্ঠানটির শেষের দিকে ‘গ্রামের নওজওয়ান, হিন্দু মুসলমানৃ..আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম’ গানটিতে ছিল আবহমান বাংলার চিরাচরিত রূপ ‘অসামপ্রদয়িকতা’ ও জাত-পাত নির্বিশেষে সকল মানুষের সঙ্গে সুখে-দুঃখে সহাবস্থান। উপস্থিত দর্শকও গানটি শিল্পীর সঙ্গে নেচে গেয়ে আবার ঠিক সেই চেতনাকেই প্রতিধ্বনিত করলেন।
শাহীনুর ইসলাম
অটোয়া, কানাডা