নটবর আকরাম খান-দুই

মা-বাবার সঙ্গে আকরাম খান
মা-বাবার সঙ্গে আকরাম খান

(পূর্ব প্রকাশের পর)
যাই হোক পরিবারের সামনে বড় সমস্যা যেটা দাঁড়াল সেটা হলো-তারপর কোথায়? সাধারণ শিক্ষার বিশ্ববিদ্যালয়, না ভালো কোনো নাচের স্কুল? ছেলে কি বড় হয়ে অধ্যাপক-চিকিৎসক-প্রকৌশলী-ব্যারিস্টার হবে, না নাচের লাইনে গিয়ে সারাজীবন উপোস করার ঝুঁকি নেবে। প্রশ্নটা যে খুব সহজ নয়, হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-​খ্রিস্টান যে কারও পক্ষে, সেটা আমি নিজের পরিবারের অভিজ্ঞতা দিয়েই জানি। যাই হোক, সৌভাগ্যবশত খান পরিবার সিদ্ধান্ত নেন, ছেলে যে রকম মেধার পরিচয় দিয়েছে এরি মধ্যে, এরপর তাকে নৃত্যশিল্পের উচ্চতর জায়গায় পৌঁছুবার সুযোগ না দেওয়া রীতিমত অন্যায় হয়ে যাবে।
আকরাম ভর্তি হলেন লিস্টারের মন্টফোর্ট স্কুল অফ কন্টেম্পরারি আর্টসে। সেখানে কিছুদিন ক্লাস করার পর তিনি এবং তাঁর অধ্যাপকরা বুঝতে পারলেন, মন্টফোর্ট যতই উঁচুমানের শিক্ষাকেন্দ্র হোক না কেন তার মতো মঞ্চ নাচিয়ের জন্য হয়তো খুব উপযোগী নয়। একটু বেশিরকম তাত্বিক প্রতিষ্ঠান সেটি। অর্থাৎ সেখানে নাচের তাত্বিক দিকগুলো শেখানো হয় প্রচুর, কিন্তু আসল নাচটাই শেখানো হয় না তেমন গুরুত্বের সঙ্গে। তত্ব বিষয়গুলোতেও যে খারাপ করছিলেন তা নয়, তবে তাঁরা ভাবলেন তার চেয়ে বরং লিডস বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্গত নর্দান স্কুল অব কন্টেম্পরারি ডান্সে গেলে আকরাম খানের নাচের প্রতিভা আরও দ্রুত বিকাশ লাভের সুযোগ পাবে। শেষ পর্যন্ত হলোও তাই। সেখান থেকে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট ডিগ্রি নিয়ে তিনি উত্তীর্ণ হলেন ইউনিভার্সিটির ইতিহাসের সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে। এত ভালো রেজাল্ট তাঁর আগে বা পরে কেউই করতে পারেনি। সাধে কি ২০০৪ সালে তাঁকে ‘অনারারি ডক্টর অফ আর্টস’ উপাধিতে সম্মানিত করা হয় মন্টফোর্ট স্কুল অফ কটেম্পরারি আর্টস থেকে। তিনি ছিলেন উভয় স্কুলের এক অবিশ্বাস্যরকম সফল ছাত্র। এমন প্রতিভা ব্রিটেনের মতো উন্নত দেশেও বড় বিরল।
গতানুগতিক শিক্ষার প্রচলিত ধারাতে ছেলেমেয়েরা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি-দুটি ডিগ্রি করার পরই চাকরিতে ঢোকে। বিয়েশাদি করে সংসারজীবনে প্রবেশ করে। তারপর একসময় অবসর নিয়ে সূর্যাস্তের সঙ্গে বিলীন হয়ে যায়। কিন্তু সৃষ্টিধর্মী শিল্পকলার জীবনে ওই ডিগ্রিগুলোর মূল্য একটুকরো কাগজের মতোই নির্মূল্য। সর্বোচ্চ ডিগ্রি, সর্বোচ্চ নম্বর, এগুলো সূচনা মাত্র। দুর্গম দুরূহ জীবনের প্রথম সোপান ছাড়া কিছু নয়। অনেক দূরের পথ এ-জীবনে। সত্যিকার ম্যারাথন রেস এখানে। আকরাম খান কথক শেষ করেছেন। পশ্চিমের কন্টেম্পরারি নৃত্যের প্রাথমিক পর্যায়টিও পার হয়েছেন অসাধারণ কৃতিত্বের সঙ্গে। অর্থাৎ তাঁর রক্তের স্রোতে দুটি ভিন্ন যুগ, দুটি ভিন্ন সভ্যতা, একই ধারাতে প্রবাহিত হবার সুযোগ পায়। কিন্তু দুটি ধারাকে একই গ্রন্থিতে আবদ্ধ করে একটা স্বতন্ত্র ধারা, একটা নিজস্ব ধারা সৃষ্টি করতে হয় কেমন করে, সেটি তো শেখা হয়নি। সেই শেখাটির নাম ‘কোরিওগ্রাফি’। শব্দটির বাংলা প্রতিশব্দ আমার জানা নেই, অভিধান আর আন্তর্জাল খুলে কোনো হদিস পেলাম না। অতএব শব্দটা এভাবেই থাক। কোরিওগ্রাফি বলতে আমি যা বুঝি, সংগীতের যেমন স্বরলিপি, নাচেরও তেমনি কোরিওগ্রাফি। যার বর্ণ আর ধ্বনির সঙ্গত দেয় আবহের সমবেত যন্ত্রসংগীত আর মঞ্চের আলোকসজ্জা। সব মিলিয়ে তৈরি হয় একটা গল্প, একটা গীতিময় অঙ্গচালনা। এই অমূল্য শিক্ষাটি কেবল বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সোনালী-রূপালী কাগজের মধ্য দিয়ে আসে না। ওটির জন্যে আকরাম গিয়েছিলেন ইউরোপে। সাতমাসের পূর্ণ বৃত্তি পেয়ে তিনি গিয়েছিলেন এন টেরেসা দ্য মির্সমেকারের ব্রাসেলসভিত্তিক এক্স-গ্রুপ প্রজেক্টের শিক্ষার্থী-সদস্য হিসেবে। সেখানেই পান তিনি কোরিওগ্রাফি জগতের প্রথম পরিচয়। এবার তিনি প্রস্তুত। প্রায়। সৃষ্টির ধর্মই তাই। কখনো কেউ পুরোপুরি প্রস্তুত নয়। এই ক্ষুধার পূর্ণ নিবৃত্তি হবার নয় কস্মিনকালে।
কথা হলো এই চিরন্তন তৃষ্ণাটির উৎস কোথায়? কোন গিরিকন্দর থেকে উদ্ভুত হয় এই তীব্র চেতনা যা তাকে ঈশ্বরের আসনে তুলে নিয়ে যায়? এ প্রশ্নের জবাব হয়তো সবার কাছে এক নয়। আমার ব্যক্তিগত বিবেচনায় এর উৎস মানুষের অন্তরের অন্তঃস্থলে। গভীর গহন কোনো রহস্যপুরিতে। তার সঙ্গে যোগ দেয় তার নিজের জীবন, তার চতুঃপার্শ্বের জীবন। লোকজনের নিত্য চলমান দৈনন্দিনতা। তাদের সকল তুচ্ছতা আর ক্ষুদ্রতার বিচিত্র সংমিশ্রণ। তার অভিজ্ঞতার বলয়তে বাস করা পৃথিবীর নানারঙ্গের নানা ধর্মের ছোট বড় মানুষগুলো। এ সব মিলিয়েই রচনা করে তার মতির মালা, তার সোনার ধানের শস্যভাণ্ডার। সেই সব উপাদানগুলো কতখানি উপস্থিত ছিল আকরাম খানের অস্তিত্বের ভেতর তার খবরও কিছুটা জানা যায় তার ব্যক্তিগত জীবনের কিছু কিছু রেখাচিত্র থেকে।

নৃত্য পরিবেশন করছেন আকরাম খান।
নৃত্য পরিবেশন করছেন আকরাম খান।

অভিবাসী বাঙালি পরিবারের জন্যে সে চিত্র যে খুব মৌলিক বা অস্বাভাবিক তাও তো নয়। পশ্চিম জগতের প্রায় প্রতিটি প্রবাসী পরিবারেই বলতে গেলে একই কাহিনি। দ্বিতীয় প্রজন্ম আর প্রথম প্রজন্মের নিত্য ঠোকাঠুকি। প্রথম প্রজন্ম দেশ ছেড়েও বিদেশকে দেশ মানতে পারলেন না। দ্বিতীয় প্রজন্ম হয়তো কখনোই ‘বিদেশ’ ছাড়া অন্য কোনো দেশকে ‘দেশ’ বলে মানতে রাজি নয়। বাবা-মা রোজ দুবেলা টেবিল চাপড়ে তাদের মনে করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন ‘দেশ’ হলো যেখানে তাঁরা জন্মেছেন, ওরা নয়। তাদের দৈনন্দিন জীবন দুটি সর্পিল পথের সংঘর্ষে নির্মিত। বাড়িতে বাংলা, বাইরে ইংরেজি। বাড়িতে লতা মুঙ্গেশকর আর রুনা লায়লা, বাইরে মাইকেল জ্যাকসন আর এলটন জন। তাদের জীবন কাগজের ভেলার মতো ভাসতে থাকে এপার থেকে ওপারে। কোথাও নোঙ্গর করার উপায় নাই।
আকরামের জীবনেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। তার বাবা সারাদিন হয়তো রেস্টুরেন্টে পড়ে থাকতেন, রাতের বেলাতেও নিশ্চয়ই অনেকটা। ঘরের ভেতর বাবার ভূমিকা ছিল প্রধানত ‘ধমকানো’। বিদেশের সংগ্রামী বাবারা তো তাই করেন সচরাচর। পরীক্ষায় লাড্ডু মারার ইচ্ছা? নিজের কাজকাম ছাইরা বিলাতি পোলামাইয়ার পিছে ঘোরা? ছেলে ওসব শুনতে চায় না, কানে হাত চেপে রাখে। সে শুনতে চায় নতুন সব রক মিউজিক, দেখতে চায় সদ্য-বের হওয়া ভিডিও কিম্বা খেলার মাঠে গিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে খেলতে চায় ফুটবল। প্রবাসের বেশির ভাগ পরিবারেরই প্রায় একই গল্প। বাড়িতে যুদ্ধ, বাইরে মিষ্টি হাসি। গদবাঁধা রদ্দি গল্প-ডাল, বোরিং। কিন্তু আকরামের সৃষ্টিশীল মন সেই ‘বোরিং’ গল্পগুলোকে বিফল হতে দেননি, কাজে লাগিয়েছেন। সেই গল্পগুলো, সেই বিবাদগুলো, ইন্ধন নিয়ে এসেছে তার কল্পনার রাজ্যে, যুগিয়েছে নতুন কোরিওগ্রাফির আইডিয়া। ছোটবেলার সঙ্ঘাতগুলি নাচের মঞ্চতে এসে অমর বাণীতে পরিণত হয়ে সর্বজনীনতা লাভ করেছে।
ছোটবেলায় রাস্তায় খেলতে গিয়ে তিনি দেখেছেন লন্ডনের বহুজাতিক রূপ। তাঁর নিজেরই ভাষায়, আমাদের বাড়ির ডানপাশে ছিল একটি নাইজেরিয়ান পরিবার, রাস্তার মোড়ে একটি চাইনিজ ছেলে, আরেকজন ছিল মরিশাস থেকে। আমি তাদের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে একসাথে স্কুলে যেতাম। এ দেশে এতগুলো কালচার এক সঙ্গে মিশে একাকার হয়ে গেছে যে, এখানে কোনো একক দেশের কালচার বলতে কিছু নেই, একটা নতুন কালচার তৈরি হয়েছে-একটা বিশ্বকালচার”। আকরাম খানের কাজের মধ্যে সেই বিশ্বদৃষ্টি ও বিশ্বানুভূতির সুস্পষ্ট ছাপ সর্বত্র বিদ্যমান।
নিজের পরিবার সম্বন্ধে কোনো প্রশ্ন উঠলেই একটা কথা তিনি বার বার উল্লেখ করেছেন-মায়ের ঋণ। মায়ের কারণেই তিনি এতদূর আসতে পেরেছেন, ইত্যাদি। মা তাঁকে নাচ শিখিয়েছিলেন শৈশবে, মা তাঁকে বাংলায় কথা বলতে শিখিয়েছেন, একরকম জোর করেই, মা তাঁকে বাংলা কবিতা গান রূপকথা এগুলোর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন, মা তাঁকে বাংলাদেশের ধনধান্যপুষ্পে ভরা মাজননীর গল্প শুনিয়েছেন দরদের সঙ্গে। সেসব কথা, গান, দৃশ্য আর কবিতা তাঁর প্রাণের গভীরে প্রবেশ করেছে হয়তো তাঁর নিজের অজান্তেই। তাঁর নৃত্যজীবনের প্রথম প্রেরণা তাঁর মায়ের কাছেই পাওয়া। বাল্যকালে, কৈশোরে, প্রথম যৌবনে বাবা ছিলেন একজন দূরগত মানুষ, একজন রাগী ও ভীতিকর মানুষ। অথচ কি আশ্চর্য, যতই দিন যেতে থাকে ততই বাবার একটি কোমলতর রূপ তাঁর কাছে ফুটে উঠতে শুরু করে। তাঁর পিতা একটি বৃহত্তর উপস্থিতি, একজন স্বর্ণময় সত্তা হয়ে দেখা দেন তাঁর কাছে। তিনি দেখেছেন তাঁর বাবা কি অকথ্য কষ্ট আর পরিশ্রম করে সংসারের হাল ধরে রেখেছেন সারা জীবন। বিলেতের প্রতিকূল সামাজিক-রাজনৈতিক পরিবেশের ভেতর কেমন করে আগলে রেখেছেন গোটা পরিবারকে। কেমন করে নিজের জীবনের সকল স্বপ্নকে বিসর্জন দিয়ে ছেমেয়েদের সকল স্বপ্নকে সফল করে তুলতে চেয়েছেন। আকরামের ছাত্রাবস্থায় মাঝে মাঝেই যেতে হত বাবার রেস্টুরেন্টে একটু আধটু ফুটফরমাশ করার জন্য। ব্রিটিশ উচ্চারণ জানা ছিল বলে অধিকাংশ সময় তাঁকে ওয়েটারের পোশাক পরে কাজে নামতে হত। তখনই তাঁর দেখবার সুযোগ হয়েছিল ব্রিটিশ জাতির বর্ণবাদী চেহারা একেবারে কাছে থেকে। কথায় কথায় তারা তাঁর চামড়ার রঙ নিয়ে খোঁটা দিতেন, তাঁর খর্বাকার শরীর নিয়ে হাসিঠাট্টা করতেন। তাঁর বাবার অবস্থা ছিল আরও শোচনীয়। হরহামেশাই সাদা খদ্দেরদের গালিগালাজ তিনি নির্বিবাদে শুনে যেতেন, কখনো বা হাসিমুখে। অপমানগুলো তাঁর গায়ে লাগত না তা নয়, কিন্তু মুখ গুঁজে সহ্য করে যেতেন জীবিকার তাগিদে, ব্যবসার খাতিরে, ছেলেমেয়ের ভবিষ্যতের কথা ভেবে। ছোটবেলার সেই সব অভিজ্ঞতা মন থেকে কোনোদিনই মুছে যায়নি। পরবর্তীতে নৃত্যজগতে ব্রিটেনের বিস্ময়কর সুনাম অর্জন করার ফলে প্রভূতভাবে সম্মানিত হয়েছিলেন বটে, কিন্তু ছোটবেলার সেই ঘাগুলো কখনোই শুকোবার নয়। বিশেষ করে তার বাবার সারাজীবনের ক্ষতগুলো।
তাঁর স্কুলজীবনেও তিক্ততার অভাব ছিল না। সাদা ছেমেয়েদের অবজ্ঞা অবহেলা অহরহই তাঁকে সহ্য করতে হয়েছে ক্লাসরুমে, খেলার মাঠে। একে তো বাংলাদেশি, তার ওপর দেখতে ছোট। অতএব সাদাকালো সবারই হাসির পাত্র, ব্যঙ্গবিদ্রুপের মোক্ষম শিকার। ছাত্র হিসেবেও খুব তুখোড় ছিলেন তা নয়। সুতরাং আকরাম খানকে সামান্য সম্মানটুকুও কেউ দেখাবার গরজ বোধ করেনি। একমাত্র নাচের কেরামতি দেখিয়েই শেষমেশ ওদের নজরে পড়েছিলেন। তাঁর নিজেরই ভাষায়ঃ ‘মাই রিয়েল ব্রেক ওয়াজ উইনিং এ জুনিয়র স্কুল ডিসকো কমপিটিশন ড্যান্সিং টু মাইকেল জ্যাকসন থ্রিলার। ইট ওয়াজ দ্য ফার্স্ট টাইম আই গট রেসপেক্ট ফ্রম মাই ক্লাসমেট। বিফোর দ্যাট আই ওয়াজ দ্য শাই, ইনসিকিউর, জিকি, স্কিনি, বোরিং লিটল এশিয়ান বয়’ (গার্ডিয়ান, ২০০৯, ডার্সি জাডকে প্রদত্ত সাক্ষৎকারে)।
জাতি-ধর্ম-বর্ণ বিভেদ একেক মানুষকে একেকভাবে প্রভাবিত করে। কেউ চায় প্রতিশোধ, কেউ খোঁজে উগ্রপন্থা, কেউ হয় পরম ধার্মিক, কেউবা পরম নাস্তিক। অধিকাংশ মানুষই কোনো-না-কোনো ভাবে একটা আতÄধ্বংসী পথই বাছাই করে নেয়। কিন্তু আকরামের মতো বিপুল মেধার সৃষ্টিশীল মানুষগুলি তা করে না। তারা সেগুলোকে, সেই অভিজ্ঞতাগুলোকে, অপমানগুলোকে, অভিনব আলোতে আলোকিত করে মানবচিত্তের গভীরতম কিছু তথ্যের খবর পৌঁছে দেয় তাদের স্রোতা-দর্শকদের কাছে। সাধারণ মানুষ সেই সৃষ্টির মাঝে নিজেদের প্রতিকৃতি দেখতে পায়। নিজেদের আনন্দবেদনা, চাওয়া-পাওয়ার প্রতিচ্ছবি দেখতে পায়। আকরাম খানের ‘দেশ’ তেমনি এক সৃষ্টি। এই ‘দেশ’ দেখার জন্যেই টরন্টো আর মন্ট্রিয়েল থেকে কয়েকজন এসেছিল আমার বাসায়। আমরা সবাই মিলে আকরাম খানের চোখ দিয়ে আমাদের দেশকে দেখতে যাব। দেখতে যাব আমাদের দেশকে তাঁর নাচের মধ্য দিয়ে, তিনি যে ভাবে তাঁর দেশকে আবিষ্কার করেছেন, তাঁর কল্পনাতে, ধ্যানধারণাতে যেভাবে ধরা দিয়েছে সেই দেশ। কেবল আমরাই নয়, অটোয়ার অনেক, অনেক শিল্পানুরাগী, নৃত্যানুরাগী দর্শক, তারাও হয়তো একই কারণে যাবেন সেখানে। নিজের দেশকে, স্মৃতিকে, অতীতকে, খুঁজে পাওয়ার আশাতে। আকরাম তার মায়ের দেশ, বাবার দেশের যে ছবি তৈরি করেছেন এতে, তার ভেতর দিয়ে দেশ নিয়ে পৃথিবীর সকল মানুষেরই মৌলিক আকুলতাগুলোকে তুলে ধরেছেন আশ্চর্য নৈপুন্যের সঙ্গে।
ন্যাশনাল আর্টস সেন্টার বা এনএসি , কানাডার জাতীয় প্রমোদাগার। পারফর্মিং আর্টসের প্রাণকেন্দ্র। সংগীত, নৃত্য আর নাট্যজগতের শ্রেষ্ঠ তারকাদের সমাবেশ হয় এখানে। রাজধানী অটোয়ার নগরকেন্দ্রে অবস্থিত এই প্রতিষ্ঠানটি। নিউ ইয়র্কের যেমন আছে লিঙ্কন সেন্টার আর ফিলহার্মনিক অর্কেস্ট্রা, লণ্ডনের রয়েল অপেরা হাউস আর রয়েল ফেস্টিভেল হল, কানাডারও তেমনি এনএসি। প্রায় একই সমতলে, একই আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন। এর একদিকে কানাডার পার্লেমেন্ট ভবন আরেকদিকে ঐতিহ্যবাহী শ্যাটা-লরিয়ে হোটেল ও লর্ড এলগিন হোটেল। পেছন দিকে বিশ্ববিখ্যাত রিডো ক্যানাল, যেখানে শীতের ঋতুতে তৈরি হয় পৃথিবীর দীর্ঘতম স্কেটিং রিঙ্ক। গ্রীষ্মে যার শান্ত জলের ওপর নৌকাবিহারীদের সমাগম হয় দেশবিদেশের নানা জায়গা থেকে। রাস্তা পার হলেই শহরের প্রাচীনতম বাণিজ্য ও প্রমোদকেন্দ্র বাইওয়ার্ড মার্কেট। ওদিকে আলোঝলমল রিডো স্ট্রিট, টুরিস্টদের ভিড়ে কোলাহলে মুখর সারাক্ষণ। আর্টস সেন্টারে শ্রোতারা শোনে পাশ্চাত্য ধ্রুপদী সংগীত-বাখ, মোৎসার্ট, বেথোফেন, মেণ্ডেলসন, শোঁপা আর চাইকোভস্কির অমর রচনাবলি। তাঁরা দেখেন শেক্সপীয়ার, শ’, মিলার, ইবসেন আর উইলিয়মসের নাটক। কখনো বা বড় বড় জ্যাজ শিল্পীরাও আমন্ত্রিত হয়ে আসেন জ্যাজপ্রেমিকদের চাহিদা মেটাবার জন্যে। আর্টস সেন্টারের দরজা কখনো বন্ধ হয় না। সারা বছরব্যাপীই চলছে তাদের অনুষ্ঠান। বিপুলাকার এই প্রতিষ্ঠানটিতে দুটি বড় বড় প্রেক্ষাগৃহ। একটিতে নাচ-নাটক ইত্যাদি। আরেকটিতে প্রধানত অর্কেস্টাকেন্দ্রিক অনুষ্ঠানাদি। টিকেটের দাম দুজায়গাতেই একটু উঁচু। পাড়ার সস্তা সিনেমাহলের মতো নয়। সবচেয়ে কম দামের টিকেটই সেখানে চল্লিশ ডলারের মতো। সবচেয়ে দামি টিকেট বোধহয় একশ কি তারও ওপর। ওটা আমার জানার কথা নয়। ন্যাশনাল আর্টস সেন্টারের অনুষ্ঠান যারা দেখতে যান নিয়মিত তারা কেবল উচ্চরুচিসম্পন্নই মন, উচ্চবিত্তসম্পন্নও। পাঠকের মনে প্রশ্ন দাঁড়াতে পারে তাহলে আমরা কজন আধো গেঁয়ো বাঙ্গাল কেমন করে এত দামের টিকেট কিনে গেলাম সেখানে। টিকেট কিনে গেলাম না অন্য কোনোভাবে গেলাম সেটা না হয় নাই বললাম এখানে, তবে এটুকু বলতে পারি যে একশ ডলারের টিকেট কিনে হলেও বোধহয় আমরা যেতাম। কারণ আমরা তো আসলে আর্টস সেন্টারে যাইনি, গিয়েছিলাম আমাদের দেশের ছেলের অনুষ্ঠান দেখতে। না, ঠিক তাও নয়, গিয়েছিলাম আমাদের হতভাগা দেশটিকেই ভিন্ন একটা রূপে, ঝলমল করা সাজে, দেশবিদেশের অনেক বোদ্ধা দর্শকের মুগ্ধ, সপ্রশংস দৃষ্টির বীক্ষণ দিয়ে দেখতে। সেখানে গিয়ে আমরা কিছুক্ষণের জন্যে ভুলে থাকতে চেয়েছিলাম দেশের করুণ অবস্থাটি, ভুলে থাকতে চেয়েছিলাম ঢাকা-চট্টগ্রাম-খুলনা-রাজশাহীর অন্তহীন হরতাল আর অবরোধের কথা, রেললাইন উপড়ে ফেলে মানুষ মেরে ফেলার কথা, যাত্রীবোঝাই বাসের ভেতর আগুন ধরিয়ে দেওয়ার কথা। এনএসির দেয়ালে দেয়ালে, ছাদের ওপরে টাঙ্গানো বিজ্ঞাপনে, আকরাম খানের ছবি দেখে, নাম পড়ে গর্বে বুক ফুলোতে চেয়েছিলাম। অনেকদিন আমরা, অভিবাসী, উপবাসী বাংলাদেশিরা, সে স্বাদটুকু পাইনি।
শনিবার, ১৬ নভেম্বর, ২০১৩। আকরাম খানের শেষ অনুষ্ঠান সেদিন। এসময় অটোয়াতে প্রচণ্ড ঠাণ্ডা হতে পারত, হতে পারত আচমকা তুষারঝড়। কিন্তু হয়নি। বরং আশাতীতরকম উষ্ণ আবহাওয়া ছিল সেদিন। সন্ধ্যা আটটাতে অনুষ্ঠান শুরু হবার কথা। আমরা সাতজন বাংলাদেশি বাঙালি, সেজেগুজে, গর্বে বুক ফুলিয়ে উপস্থিত হলাম নাচঘরের বাইরে, লাউঞ্জে। টরন্টো থেকে আগত চারজন, ফেরদৌস নাহার, সেরিন, তাঁর দুই মেয়ে বর্ণকলি ও কথাকলি, মন্ট্রিয়েলের মনিকা, অটোয়ার অহনা আর অমিয়া এবং আমি। শেষের দুজন আমার শ্বশুরালয়ের সম্পর্কে নাতনি। অসম্ভব ভালো আর গুণি দুটি মেয়ে। আমার ভয়ানক প্রিয়। দুজনই পাসটাস করে কর্মজীবনে প্রবেশ করেছে। শিল্পকলাতে দুজনই দারুণ উৎসাহী। ছোটবেলা থেকে কানাডায় বসবাস করা সত্ত্বেও দেশ বলতে তারা বাংলাদেশকেই বোঝে। প্রেক্ষাগৃহের দরজা তখনো খোলেনি। আমি ছাড়া আর সকলের হাতেই স্মার্টফোন, আইফোন। অতএব সকলেই সকলের ছবি তোলার কাজে মগ্ন। ডিজিটাল প্রযুক্তির বদৌলতে পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি মানুষই এখন তাৎক্ষণিক ফটোগ্রাফারে পরিণত হয়ে গেছেন। ওদের জন্যে ছবি তোলার মতো বিষয়বস্তু প্রচুরই ছিল সেখানে। আকরাম খানের ছবি, বিজ্ঞাপন, তাঁর অনুষ্ঠান থেকে নেওয়া বিভিন্ন চমকপ্রদ দৃশ্য। সেদিন ওরা সবাই গর্ব করে ঘোষণা করতে পারত সেখানে যে, এই দেখুন, আমরা সেই দেশেরই লোক যার ছবি দেখে আপনারা মুগ্ধ হচ্ছেন। আকরাম খান আর আমরা একই ভাষায় কথা বলি, একই খাবার খাই, একই গান পছন্দ করি।
লাউঞ্জে তখনও হালকা ভিড়। ভয় হচ্ছিল পাছে না খালি হলের ভেতর অনুষ্ঠান করতে হয় আকরামকে। ঠিক পৌনে আটটাতে হলের দরজা খোলা হলো। আমরা একে একে নিজেদের আসন দখল করে নিলাম। দশ মিনিট আগ পর্যন্তও মনে হচ্ছিল অর্ধেকের বেশি লোক হবে না হয়তো। তারপর কি হলো, শেষ পাঁচ মিনিটের মাঝে রীতিমতো একটা ঢল নেমে এলো যেন। দেখতে দেখতে চারদিকের সবগুলো আসন দখল। কি আশ্চর্য শৃঙ্খলার সঙ্গে এতবড় একটা হল এত অল্প সময়ের ভেতর ভরাট হয়ে গেল। ছোট একটা দীর্ঘশ্বাস চেপে রাখলাম মনের ভেতর। এই সহজ জিনিসটা কেন শিখে উঠতে পারছে না আমার দেশের মানুষগুলি। (ক্রমশ:)
মীজান রহমান, গণিতবিদ
অটোয়া, কানাডা