সুন্দরের সাধকের নান্দনিক বিদায়

তিনি ছিলেন মনেপ্রাণে একজন সংস্কৃতিমনা মানুষ৷ রংতুলিতে ভরিয়েছেন ক্যানভাস৷ ছিলেন চারুকলার শিক্ষক, বইয়ের প্রচ্ছদেও এনেছেন নতুন ধারা৷ গান শুনতেন, ছবি দেখতেন, বই পড়তেন জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবেই৷ ৮২ বছর বয়সে হঠাৎ চলে যাওয়া এই তরুণ প্রাণের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা

কাইয়ুম চৌধুরী (৯ মার্চ ১৯৩২—৩০ নভেম্বর ২০১৪)৷ বর্ণিল জীবন ছিল তাঁর
কাইয়ুম চৌধুরী (৯ মার্চ ১৯৩২—৩০ নভেম্বর ২০১৪)৷ বর্ণিল জীবন ছিল তাঁর

এমন আকস্মিকভাবে জীবন থেকে যে তাঁর বিদায় ঘটবে, তা কখনো কল্পনাও করিনি। কিন্তু যখন ভাবি, অর্ধ লক্ষাধিক ধ্রুপদি সংগীতের গুণী শ্রোতার সামনে অসাধারণ সুন্দর এক বক্তৃতা দিতে দিতে ওই সুরের মধ্যেই অনন্তকালের জন্য নিজেকে সম্পূর্ণভাবে নিমজ্জিত করলেন, তখন মনে হয়, এর চেয়ে শিল্পিত আর নান্দনিক মৃত্যু তো হতে পারে না। সুন্দরের সাধনায় নিমগ্ন থাকতে থাকতে সুন্দরের মধ্যেই যেন বিলীন হয়ে গেলেন। এমন গৌরবময় ও মহিমান্বিত মৃত্যু ঘটেছিল শিল্পী কামরুল হাসানের, যিনি ছিলেন কাইয়ুম চৌধুরীর শিল্পগুরু। এই গুরুর দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েই এ দেশের প্রকাশনা জগতের সৌন্দর্যবিধানে আত্মনিয়োগ করেছিলেন তিনি। তারপর গত বাষট্টি বছরের নিরবচ্ছিন্ন সাধনায় এ দেশের প্রকাশনাশিল্পকে তিনি এমন উচ্চতায় উন্নীত করেছেন, যার কোনো তুলনা নেই। এ ক্ষেত্রে তিনি যেমন তাঁর গুরুকে ছাড়িয়ে গেছেন অনেক দূর, তেমনি মৃত্যুর মহিমায়ও যেন তাঁকে অতিক্রম করে গেলেন।
বইয়ের প্রচ্ছদচিত্র, অলংকরণ, বিশেষভাবে তাঁর ক্যালিগ্রাফির সৌন্দর্যের কথা যখন ভাবি, তখন মনে হয়, তিনি আমাদের সৌন্দর্যবোধকেই ব্যাপকভাবে পাল্টে দিয়েছেন, উন্নত করে দিয়েছেন আমাদের রুচির ক্ষেত্রটি। তাঁর জীবনব্যাপী সংগীত ও চলচ্চিত্র-সম্পর্কিত বিপুল অনুরাগ এরূপ বিপ্লবসাধনে সহায়ক হয়েছে। জয়নুল আবেদিন, কামরুল হাসান প্রমুখ পথিকৃৎ শিল্পীর পর বাংলাদেশের প্রথম প্রজন্মের শিল্পীদের মধ্যে তাই অত্যন্ত জনপ্রিয় নাম তাঁর। তাঁর শিল্পকর্মের জমিনে রং ও রূপের যে বিন্যাস, তাতে বাংলার নিসর্গই দারুণভাবে প্রাণবন্ত হয়ে আছে। জন্মভূমির প্রতি প্রবল মমত্ববোধ, নিজ চিত্রে দেশের রূপ-রসকে পরিস্ফুটিত করার নিরন্তর প্রয়াস এবং লোক-ঐতিহ্যের প্রতি অঙ্গীকার তাঁর শিল্পচেতনাকে স্বাতন্ত্র্যমণ্ডিত করেছে। প্রগতির ধ্যান-ধারণা, ইহজাগতিক জীবনবোধ, মুক্তবুদ্ধির আকাঙ্ক্ষা, ব্যাপক সাহিত্যপাঠ তাঁর জীবনজিজ্ঞাসাকে করেছে ইতিবাচক ও বৈচিত্র্যসন্ধানী। ফলে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বৈরাচারবিরোধী ও সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী সব আন্দোলন-সংগ্রামে তিনি ছিলেন সক্রিয়।

শুধু ব্যবহারিক শিল্পে নয়, তিনি নৈপুণ্যের স্বাক্ষর রেখেছেন রেখাচিত্র, জলরং ও তেলরং চিত্রেও। কাইয়ুম চৌধুরীর ড্রয়িং বা রেখাচিত্রের অসামান্য সৌন্দর্য বিশ্লেষণের সময় আমাদের স্বভাবতই মনে পড়ে যায় বাংলা অক্ষরলিখন শিল্পে তাঁর অতুলনীয় দক্ষতা ও চূড়াস্পর্শী সফলতার বিষয়টি। রেখা ও রূপের ছন্দ নিয়েই ওই শিল্পের কারবার, তবে তাতে ভাব প্রকাশের সুযোগ নেই। কিন্তু তাঁর রেখাচিত্রগুলো অপূর্ব ভাবময়তায় সৌন্দর্যমণ্ডিত। সেখানে ক্ষিপ্রতার সঙ্গে একটানে আঁকা রেখার সবল ও দ্বিধাহীন গতির দিকে তাকিয়ে বিস্ময়ে বিমুগ্ধ হতে হয়। সূক্ষ্ম, কোমল ও বলিষ্ঠ রেখার মাধ্যমে তিনি যেসব ফিগার এঁকেছেন, তা শুধু দৃষ্টিনন্দন বললে কম বলা হয়। তুলির মোটা টানে এসব রেখা ছন্দায়িত হয়; কখনো ব্রাশের নিবিড় স্ট্রোক এই ছন্দকে করে তোলে বিস্তৃত। কালীঘাটের পটের ড্রয়িংয়ে যে সংক্ষিপ্ততা ও লিরিক্যাল কোয়ালিটি বিদ্যমান, তার প্রতিও তিনি ছিলেন গভীরভাবে আকৃষ্ট।

বাংলার সজল প্রকৃতিকে কাইয়ুম চৌধুরী তাঁর জলরং চিত্রে হালকা ও স্বচ্ছ ওয়াশের মাধ্যমে অপূর্ব মনোহর রূপে মূর্ত করে তুলেছেন। প্রকৃতির যে আদর্শায়িত রূপ তাঁর চিত্রের উপজীব্য, তা বর্তমান ও অতীতের সংমিশ্রণে বিশেষত্বম‌িণ্ডত, তাতে সবুজেরই এক বিপুল সমারোহ।

এই প্রকৃতিতে কখনো কর্মজীবী নারী, পল্লিবধূ, কিষান-কিষানি, কখনো পাখি ও জীবজন্তু একই চিত্রতলে অবস্থান করে সজীব প্রাণের লীলাকে স্পষ্ট করে তোলে। প্রকৃতি থেকেই যেন তিনি জীবন ও শিল্পের পাঠ গ্রহণ করেছেন। তাঁর সব ধরনের কাজে বাংলাদেশের গ্রাম জনপদের উপস্থিতি তাই বিশেষ তাৎপর্যবহ। দেশের নানা সংকটে তাঁর বিপর্যস্ত মন গ্রামবাংলার জীবনচিত্রের মধ্যে স্বস্তি খুঁজে পায়। গ্রামজীবন তাঁর অন্তর্গত সত্তায় এমন এক ধরনের অনুভূতির জন্ম দেয়, যা তাঁর সৃষ্টিশীল উদ্যমকে ওই জীবননির্ভর চিত্রাঙ্কনে প্রাণিত করে। ওই রূপ অনুভূতি তাঁর দেশাত্মবোধেরও উৎস। তাঁর মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক চিত্রমালায় এ কারণেই গ্রামজীবনেরই প্রাধান্য। তাঁর কাছে লোকশিল্প হয়ে উঠেছে আমাদের ঐতিহ্যের ঠিকানা। লোকশিল্পের বিচিত্র মোটিফ, রং ও ভাষাকে তিনি তাঁর শিল্পকর্মে সৃজনশীলভাবে অঙ্গীকার করেছেন। ঐতিহ্যবাহী পটচিত্র, শখের হাঁড়ি, লক্ষ্মীর সরা, নকশিকাঁথা, পাখা প্রভৃতির বিষয় ও প্রকরণপদ্ধতি অনুসরণ করার পাশাপাশি তিনি লোকজ ফর্ম ভেঙে তাকে আরও মিনিমাইজ করে এবং প্রাথমিক রঙের সমান্তরালে মিশ্র রং ব্যবহার প্রভৃতির মাধ্যমে এর আধুনিক প্রয়োগে প্রয়াসী হয়েছেন। তাঁর ছবি সব সময় লালিত্যময়। গঠনবিন্যাসের সৌন্দর্যই এই লালিত্যের কারণ। প্রচ্ছদ-নকশা ও অলংকরণের ক্ষেত্রে যে সুরুচি ও সৌন্দর্যের নতুন ধারার সূচনা তিনি করেছেন, তা তাঁর চিত্রশিল্পের জমিনকেও প্রভাবিত করেছে। তাঁর ব্যবহারিক শিল্পপ্রয়াস ও তাঁর সৃজনশীল শিল্পকর্ম পরস্পরের পরিপূরক হয়ে উঠেছে। সমকালকে অতিক্রম করে নিজ চিত্রকর্মকে এক চিরকালীন আবেদনে ব্যঞ্জিত করার দিকেই ছিল শিল্পীর আগ্রহ। এই আগ্রহ তাঁকে এক সাধকে পরিণত করেছিল।