তিন তরুণের স্বপ্ন-ঘুড়ি

বৃত্তি পাওয়া কয়েকজন মেধাবীর সঙ্গে তিন তরুণ, (বসে বাঁ থেকে ) সাইফুর রহমান, নূর খান ও এনায়েত হোসেন l ছবি: প্রথম আলো
বৃত্তি পাওয়া কয়েকজন মেধাবীর সঙ্গে তিন তরুণ, (বসে বাঁ থেকে ) সাইফুর রহমান, নূর খান ও এনায়েত হোসেন l ছবি: প্রথম আলো

চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গা উপজেলার প্রত্যন্ত তালুক কররা গ্রামের রকিবুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে পড়েন। কিন্তু এসএসসি পাস করার সময়ও বুয়েটের নাম জানতেন না তিনি। ২০১১ সালে এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পান রকিবুল। কিন্তু খুশির বদলে হতাশাই চেপে ধরল। বাবা ইকলাস মালিথা অসুস্থ। মা আর ছোট বোনকে নিয়ে অভাবের সংসার। আচমকা একটি ফোন তাঁকে স্বপ্ন দেখায়। তারপর চুয়াডাঙ্গা সরকারি কলেজে ভর্তি। বই কেনা, মাসের খরচ—সব ব্যবস্থা হয়। এইচএসসি পরীক্ষায়ও জিপিএ-৫ পান। এরপর সোজা ঢাকায় রকিবুল। গত বছর ভর্তির সুযোগ পান বুয়েটে।
রকিবুলের হামাগুড়ি দেওয়া স্বপ্নকে আকাশ দেখান মূলত তিন তরুণ। সাইফুর রহমান, এনায়েত হোসেন রাজীব, নূর খান মিলে রকিবুলের পড়ালেখার দায়িত্ব নেন। তাঁরা সারা দেশ থেকে খুঁজে খুঁজে এ পর্যন্ত এমন ২৪৪ জনকে বের করে এনেছেন এবং তাদের পড়ালেখার দায়িত্ব নিয়েছেন।
সাইফুর চট্টগ্রাম প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কম্পিউটার বিজ্ঞানে পড়ালেখা শেষ করে সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছেন। নূর কানাডার মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতিতে লেখাপড়া করেছেন। ঢাকায় তিনি রাইট ব্রেইন সলিউশন নামে একটি সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠানের মালিক। রাজীব জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষে দি ওয়েব ল্যাব নামের একটি সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠান দিয়েছেন। তিনজনই ঢাকায় থাকেন। প্রতিষ্ঠা করেছেন ঘুড্ডি ফাউন্ডেশন এবং তার আওতায় চালান ‘সবার জন্য শিক্ষা’ কার্যক্রম।
সৈয়দপুরের কাজীপাড়ার শামীমা নাসরিন সোহাগীও রকিবুলের মতো একজন। বাবা সাইফুল ইসলাম ও মা আফরোজা বেগম অন্যের বাড়িতে কাজ করেন। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে সবার বড় সোহাগী। সৈয়দপুর সরকারি টেকনিক্যাল স্কুল ও কলেজ থেকে ২০১২ সালে এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পান সোহাগী। কিন্তু পরিবারের সামর্থ্য নেই তাঁকে কলেজে ভর্তি করার। পত্রিকায় খবর দেখে সেখানে হাজির হন তিন তরুণ।
ওই কলেজেই সোহাগীকে ভর্তির ব্যবস্থা করেন। বই-খাতা কিনে দেওয়া, মাসে মাসে লেখাপড়ার খরচ দেওয়া, নিয়মিত খোঁজখবর রাখা চলতে থাকে।
এইচএসসি পরীক্ষায়ও জিপিএ-৫ পান সোহাগী। তারপর ঘুড্ডি ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে যথারীতি ঢাকায়। গত বছর মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে দিনাজপুর মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়েছেন তিনি। তাঁর লেখাপড়া শেষ করা পর্যন্ত খরচ চালাবে ঘুড্ডি ফাউন্ডেশন।
ঘুড্ডির সদস্য সাইফুর রহমান বলেন, ‘মেধাবীদের খোঁজার ক্ষেত্রে দৈনিক পত্রিকাগুলোই আমাদের ভরসা। কারও খবর পেলে ওই এলাকার প্রথম আলোর সাংবাদিকদের কাছে আমরা তথ্য-সাহায্য চাই। সংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থীর স্কুলশিক্ষক ও গণ্যমান্য ব্যক্তিদের মাধ্যমেও খোঁজ নিই।’ ফাউন্ডেশনের রাজীব যোগ করেন, ‘যারা কারও কাছ থেকে সাহায্য বা বৃত্তি পায় না, তাদেরই নিই আমরা। তবে একটা বাছাই পর্ব হয় ঢাকায়। সেখানে অভিভাবকেরাও আসেন। প্রাপ্ত ফলাফল ও সার্বিক দিক বিবেচনা করেই শিক্ষার্থীদের বৃত্তি দেওয়া হয়।’ তিনি বলেন, ‘বাছাইয়ের কাজটি করার সময় আমাদের মন খারাপ হয়। সামর্থ্য না থাকার কারণে অনেককে বাদ দিতে হয়। ২০১১ সালে মাত্র নয়জন শিক্ষার্থীকে নির্বাচিত করা হয়েছিল।’
শুধু বৃত্তি দিয়ে দায় শেষ করে না ঘুড্ডি। শিক্ষার্থীদের নিয়মিত খোঁজ রাখা হয়। শিক্ষকদের সঙ্গে যোগাযোগ করে ফলাফল জানা হয়। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সপ্তাহে দুই দিন ফোনে যোগাযোগ করা হয়। প্রতি মাসে চিঠি লিখে লেখাপড়ার অবস্থা জানানো বাধ্যতামূলক।
২০১১ সালে ৯ জন, ২০১২ সালে ৩০ জন, ২০১৩ সালে ৬৮ জন এবং গত বছর ১০৬ জন ঘুড্ডির বৃত্তি পায়। এদের মধ্যে এইচএসসিতে পড়ছে ১৫৯ জন। এদের প্রত্যেককে মাসে দেড় হাজার টাকা করে দেওয়া হয়। এ ছাড়া ভর্তি থেকে শুরু করে রেজিস্ট্রেশন ও ফরম পূরণ পর্যন্ত সরকারি সব ফি আলাদা দেওয়া হয়। স্কুলে আছে ২৭ জন। এদের প্রত্যেকে মাসে ৫০০ টাকা করে পায়। তবে এদের বছরের শুরুতে আড়াই হাজার টাকা করে এককালীন দেওয়া হয় ভর্তি ও অন্যান্য খরচের জন্য।
স্নাতক পর্যায়ে আছে ২৬ জন। এদের প্রতি মাসে চার হাজার টাকা করে দেওয়া হয়। আর প্রতি সেমিস্টারের শুরুতে দেওয়া হয় আড়াই হাজার টাকা। এদের মধ্যে মেডিকেল কলেজে পড়েন চারজন। তাঁদের মাসে চার হাজার টাকার বাইরে প্রতিবছরের শুরুতে পাঁচ হাজার টাকা করে দেওয়া হয় বইসহ আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র কেনার জন্য।
চারটি প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন পাঁচজন। তাঁদেরও মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীদের মতো একই অঙ্কের বৃত্তি দেওয়া হয়। তবে তাঁরা একটি করে ল্যাপটপ পান। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে আছেন পাঁচজন। আর কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন ছয়জন।
এইচএসসি পরীক্ষার পর শিক্ষার্থীদের ঢাকায় এনে উচ্চশিক্ষার জন্য ভর্তি কোচিংয়ের পাশাপাশি অভিজ্ঞ শিক্ষক দিয়ে পাঠদান করা হয়। একজন শিক্ষার্থীকে পাঁচটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। এই প্রক্রিয়ায় ২৪৪ শিক্ষার্থীর পেছনে এ পর্যন্ত তাঁদের খরচ হয়েছে ১ কোটি ৮৫ লাখ ৩৫ হাজার টাকা।
অর্থের উৎস: তিন তরুণ এই উদ্যোগ শুরু করেছিলেন পকেটের পয়সায়। পরে তাঁরা বন্ধু, আত্মীয়স্বজন ও পরিচিতজনদের কাছে হাত পাতেন। চালু করেন ফেসবুক পেজ। অনেকেই এগিয়ে আসতে থাকেন। কেউ একজন, কেউ দুজন, কেউ বা তিনজন শিক্ষার্থীকে লেখাপড়ার খরচ দেওয়ার দায়িত্ব নেন। অনেকই আছেন, মাসের বেতন পেয়ে তার একটি অংশ পাঠিয়ে দেন তিন তরুণের কাছে। তাঁদের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক দাতা নেই।
নূর খান বলেন, দাতা যে শিক্ষার্থীকে সহায়তা করছেন, ওই শিক্ষার্থীর ফোন নম্বর তাঁকে দিয়ে দেওয়া হয়। তিনি নিজেই খোঁজখবর রাখতে পারেন। এভাবে চলার পর তাঁরা ঘুড্ডি ফাউন্ডেশন নামে একে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেন।
তিন তরুণ নিজেদের কার্যক্রমের হালনাগাদ তথ্য ফেসবুকে দিয়ে দেন। তাঁদের ফেসবুকের ঠিকানা: www.facebook.com/EducationForAllBD । সাইফুর বললেন, ‘আমরা চাই না আমাদের কার্যক্রম নিয়ে কোনো প্রশ্ন উঠুক।’
সফল কয়েকজন: রকিবুল ইসলাম বুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে, আলী হোসেন খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইলেকট্রনিকস অ্যান্ড কমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে, শাহাদাত হোসেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন বিভাগে, ফাবিহা রাইয়ান মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে এবং উমর ফারুক যশোর ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ফার্মেসি বিভাগে পড়ছেন।
নাসরীন সোহাগী পড়েন দিনাজপুর মেডিকেল কলেজে, পারভেজ মোশারফ চট্টগ্রাম প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে, আবু বকর রাজশাহী প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে, সুমি আক্তার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফুটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে, হাবিবা খাতুন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাৎস্যবিজ্ঞান বিভাগে, লিটন রায় ও শামিম রেজা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগে, কেয়া খাতুন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগে, তাসনিম তামান্না সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে, আবু তালেব হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে কৃষিবিজ্ঞান বিভাগে, মোখলেসুর রহমান মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগে, হাসান মোল্লা বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে, ইবতিদা ইশমাম ও অন্তর আলী সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন।
দিনাজপুর মেডিকেলের শিক্ষার্থী নাসরিন সোহাগী বারবার কৃতজ্ঞতা জানালেন তিন তরুণের প্রতি। বললেন, ‘কারও নিজের ভাইও এভাবে এগিয়ে আসেন না যে কাজ ভাইয়ারা আমার জন্য করেছেন। আমি কথা দিচ্ছি, আমিও চিকিৎসক হয়ে এভাবে অভাবী মানুষের জন্য কাজ করব।’ সোহাগীর বাবা সাইফুল ইসলামও মেয়েকে এই অবস্থানে দেখতে পাওয়ার কথা বলতে গিয়ে আবেগাপ্লুত হন, ‘আমি আর কী করতে পারতাম। তিন পোলা যেটা কইল্ল, কেডা করব এমন উপকার। মেয়ে যে ডাক্তার হইব, এটা ভাইবাই সুখে কান্না আসে।’
বুয়েটের রকিবুল বললেন, ‘রাজীব, নূর ও সাইফুল ভাই মিলে আমাদের জন্য যা করেছেন, তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। আমার মতো অনেকের জীবন বদলে গেছে তাঁদের স্পর্শে।’ রকিবুলের বাবাও অকপটে বললেন, ‘সামর্থ্য ছিল না বাবা, ছেলেরে পড়াইবার পারতাম না। কয়েকজন পোলা ওরে পড়াইল। গ্রামের মানুষ তো কয় আমার পোলা দ্যাশের সেরা জায়গায় পড়ে। অনেক বড় হইব। এগুলা শুনি আর কান্দি। বড় ভালো লাগে।’