এ সংকট কাটাতে হবে

সঠিক তথ্য ও সুপরামর্শ পেলে প্রত্যেক কিশোর–কিশোরীর জীবন হয়ে উঠতে পারে আনন্দময় l ছবি: মুসলিমা জাহান
সঠিক তথ্য ও সুপরামর্শ পেলে প্রত্যেক কিশোর–কিশোরীর জীবন হয়ে উঠতে পারে আনন্দময় l ছবি: মুসলিমা জাহান

‘তেরো-চৌদ্দ বৎসরের ছেলের মতো পৃথিবীতে এমন বালাই আর নাই। শোভাও নাই, কোনো কাজেও লাগে না। স্নেহও উদ্রেক করে না, তাহার সঙ্গসুখও বিশেষ প্রার্থনীয় নহে। তাহার মুখে আধো-আধো কথাও ন্যাকামি, পাকা কথাও জ্যাঠামি এবং কথামাত্রই প্রগল্‌ভতা। হঠাৎ কাপড়চোপড়ের পরিমাণ রক্ষা না করিয়া বেমানানরূপে বাড়িয়া উঠে; লোকে সেটা তাহার একটা কুশ্রী স্পর্ধাস্বরূপ জ্ঞান করে। তাহার শৈশবের লালিত্য এবং কণ্ঠস্বরের মিষ্টতা সহসা চলিয়া যায়; ...সেও সর্বদা মনে মনে বুঝিতে পারে, পৃথিবীর কোথাও সে ঠিক খাপ খাইতেছে না; এইজন্য আপনার অস্তিত্ব সম্বন্ধে সর্বদা লজ্জিত ও ক্ষমাপ্রার্থী হইয়া থাকে।’ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘ছুটি’ গল্পের মূল চরিত্র ফটিকের মতো কিশোর-কিশোরীদের সার্বিক অবস্থা বোঝাতে গিয়ে এই কথাগুলো লিখেছিলেন।
বয়ঃসন্ধিক্ষণে উপস্থিত প্রায় সব ছেলেমেয়ের মধ্যেই এ ধরনের সংকট দেখা যায়। এ সময়টা হচ্ছে বোঝা আর না-বোঝার মাঝখানে দোলায়মান সময়। শরীরে আসে নানা পরিবর্তন। তারা বড়দের কাছে ছোট আর ছোটদের কাছে হয়ে ওঠে বড়। চেনা পৃথিবী হয়ে ওঠে অচেনা। এই অচেনা পৃথিবীর সঙ্গে খাপ খাওয়াতে গিয়ে তারা নানা জায়গায় হোঁচট খায়। কিন্তু তাদের সাহায্যে কেউ এগিয়ে আসে না। অথচ এ সময়টায় চাই সহানুভূতি আর সঠিক তথ্য।
শুদ্ধ (১৪) পড়ে অষ্টম শ্রেণিতে। তিন ভাইবোনের মধ্যে সে সবার ছোট। সপ্তম শ্রেণিতে ওঠার পরই তার কণ্ঠস্বর মোটা আর ভারী হতে থাকে। তাই নিয়ে সে এমনিতেই বিব্রত ছিল। এর ওপর তার বড় দুই ভাইবোন শুদ্ধর কণ্ঠস্বর মোটা হওয়া নিয়ে হাসাহাসি করতে থাকে। এতে সে নিজেকে আরও গুটিয়ে নেয়। মানুষের সামনে কথা বলাই বন্ধ করে দেয়।
সপ্তম শ্রেণিতে ওঠার পরই নাদিয়া (১৩) যেন হঠাৎ করেই অনেক বড় হয়ে যায়। শরীরে এসেছে নানা পরিবর্তন। শিশুসুলভ আর কোনো কিছুই তার মধ্যে থাকে না। সে বুঝতে পারে পাড়ার ছেলেরা কেমন অন্য রকম দৃষ্টিতে তার দিকে তাকায়। মা কথায় কথায় বলেন, ধিঙ্গি মেয়ে। আর নাদিয়ার দাদি বলেই বসলেন যে ‘এবার নাদিয়ার একটা বিয়ে দিতেই হবে।’ এ কথা শুনে নাদিয়া একেবারে ঘাবড়ে যায়। বেশ কয়েক রাত সে ঘুমোতেই পারেনি। তার হঠাৎ এই বড় হয়ে যাওয়া নিয়ে এখন রীতিমতো বিষণ্নতায় ভুগছে নাদিয়া।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বয়ঃসন্ধিকালে বিষণ্নতার কারণে অনেকেই মৃত্যুবরণ করছে। বর্তমান বিশ্বে ১০ থেকে ১৯ বছর বয়সী ছেলেমেয়েদের বড় একটা অংশের অসুস্থতার অন্যতম কারণ বিষণ্নতা। অনেক মানুষই বয়ঃসন্ধিকালে হওয়া মানসিক অসুস্থতা বয়ে বেড়ায় জীবনভর। সারা বিশ্বের মানসিকভাবে অসুস্থ প্রাপ্তবয়স্কদের অন্তত অর্ধেকের মাঝে মানসিক অসুস্থতা দেখা দেয় বয়স ১৪ পূর্ণ হওয়ার আগে।
কৈশোরকালের এই সংকট নিরসনে প্রয়োজন সহানুভূতি আর সঠিক তথ্য। আমাদের দেশের বেশির ভাগ পরিবারে দেখা যায়, মা–বাবার সঙ্গে ছেলেমেয়েদের একটা দূরত্ব বিরাজ করছে। ছেলেমেয়েরা যত বড় হয়, এই দূরত্ব তত বাড়তে থাকে। সন্তানেরা কখন যে এই বয়ঃসন্ধিকালটা পার করছে তা বাবা-মায়েরা খেয়ালই করছেন না। বয়ঃসন্ধিকালে অনেক ছেলেমেয়ে স্বাধীনভাবে থাকতে পছন্দ করে। এ কারণে অনেক সময় তারা অসৎ সঙ্গে পড়ে। তখন অনেক মা–বাবা সন্তানকে না বুঝিয়ে তাদের সঙ্গে রাগারাগি করেন। এতে হিতে বিপরীত হয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতেও শিক্ষকেরা বয়ঃসন্ধিকালের সংকট নিয়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনা করেন না। ফলে শিক্ষার্থীরা কোনো তথ্যই পাচ্ছে না।
এ বিষয়ে কথা হয় জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের শিশু-কিশোর ও পারিবারিক মনোরোগ বিদ্যা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক হেলালউদ্দিন আহমেদের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘এই বয়সে কোনো কোনো ক্ষেত্রে মানসিক দ্বন্দ্ব তৈরি হয়। এই বয়সী ছেলেমেয়েরা বড়দের মহলেও আদৃত হয় না। আবার ছোটদের সঙ্গেও মিশতে পারে না। এই বয়সের সংকটকে আমরা বলি বয়ঃসন্ধিকালের সংকট বা অ্যাডলসেন্স ক্রাইসিস। এই সংকট মোকাবিলা করতে না পারলে বিষণ্নতাসহ নানা ধরনের রোগ দেখা দিতে পারে।’
তবে আশার কথা, কিশোর-কিশোরীদের মানোন্নয়নে সরকার দেশের কয়েকটি স্থানে গড়ে তুলেছে কিশোর-কিশোরী ক্লাব। মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয়ের তত্ত্বাবধানে এসব ক্লাব পরিচালিত হচ্ছে।
তবে, বয়ঃসন্ধিকালের সংকট থেকে উত্তরণের জন্য এটুকুই যথেষ্ট নয়। এই সংকট নিরসনে পরিবার থেকে রাষ্ট্র, সর্বস্তরেই কিশোর-কিশোরীদের প্রতি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলতে হবে। মা– বাবাকে ছেলেমেয়েদের অনুভূতি, জিজ্ঞাসাগুলো শুনতে হবে। ওদের বুঝতে হবে আন্তরিকতার সঙ্গে।
হেলালউদ্দিন আহমেদ আরও বলেন, ‘মা-বাবা ও স্কুলশিক্ষকদের উচিত কিশোর-কিশোরীদের শারীরিক পরিবর্তনের বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা দেওয়া। বাবা-মাকে সন্তানের সঙ্গে সহজ সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। অন্যদিকে রাষ্ট্রকেও কিশোর-কিশোরীদের জীবন গঠনে আরও বেশি ভূমিকা পালন করতে হবে।’