নায়কের নাম মাহমুদউল্লাহ

বিশ্বকাপে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে শত রান করার গৌরব মাহমুদউল্লাহর। ৯ মার্চ ইংল্যান্ডের বিপক্ষে অবিস্মরণীয় জয়ের মূল নায়ক তিনি। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষেও করেছেন অসাধারণ এক সেঞ্চুরি। শুনুন এই ক্রিকেটারের উঠে আসার গল্প।

অ্যাডিলেডে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচে শত রানের পর মাহমুদউল্লাহর উদ্‌যাপন। ছবি: শামসুল হক
অ্যাডিলেডে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচে শত রানের পর মাহমুদউল্লাহর উদ্‌যাপন। ছবি: শামসুল হক

ময়মনসিংহ শহরের ধোপাখলা এলাকা। বাসার সামনে বেশ ফাঁকা জায়গা। ১৯৮৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি জন্ম নেওয়া মাহমুদউল্লাহর ক্রিকেটে হাতেখড়ি এখানেই। তবে ক্রিকেটটা তখন সীমাবদ্ধ ছিল বাড়ির ‘উঠোন’ পর্যন্তই।
বড় ভাই আহসানউল্লাহ রানা ক্রিকেটপ্রেমী, তবে ক্রিকেটার হতে চাননি। মেজো ভাই এমদাদউল্লাহ খেলতেন ময়মনসিংহের প্রথম বিভাগ ক্রিকেট। মেজো ছেলে ক্রিকেট খেললেও মা আরাফাত বেগম, বাবা মো. উবায়েদউল্লাহ ভাবতেও পারেননি ভবিষ্যতে বড় ক্রিকেটার হবেন ছোট ছেলে মাহমুদউল্লাহ!
মাহমুদউল্লাহ পড়তেন ময়মনসিংহ জিলা স্কুলে। মা-বাবার চাওয়া ছিল, পড়াশোনাতেই মনোযোগ থাক ছেলের। কিন্তু জীবনের মোড়টা ঘুরিয়ে দিলেন মেজো ভাই। এমদাদউল্লাহ তখন ময়মনসিংহের ঐতিহ্যবাহী পণ্ডিতপাড়া, মোহামেডান স্পোর্টিংসহ বিভিন্ন ক্লাবের হয়ে প্রথম বিভাগ ক্রিকেট খেলেন। ক্রিকেটের প্রতি আগ্রহ দেখে তিনি মাহমুদউল্লাহকে নিয়ে গেলেন পণ্ডিতপাড়া ক্লাবে। সেখানেই শুরু কোচ কামালুজ্জামান খান সাদেকের তত্ত্বাবধানে ক্রিকেটার হওয়ার লড়াই।
বদলে যাওয়ার গল্প
২০০০ সালে নির্মাণ স্কুল ক্রিকেটে রাজশাহীর একটি স্কুলকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয় ময়মনসিংহ জিলা স্কুল। সে বছরই মাহমুদউল্লাহকে ঢাকায় নিয়ে আসেন ভাই এমদাদ। তখন বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৫ দলের এশিয়া কাপের অনুশীলন চলছিল। ময়মনসিংহের পণ্ডিতপাড়া ক্লাবের কোচ কামালুজ্জামান ও এমদাদ মাহমুদউল্লাহকে না জানিয়েই অনূর্ধ্ব-১৫ দলের জন্য মাহমুদউল্লাহর নাম নিবন্ধন করান।
তবে তত দিনে ওই স্কোয়াডে প্রয়োজনীয় ক্রিকেটারের অন্তর্ভুক্তি হয়ে গিয়েছিল। ক্ষীণ আশা ছিল, যদি ফিটনেস পরীক্ষায় কেউ বাদ পড়ে! কামালুজ্জামান তাঁর বন্ধু অনূর্ধ্ব-১৫ দলের তখনকার কোচ অলক চক্রবর্তী অনুরোধ করেন, শূন্য স্থানে মাহমুদউল্লাহকে বাজিয়ে দেখতে। বন্ধুর অনুরোধ রাখলেন অলক। সেবার মালয়েশিয়ায় অনুষ্ঠিত অনূর্ধ্ব-১৫ এশিয়া কাপ টুর্নামেন্টের মূল দলে সুযোগ পেয়ে দারুণ পারফর্ম করেন মাহমুদউল্লাহ।
স্বপ্ন যখন হাতের মুঠোয়
অসাধারণ সেই পারফরম্যান্সের পর ২০০২ সালে সুযোগ পেলেন ধানমন্ডি ক্লাবে। ক্লাবের কোচ জালালকে প্রিমিয়ার লিগে খেলার সুযোগ করে দিতে অনুরোধ করলেন মাহমুদউল্লাহ। কোচ সুযোগও দিলেন। এরপর কেবলই এগিয়ে চলা।
ঘরের মাঠে সেবার এক টেস্ট সিরিজের আগে জাতীয় দলের তিন দিনের একটি প্রস্তুতি ম্যাচ ছিল ডেভেলপমেন্ট স্কোয়াডের বিপক্ষে। ডেভেলপমেন্ট স্কোয়াডে জায়গা পেলেন মাহমুদউল্লাহ। তিন দিনের সেই ম্যাচে জাতীয় দলের বিপক্ষে দুই ইনিংসেই করলেন অর্ধশত। ওই ম্যাচের পর তাঁকে ভালোভাবে চিনলেন নির্বাচেকরা।
এরই মধ্যে তিনি ঢাকা মেট্রোর সবুজ দলের অধিনায়ক। এর ফাঁকে ছয় মাসের জন্য ইংল্যান্ড থেকে ব্যাটিং ও অধিনায়কত্বের ওপর বিশেষ প্রশিক্ষণ নেওয়া। ২০০৭ সালে ২১ বছর বয়সে কলম্বোয় শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে জাতীয় দলের হয়ে ওয়ানডেতে অভিষেক। ২০০৯ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে টেস্ট দলে ডাক। তারপর?
সে গল্প তো প্রায় সবারই জানা।

বিশ্বকাপ মিশনে সপরিবারে
বিশ্বকাপ মিশনে সপরিবারে

মাহমুদউল্লাহর প্রিয়
শান্ত স্বভাবের মাহমুদউল্লাহর ভীষণ প্রিয় মিষ্টিজাতীয় খাবার। সবচেয়ে প্রিয় মায়ের হাতের পায়েস আর ময়মনসিংহের বিখ্যাত মালাইকারি। প্রিয় খাবারের তালিকায় আছে বিরিয়ানিও।
ক্রিকেটের ব্যস্ত সূচির মধ্যেও ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিবিএ করেছেন। এখন পড়ছেন এমবিএ।
ময়মনসিংহে মাহমুদউল্লাহর প্রথম কোচ ও অভিভাবক কামালুজ্জামান খান বললেন, ‘বিশ্বকাপে যাওয়ার আগে ও আমার সঙ্গে কথা বলেছে। তাকে বোলিংয়ের চেয়ে ব্যাটিংয়ে বেশি মনোযোগ দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলাম। সেটা বেশ কাজে লেগেছে। আমার প্রত্যাশা, বাংলাদেশের ক্রিকেটকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাবে ও।’

ছেলের সাফল্য সারা দেশের জন্য বিলিয়ে দিতে চান গর্বিত মা-বাবা
ছেলের সাফল্য সারা দেশের জন্য বিলিয়ে দিতে চান গর্বিত মা-বাবা

এবার ভালো কিছুই করতে হবে—বিশ্বকাপ মিশনের আগেই বাবা-মায়ের কাছে এভাবেই নিজের মনের কথা জানিয়ে গিয়েছিলেন মাহমুদউল্লাহ। অ্যাডিলেড ওভালে শুধু ভালো নয়, ইতিহাসই গড়েছেন তিনি! পেলেন নিজের অধরা সেঞ্চুরিটা। একই সঙ্গে বিশ্বকাপে প্রথম কোনো বাংলাদেশি ব্যাটসম্যান হিসেবে পেলেন সেঞ্চুরি।
মা আরাফাত বেগম ছেলের অর্জনে যারপরনাই খুশি। বললেন, ‘মা হিসেবে তো ভীষণ খুশি! তবে ওর অর্জনের চেয়ে বেশি খুশি দল কোয়ার্টার ফাইনালে যাওয়ায়। ’
আজকের মাহমুদউল্লাহ হয়ে উঠতে পাড়ি দিতে হয়েছে দীর্ঘ বন্ধুর পথ। মা তা-ই বললেন, ‘ক্রিকেটার হতে সে সাধনা করেছে, এখনো করে যাচ্ছে।’
বাবার প্রত্যাশা, মাহমুদউল্লাহ ও বাংলাদেশ দল এগিয়ে যাবে, ‘রিয়াদ (মাহমুদউল্লাহ) তো বটেই, গোটা দল যাতে এ সাফল্য ধরে রাখতে পারে, এটাই আমাদের চাওয়া।’
একই চাওয়া তো গোটা দেশেরও।

বিয়ের দিনে ‘জামাই আদর’
বিয়ের দিনে ‘জামাই আদর’

জামাই রিয়াদ
মাহমুদউল্লাহ-মুশফিকুর রহিম বহুদিন ধরেই জাতীয় দলের সতীর্থ। এর বাইরে আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ দুজন। ২০১১ সালের জুনে মাহমুদউল্লাহ জুটি বেঁধেছেন জান্নাতুল কাউসারের সঙ্গে। পরের বছর ঘর আলো করে এল ছেলে রায়িদ।
গত বছরের আগস্টে মুশফিক আনুষ্ঠানিকভাবে জুটি বেঁধেছেন ছোট বোন জান্নাতুল কিফায়াতের সঙ্গে। দুটো ডাকনামও আছে দুই বোনের, মিষ্টি ও মন্ডি। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে মাহমুদউল্লাহ-মুশফিকুর রহিমের ১৪১ রানের সেই দুর্দান্ত জুটির পর দুজনের শ্বশুর-শাশুড়ি ফজলুর রহমান ভুঁইয়া ও নাজনীন আক্তারের তাত্ক্ষণিক প্রতিক্রিয়া প্রকাশিত হয়েছিল প্রথম আলোর ওয়েবসাইটে।
তখন দুজনই জানিয়েছিলেন, ‘একটাই প্রত্যাশা, বাংলাদেশ খেলবে কোয়ার্টার ফাইনাল।’ সে প্রত্যাশা পূরণ হয়েছে, এখন চাওয়া কী? বুধবার রামপুরার ঝিলকাননে নিজের বাসায় ফজলুর রহমান ভুঁইয়া বললেন, ‘আশা করি কোয়ার্টার ফাইনাল জিতে বাংলাদেশ আরও সামনে যাবে।’
মাহমুদউল্লাহ-মুশফিক দুই জামাইয়ের মধ্যে প্রিয় কে? এ প্রশ্নে নাজনীন আক্তার মুচকি হাসলেন। বললেন, ‘কঠিন প্রশ্ন। তবে বড়জনের প্রতি একটু বেশি পক্ষপাত। কারণ, ওর সঙ্গেই তো আমাদের প্রথম পরিচয়।’
সে পরিচয়-পর্বের গল্পটা নাজনীন আক্তার শোনালেন এভাবে, ‘লালমাটিয়ায় আমার বড় বোনের বাসার সঙ্গেই ছিল সাবেক অধিনায়ক আকরাম খানের বাসা। ওখানেই আকরামের সঙ্গে আমাদের ঘনিষ্ঠতা। তাঁর বাসায় রিয়াদের সঙ্গে প্রথম পরিচয় আমাদের।’
তবে নাজনীন জানালেন মজার এক তথ্য, ‘আসলে শুরুতে ক্রিকেটারের সঙ্গে মেয়েকে বিয়ে দিতে রাজি ছিলাম না। ফর্ম না থাকলে নাকি খেলোয়াড়দের মন-মেজাজ ভালো থাকে না।
তখন মানুষের নানা বাঁকা মন্তব্যও শুনতে হয়। তবে রিয়াদের সঙ্গে কথা বলার পর মনে হলো, ছেলে হিসেবে সে অন্য রকম!’ পাশ থেকে ফজলুর রহমান যোগ করলেন, ‘আসলে দুজন কেবল ভালো খেলোয়াড়ই নয়, ভালো মানুষও।’

পারিবারিক অ্যালবাম থেকে
পারিবারিক অ্যালবাম থেকে