তারকা নয় অভিনেত্রীর গল্প

অপর্ণা ঘোষ
অপর্ণা ঘোষ

পিতা ছিলেন থিয়েটারের অভিনেতা। সারা দিন মঞ্চ করে এসে মেয়েকে একবার করে গল্প বলতেনই। হঠাৎ কোনো ঘটনা বোঝানোর জন্য নিজেই অভিনয় করে উঠতেন। বাবার কাণ্ডে মেয়ের মধ্যে অভিনয়ের পোকা ঢুকে যেতে থাকে। একটা সময় এই দেখার অভিজ্ঞতাটা অপর্ণার অভিনয়ের জন্য একটা মৌলিক অনুশীলন-পর্ব হয়ে ওঠে।
এটা খুব স্বাভাবিকভাবেই ঘটে গেল। অভিনেতার কন্যা মঞ্চে নেমে পড়ল। কী অদ্ভুত টান! মঞ্চের সময়, নিয়ম মেনে কড়া অনুশীলনে ডুব দিল সে! চট্টগ্রামের সব থেকে উল্লেখযোগ্য নাটকের দল নান্দীকারে কাজ করছিল সে। কোর্ট মার্শাল, জ্ঞানবৃক্ষের ফল, গোড়ায় গলদ এসব নাটকের ভেতর দিয়ে সে চরিত্রের সঙ্গে একটা যূথচারিতা তৈরি করতে শিখছে। চট্টগ্রাম শহরের মেয়ে চট্টগ্রামেই বেশ জাঁকিয়ে বসেছিল! নান্দিকার তার অভিনয় শেখার দার্শনিক গুরু হয়ে উঠল। পড়াশোনা, আড্ডা, অভিনয় মিলিয়ে বেশ যাচ্ছে সময়। কিন্তু সে আরও বড় কিছু করতে চাইল। পূর্বাপর প্রস্তুতি নিয়ে নয় হঠাৎই শামিল হলো ঢাকা-যাত্রায়!
স্রেফ নায়িকা
চট্টগ্রাম থেকে ঢাকাগামী গোধূলী এক্সপ্রেস ছাড়বে সন্ধ্যায়। দিনের শেষ ট্রেন। আটপৌরে জামা আর ছোটখাটো এক লাগেজ হাতে যে তরুণী স্টেশন রোড হয়ে এই মাত্র প্ল্যাটফর্মে প্রবেশ করল তার নাম অপর্ণা। খুব অদ্ভুত চাহনি, দারুণ সাদাসিধে সুন্দর। নিজের আসনটাতে বসেই চোখের সামনে একটা খবরের কাগজ খুলে ধরল। কাগজটা কিছুদিনের পুরোনো বটে তবুও এটা সামনে ধরে সে ঘটনার মধ্যে থাকতে চাইছে। পত্রিকায় বড়সড় বিজ্ঞাপন। দারুচিনি দ্বীপ চলচ্চিত্রের জন্য নায়িকা হতে চাইলে লাক্স-চ্যানেল আই সুপার স্টার প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে হবে। অজস্র প্রতিযোগী থেকে নিজেকে আলাদা করে তুলতে হবে। একটা ঘোর আর স্রেফ নায়িকা হওয়ার জন্য অপর্ণা ঢাকায় ছুটে যাচ্ছে। ছোট খালার বাসাবোর বাসায় উঠতে হয়েছে তাকে। অদ্ভুত সাহসে শুরুটা হয়ে গেল। সঙ্গে বাবা আছেন নির্ভয় হাত ধরে। এটা ২০১১ সালের ঘটনা।
লড়াইটা গল্পের মতো
খুব উৎসাহ নিয়েই নিজেকে শামিল করল অপর্ণা সম্পূর্ণ নতুন একটা প্ল্যাটফর্মে। লাক্স সুন্দরী প্রতিযোগিতার প্রথম ৫০ জনের তালিকায় পৌঁছানোর আগেই ঝরে পড়ল। একটা অপ্রস্তুত হতাশা জেঁকে ধরল! মহানগর প্রভাতী ধরে ফিরে গেল আবার নিজের শহের। একটা অঘোষিত চমকের মতো করে কর্তৃপক্ষ আবার ডেকে পাঠালে অপর্ণাকে। একটা আলাদা অথচ তীব্র মায়ার মুখ হয়তো তাদের মাঝে একটা শূন্যস্থান দেখিয়েছিল। তল্পিতল্পা গুছিয়ে আবার এল ঢাকায়। এগোল কিছুটা। বিউটি, বাহাস, সৌন্দর্যসচেতনতা, আধুনিকতা আর সবার থেকে ভিন্নতর হতে হলে কীভাবে প্রস্তুত হতে হবে তার একটা প্রাথমিক পাঠ পেল সে! কিন্তু বিধি বাম! এবার সেরা ২৫ থেকেই বাদ! এই ধাক্কাটা সামলানো কঠিন হলো।
মেয়ের নতমুখ দেখে বাবা অভয় দেয়!...‘তোর জায়গা তো আছেই, মঞ্চে কাজ কর, আরও নতুন নতুন চরিত্র কর একদিন সময় আসবেই!! হ্যাঁ! সময় আসবেই!’ না! খুব বেশি সময় যায়নি তখনো! আবার নাটকীয় একটা ঘটনা ঘটল! সেরা ২০ জনের তালিকায় রাখা হলো তাকে! অপর্ণার ভাষায়...‘একেই বলে ভাগ্য’!!
এবার জোরেশোরে লড়াই করার একটা প্রস্তুতি নিল সে। এবার সেরা ১১-এর মধ্যে নিজেকে আবিষ্কার করে কিছুটা বিজয়ী ভাবা আরম্ভ করছিল! লড়াইটা কেবল জমিয়ে দিল! নায়িকা হওয়ার ঘোর থেকে কিছুতেই বেরোতে পারছে না! হুলুস্থুল করতালি, মানুষের সম্মোহনী চাহনি আর একধরনের হার না-মানা মানসিকতা অপর্ণাকে সেরা চারে নিয়ে আসে। আপাতত আর এগোনো হলো না! চার এই শেষ! কিন্তু অভিনয় যার রক্তে তাকে কি সংখ্যাতাত্ত্বিক ফর্মুলায় ফেলে মাপা যায়?
টেলিভিশন যাত্রা
কঠিন অভিনয়-প্রাণ নিয়েই লড়াইটা শুরু হলো। ভারতীয় টিভি বিজ্ঞাপন পরিচালক অমিত সেনের হাতেই বিজ্ঞাপন-পর্ব। তারপর ফিকশন শুরু হয়ে গেল। ঢাকা-চট্টগ্রাম বাস অথবা ট্রেন, খালার বাসা, পড়াশোনা—এসব টানাপোড়েনের ভেতর দিয়ে অপর্ণার দিন চলে এল! ইফতেখার আহমেদ ফাহমির বালা, হাউসফুল, আশিকুর রহমানের স্বপ্ন সময় সম্মোহন, শাফায়েত মনসুর রানার আমি আকাশ পাঠাব, ইমরাউল রাফাতের মেড ইন চিটাগং আর কিছু কাজের ভেতর দিয়ে একটা সফল পরিভ্রমণ এখনো চলছে!
এর পরের গন্তব্য চলচ্চিত্র ছাড়া অবশিষ্ট কী হতে পারে?
স্বপ্ন সময় চলচ্চিত্র
একটা মোহগ্রস্ত সময় পেরিয়ে গেল চলচ্চিত্র ভাবতে ভাবতে। এবার চলচ্চিত্রের ফ্যান্টাসি থেকে সরাসরি অনুপ্রবেশের পালা! মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর থার্ড পার্সন সিঙ্গুলার নাম্বার অপর্ণার প্রথম চলচ্চিত্র। ইফতেখার আহমেদ ফাহমির টু বি কন্টিনিউড চলচ্চিত্র শেষ পর্যন্ত সম্পূর্ণ না হলেও এই চলচ্চিত্র অপর্ণার কাজের অভিজ্ঞতা এগিয়ে দেয়। কিন্তু অভিনেত্রীর আকাঙ্ক্ষা আর তৃপ্তির কাজ কই? হ্যঁা! আরও কাজ চাই! অসম্ভব কাজের তৃষ্ণা পেয়ে বসেছে তাকে!
নির্মাতা–অভিনেতা গাজী রাকায়েতের মৃত্তিকা মায়া চলচ্চিত্রের ভেতর দিয়ে অপর্ণার অভিনেত্রী হওয়ার একটা মৌলিক লড়াই শুরু হয়ে গেল। চলচ্চিত্রের ন্যারেটিভ আর ফর্মের সঙ্গে অভিনয়ের চরিত্র বিশ্লেষণের যে ব্যবহারিক অনুশীলন তার একটা হাতে–কলমে নিরীক্ষা হয়ে গেল! এই চলচ্চিত্র অপর্ণাকে অভিনেত্রী করে তোলে। ২০১৩ সালের সেরা পার্শ্বচরিত্রে অভিনয়ের জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন অপর্ণা।
হ্যাঁ! একটা অভাবিত স্বপ্নের ঘোরে যে নায়িকার বসবাস সে হয়তো ক্রমাগত আরও চরিত্রের বৈচিত্র্য চাইবে! জাহিদুর রহমান অঞ্জনের মেঘমল্লার-এ অপর্ণা নিজেকেই ছাড়াতে চায়। কী শান্ত চোখ! আপাত নিরীহ মুখ, ভয় আর কান্নার সুবিমল পোরট্রেট যেন! তারপর প্রসূন রহমানের ছবি সুতপার ঠিকানা। এখানে অপর্ণা পাঁচটি চরিত্রে নিজেকে তুলে ধরেছেন। অপর্ণা তার নিজের ভেতরের অভিনেত্রীসত্তাকে ভেঙে বহুবিধ নারীর লড়াইয়ের প্রতীক হয়ে ওঠে এই গল্পে! প্রাচ্যদেশের নারীর লড়াই, চাওয়া-পাওয়া, পুরুষতন্ত্র আর ঠকে যাওয়া নারীসত্তার নির্বাসন এই গল্পে অপর্ণাকে আলাদা করে চিনিয়ে দেবে!
স্টার নয়, অভিনেত্রী আমি
‘তথাকথিত স্টারিজম ভর করলে অভিনেত্রীর ভেতরটা মরে যায়’ অপর্ণা বলে। অপর্ণা অভিনেত্রী হতে চায়, পরিপূর্ণ অভিনেত্রী! সমূহ কোনো টার্গেট বা প্রথাবদ্ধ প্রতিযোগ নয়, অসাধারণ নিজস্ব ঘরানার ভেতর এই জনপদের অভিনেত্রী হওয়ার ইঙ্গিত আছে অপর্ণার ভেতর। নিজস্ব একটি অভিনয়ের ধারা তৈরি করে সীমানা পেরিয়েও কাজ করতে চায় সে। আমাদের চলচ্চিত্র পালটে যাওয়ার দিনে আমরা অপর্ণার মতো অসাধারণ প্রতিভাবান অভিনেত্রী চাইব নিশ্চয়ই।