মীনা এনেছে অনেক পরিবর্তন

মীনা
মীনা

মীনার প্রমো মিউজিকটি বাজতে যা দেরি, টেলিভিশনের কাছে পৌঁছাতে একটুও দেরি হয় না ছোট্ট বন্ধুদের। মীনা কার্টুন চরিত্রটি বাংলাদেশের প্রায় সব বয়সের শিশুর কাছেই সমান জনপ্রিয়। তারা মীনাকে গ্রহণ করেছে তাদের বয়সী একজন কাছের বন্ধু হিসেবেই। শিশুরা মীনার অনুকরণে কথা বলতে চায়। তাদের ভাবনাতেও মীনার প্রভাবকে অস্বীকার করার উপায় নেই।এ তো গেল শিশুদের কথা। কিন্তু বড়দের বেলায়! তাঁরাও কি মীনা কার্টুন দেখে প্রভাবিত হন? মীনার কথাগুলো কি নিজেদের জীবনের সঙ্গে মিলিয়ে দেখেন? মীনাকে নিয়ে বড়দের ভাবনার জগৎটা ঠিক কতটুকু, এসব জানতে কথা বলেছি কয়েকজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের সঙ্গে। ফারজানা ইসলাম কাজ করছেন একটি বেসরকারি সংস্থায়। তিনি বলেন, ‘আসলে মীনাই আমাকে শিখিয়েছে যে নারী-পুরুষের সমান অধিকার পাওয়া উচিত। আমার পরিবারে বাবা-মা আমাকে আর ছোট ভাইকে সমান সুবিধা দিত না। প্রায়ই দেখতাম ছোট ভাইকে খাবারটা একটু বেশি দিচ্ছে। অনুযোগ করলেই বলত, ছেলেরা একটু বেশিই খায়। ওদের কথার প্রতিবাদ করা শুরু করলাম মীনা কার্টুন দেখার পর থেকেই।’

আম্বিয়া আক্তার একজন গৃহিণী। বলেন, ‘আমি খুব বেশি পড়ালেখা করতে পারিনি। ভেবেছি, মেয়েদের তো এমনই হয়। কিন্তু মীনার মাধ্যমে আমি জানতে পারলাম যে মেয়েদের পড়ালেখা করা কতটা জরুরি।’

গৃহিণী নাজনীন রহমান বলেন একটু ভিন্ন কথা। তিনি বলেন, ‘আমার মা জোহরা বেগম তাঁর দুই ছেলের বিয়েতে যৌতুক নিয়েছেন। তখনো টিভিতে মীনা দেখাতে শুরু করেনি। তারপর যেই তিনি মীনা দেখতে শুরু করলেন, তাঁর চরিত্রে মেয়েদের প্রতি আলাদাভাবে একটা সহানুভূতি কাজ করতে লাগল। তারপর যখন তাঁর ছোট ছেলের বিয়ে দিলেন, তখনই আমরা বুঝতে পারলাম তিনি মীনার দ্বারা কতটা প্রভাবিত। আম্মা আমার ছোট ভাইয়ের বিয়েতে যৌতুক নেননি।’

রঞ্জনা বিশ্বাস একটি বেসরকারি সংস্থায় কাজ করেন। তাঁর জীবনে মীনার প্রভাব অন্য রকম। তিনি বলেন, ‘আমি নবম শ্রেণী থেকে মীনা দেখতে শুরু করি। এত বড় হয়ে দেখেছি। কিন্তু আমার কখনো মনে হয়নি, এটা শুধু ছোটদের বিষয়। বরং মনে হয়েছে, শিশু বয়স থেকেই এই বিষয়গুলো সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করা উচিত। আর আমি তো দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে গিয়ে কাজ করি। সেখানে অনেক মানুষের সঙ্গে কথা বলতে হয়। সেসব অঞ্চলে হয়তো জনগণ শুধু বিটিভিই দেখে। তখন আমি মীনা কার্টুনের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তাদের সঙ্গে কথা বলি।’

গৃহিণী শায়লা রহমান বলেন, ‘আমার এক মেয়ে। কিন্তু মীনা কার্টুন দেখার পর আমার মনে হয়েছে, আমার যদি ছেলেসন্তানও হয়, তবু আমি তাকে আলাদা চোখে দেখব না।’

চাকরিজীবী মাহমুদুর রহমান একটু সমালোচনার সুরে বলেন, ‘মীনা যৌতুক নিয়ে কথা বলছে, বাল্যবিবাহ নিয়ে কথা বলছে, স্বাস্থ্য সমস্যা নিয়ে কথা বলছে। এটা স্বাভাবিক মনে হয়। কিন্তু যখন মীনা বড়দের বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলে, বেশ অস্বস্তি লাগে নিজের কাছেই। কর্তৃপক্ষের এই বিষয়ে একটু নজর দেওয়া উচিত।’

মীনার বিষয়ে কথা হয় নারী আন্দোলনের কর্মী লুনা নূরের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘ছোট্ট একটা মেয়েচরিত্রের মাধ্যমে যে বার্তা জনগণকে দেওয়া হচ্ছে, তা সত্যি সবাইকে প্রভাবিত করেছে। মীনার মধ্যে যে দৃঢ়তা, সেটা মেয়েদের অনেক বেশি উৎসাহী করে। তবে যেটা মানুষ অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে শেখে, সে ধরনের বক্তব্য মীনার মুখ দিয়ে না বলানোই ভালো। আমি নিজে মীনা দেখেছি। তাই আমি চাই, আমার সন্তানেরাও মীনার কাছ থেকে কিছু শিখুক। প্রতিবছর মীনা দিবসে যেসব অনুষ্ঠান হয়, আমি ওদের সেসব অনুষ্ঠানে নিয়ে যাই।’

ব্যাংককের এশিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির জেন্ডার ও ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের গবেষক সোমা দে বলেন মীনাকে নিয়ে তাঁর ভিন্ন এক অভিজ্ঞতার কথা। তাঁর মেয়ে সুকন্যা প্রাচীর একজন সহপাঠী আদিবাসী শিশু। কিন্তু সেই শিশুর সঙ্গে সহজে কেউ মিশত না। অনেকে তাকে উপহাস করত। সুকন্যাও খুব একটা উৎসাহ দেখাত না ওর প্রতি। সোমা দে বলেন, ‘আদিবাসী শিশু নিয়ে মীনার কমিক বই নতুন বন্ধু পিনুই বইটি আমি আমার মেয়েকে পড়াই। ওকে আদিবাসীদের সম্পর্কে বুঝিয়ে বলি। তারপর ও বুঝতে পারল। সেই মেয়ের সঙ্গে আমার মেয়েই প্রথম বন্ধুত্ব করে। তারপর অন্যদেরও বলতে শুরু করে। এখন ওর ক্লাসের প্রায় সবাই আদিবাসী মেয়েটির সঙ্গে বন্ধুত্ব করেছে। আমার তো মনে হয়, মীনা এমন একটা চরিত্র, যেটা খুব সহজেই এই অঞ্চলের মানুষকে প্রভাবিত করতে পারে।’

সোনালী ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে কর্মরত রশিদুল ইসলাম বলেন, ‘আমি মীনার প্রায় সব পর্বই দেখেছি। এটা সবার জন্যই শিক্ষণীয়। আমার মধ্যেও অনেক ভুল চিন্তা ছিল, যেগুলো দূর হয়ে গেছে মীনার কার্টুন দেখার পর। আমি চাই, আমার মেয়েটা যেন মীনার মতো সাহসী হয়। মেয়েটা সমাজের জন্য কিছু করুক, এটাই আমার প্রত্যাশা। এ জন্য ওকে বিভিন্ন সামাজিক কাজেও যুক্ত করার চেষ্টা করি।’