এগিয়ে চলবে ডাক্তার ভাইয়ের স্বপ্নযাত্রা

এড্রিক বেকার (১৯৪১–২০১৫)
এড্রিক বেকার (১৯৪১–২০১৫)

সবাইকে কাঁদিয়ে হঠাৎ চলে গেলেন ডা. এড্রিক বেকার। তাঁর মৃত্যুর পর অনেকের মনেই প্রশ্ন—কীভাবে চলবে তাঁর গড়ে তোলা কাইলাকুড়ি স্বাস্থ্যকেন্দ্র? উত্তরটা ইতিবাচক। কারণ, জীবদ্দশাতেই ডা. বেকার সবকিছু গুছিয়ে গেছেন। তাই তিনি না থাকলেও তাঁর স্বপ্নের পথচলা থেমে নেই। ১ সেপ্টেম্বর মারা যান
এড্রিক বেকার।
‘এখন সশরীরে তিনি নেই। তবে তাঁর নির্দেশনা ধরেই চলছে স্বাস্থ্যসেবা।’ ৯ সেপ্টেম্বর টাঙ্গাইলের মধুপুর উপজেলার কাইলাকুড়ি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে বসে এ কথাগুলোই বলছিলেন কেন্দ্রের প্রশাসক (স্বাস্থ্য কর্মসূচি) নুরুল আমিন।
এড্রিক বেকারের জন্ম ১৯৪১ সালে নিউজিল্যান্ডের রাজধানী ওয়েলিংটনে। ১৯৬৫ সালে এমবিবিএস ডিগ্রি অর্জন করে নিউজিল্যান্ড সরকারের সার্জিক্যাল টিমে যোগ দিয়ে চলে যান যুদ্ধবিধ্বস্ত ভিয়েতনামে। সেখানে কাজ করেন ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত। মাঝখানে অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ডে স্নাতকোত্তর কোর্স করেন ট্রপিক্যাল মেডিসিন, স্ত্রীরোগ ও ধাত্রীবিদ্যা এবং শিশুস্বাস্থ্য বিষয়ে। ১৯৭৯ সালে চলে আসেন বাংলাদেশে।
বাংলাদেশে এসে এড্রিক বেকার মেহেরপুর মিশন হাসপাতালে প্রায় দুই বছর এবং পরে টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে কুমুদিনী হাসপাতালে কাজ করেন। এরপর যোগ দেন মধুপুর গড় এলাকার থানারবাইদ গ্রামের চার্চ অব বাংলাদেশের একটি ক্লিনিকে।
তখন থেকে পাহাড়ি এলাকায় বসবাস করে স্বাস্থ্যসেবা দিতে শুরু করেন বেকার। থানারবাইদের পাশের গ্রাম কাইলাকুড়িতে ১৯৯৬ সালে স্বাস্থ্যকেন্দ্র খুলে চিকিৎসাসেবা দেওয়া শুরু করেন তিনি। ২০০২ সালে পূর্ণাঙ্গ স্বাস্থ্যকেন্দ্র চালু করেন এড্রিক বেকার।
এই এলাকার মানুষেরা বেকারকে ‘ডাক্তার ভাই’ কিংবা ‘বেকার ভাই’ বলেই ডাকতেন। কাইলাকুড়ি গ্রামের আমজাদ হোসেন এই প্রতিবেদককে জানান, এড্রিক বেকার আসার পর এ এলাকার কেউ বিনা চিকিৎসায় মারা যায়নি। ইদিলপুর গ্রামের অনুরাধা ম্রং বলেন, কারও অসুখ হলে ছুটে আসতেন এই হাসপাতালে এবং বিনা পয়সায় চিকিৎসাসেবা পেতেন।
কথা হলো মধুপুরের শোলাকুড়ি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ইয়াকুব আলীর সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘ডাক্তার ভাইয়ের কোনো চাওয়া-পাওয়া ছিল না। ছোট্ট একটি মাটির ঘরে থাকতেন। নিঃস্বার্থভাবে তিনি মানুষের সেবা করে গেছেন। তাঁর কারণেই এলাকার মানুষ ঘরের কাছে ভালো চিকিৎসা পেয়েছেন।’

১৭ মার্চ ২০১২, ছুটি​র দিনের প্রচ্ছদ প্রতিবেদনে এড্রিক বেকার
১৭ মার্চ ২০১২, ছুটি​র দিনের প্রচ্ছদ প্রতিবেদনে এড্রিক বেকার

এড্রিক বেকার মারা যাওয়ার দুই দিন আগে শ্বাসকষ্টজনিত রোগে অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাঁকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় নিতে চান সহকর্মীরা। কিন্তু তিনি যেতে রাজি হননি। জানিয়েছিলেন তাঁর ইচ্ছা, শেষনিশ্বাস এখানেই ত্যাগ করবেন। ২ সেপ্টেম্বর তাঁকে কাইলাকুড়ি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে সমাহিত করা হয়।
কাইলাকুড়িতে তাঁর সমাধিতে অনেকেই এসে শ্রদ্ধা নিবেদন করছেন। স্বাস্থ্যকেন্দ্রের বহির্বিভাগে স্বাস্থ্য সহকারীরা সেবা দিচ্ছেন। ভর্তিও রয়েছেন ৩০ জন রোগী।
কাইলাকুিড় স্বাস্থ্যকেন্দ্রটির খরচ জোগাতে ডা. বেকার তাঁর আত্মীয় ও বন্ধুদের সমন্বয়ে গড়ে তুলেছিলেন নিউজিল্যান্ড লিংক গ্রুপ। এড্রিক বেকার তাঁর অনুপস্থিতিতে কাইলাকুড়িতে স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার জন্য দেশে-বিদেশে অনেক জায়গায় যোগাযোগ করেছেন। তাঁর ডাকে সাড়া দিয়ে গণস্বাস্থ্য মেডিকেল কলেজ থেকে একজন করে শিক্ষানবিশ চিকিৎসক এখানে সব সময় রাখা হতো। এখন থেকে দুজন করে শিক্ষানবিশ চিকিৎসক থাকবেন এখানে।
এড্রিক বেকারের মৃত্যুর পর শোকবই খোলা হয়েছে কালাইকুিড় স্বাস্থ্যকেন্দ্রে। বইতে মধুপুরের জলছত্র এলাকার বাসিন্দা অনিতা সাংমা লিখেছেন, ‘তাঁর মৃত্যু নয়, আমি এখনো উনার পদধ্বনি শুনতে পাই।’ এই বাক্যগুলোই যেন ধ্বনিত হতে থাকে মো. নুরুল আমিনের কথায়, ‘ডা. বেকার সব ব্যবস্থাই করে গেছেন। আমাদের দায়িত্ব শুধু তাঁর দেখানো পথে এগিয়ে চলা।’