কম বিদ্যুতের ইলেকট্রনিকসের খোঁজে সায়ীফ সালাউদ্দিন

ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া বার্কলিতে গবেষক ও সহকর্মীদের সঙ্গে সায়ীফ সালাউদ্দিন (ডান থেকে দ্বিতীয়)। ছবি: সংগৃহীত
ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া বার্কলিতে গবেষক ও সহকর্মীদের সঙ্গে সায়ীফ সালাউদ্দিন (ডান থেকে দ্বিতীয়)। ছবি: সংগৃহীত

‘প্রেসিডেন্টস আর্লি ক্যারিয়ার অ্যাচিভমেন্ট পুরস্কারের জন্য তোমাকে মনোনীত করা হয়েছে। তবে প্রেসিডেন্ট আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা না করা পর্যন্ত বিষয়টি কাউকে না জানানোর জন্য তোমাকে অনুরোধ করা হলো।’ মার্কিন রাষ্ট্রপতির ‘অফিস অব দ্য সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি’ থেকে এই ই-মেইল সায়ীফ পেয়েছেন প্রায় বছর খানেক আগে। এই দপ্তরটির কাজ হলো বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির নীতি, উদ্ভাবন ও উৎসাহমূলক কর্মকাণ্ডে দেশের রাষ্ট্রপতিকে সহায়তা করা। ই-মেইল পাওয়ার পর থেকে সায়ীফ জানতেন তিনি এই পুরস্কারটি পাচ্ছেন। কিন্তু অপেক্ষার প্রহর দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়েছে। এ বছরের শুরুতে তাঁর একবার মনে হয়েছে, নভেম্বরেই তো বারাক ওবামার মেয়াদ শেষ হয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে যদি না হয় তাহলে তো অপেক্ষার সময় আরও লম্বা হয়ে যাবে। তবে সেটা আর হয়নি। কয়েক দিন আগে সায়ীফের ছোট ছেলে সামি জামানের প্রথম জন্মদিনের আগেভাগেই আনুষ্ঠানিক ঘোষণাটি এসেছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ১০৬ জন বিজ্ঞানী-গবেষককে আর্লি ক্যারিয়ার অ্যাচিভমেন্টের জন্য নির্বাচিত করে নাম ঘোষণা করেছেন। তার মধ্যে সায়ীফ সালাউদ্দিন একমাত্র বাংলাদেশি।

গবেষণাগারে সায়ীফ
গবেষণাগারে সায়ীফ

‘কাজের স্বীকৃতি তো। ভালোই লাগছে। কারণ কাজটা করছি মনোযোগ দিয়ে আর এটাতেই তো লেগে আছি।’ টেলিফোনে আমাকে বলছিলেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) এই স্নাতক, বর্তমানে ইউনিভার্সিিট অব ক্যালিফোর্নিয়া বার্কলির সহযোগী অধ্যাপক। সায়ীফ সম্পর্কে তাঁর শিক্ষক ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক কৌশল বিভাগের অধ্যাপক আনিসুল হক বলেন, ‘বুয়েটে শুরু থেকেই সায়ীফের লক্ষ্য ছিল ইলেকট্রনিকসের ওপর গবেষণা। আর এ বিষয়ে তাঁর লেগে থাকার নিষ্ঠা অতুলনীয়। কিন্তু এর পাশাপাশি খেলাধুলা, রাজনীতি কিংবা সমাজ নিয়েও সায়ীফ সম্যকভাবে ওয়াকিবহাল থাকতেন।’
সায়ীফের কাজ সম্পর্কে প্রথম আলোর পাঠকেরা আগে থেকেই জানেন (‘আমিই বাংলাদেশ: বিদ্যুৎসাশ্রয়ী ইলেকট্রনিকস’, আগস্ট ২৬, ২০১৪, প্রথম আলো)। বিদ্যুতের ব্যবহার কম হবে এমন ইলেকট্রনিকসের সন্ধান করছেন তিনি। কেন, এই প্রশ্নের জবাবে সায়ীফ বললেন, ‘কম্পিউটার আর ইলেকট্রনিকসের কারণে বিদ্যুতের চাহিদা অ-নে-ক বেড়ে যাচ্ছে। ২০১২ সালে পৃথিবীর সব ডেটা সেন্টার মিলে নরওয়ের সমান শক্তি খরচ করত। এখন এটা আরও বেড়ে গেছে! তো, ইলেকট্রনিকসের একেবারে মূলে যে ট্রানজিস্টর আর সুইচিং, সেখানে যদি কোনোভাবে শক্তির খরচ কমানো যায়, তাহলে এই ক্ষেত্রে আমরা অনেকখানি এগোতে পারব।’
এই চিন্তা থেকে যুক্তরাষ্ট্রের পার্ডু বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি গবেষণা করার সময় সায়ীফ একটি নতুন তত্ত্ব দাঁড় করলেন। ইলেকট্রনিকস সামগ্রীর মূল চালক মাইক্রোপ্রসেসরের কেন্দ্রে রয়েছে ট্রানজিস্টর। সায়ীফ বললেন, ‘ট্রানজিস্টরের মধ্যে একসঙ্গে একই কাজে সম্পৃক্ত ইলেকট্রনগুচ্ছের একটিকে স্থানান্তর করা হলে বাকিগুলোও সেটিকে অনুসরণ করবে বাড়তি শক্তি ছাড়াই। আর এভাবে পাওয়া যাবে কম শক্তির ইলেকট্রনিকস।’ সায়ীফ এর নাম দিলেন ‘নেগেটিভ ক্যাপাসিটেন্স’।
কিন্তু প্রচলিত ইলেকট্রনিকস সামগ্রীতে একটি একটি করে ইলেকট্রন স্থানান্তরিত হয়। ফলে একটি ইলেকট্রনকে পাঠাতে যত শক্তি লাগে, হাজারটা পাঠাতে তার চেয়ে হাজার গুণ শক্তি লাগে। এভাবে বিদ্যুৎশক্তি খরচও বেড়ে যায়।
বিষয়টা হাতে হাত ধরা অনেক লোকের মিছিলের সঙ্গে তুলনা করা যায়। যদি সবাই হাতে হাত ধরে থাকে তাহলে প্রথমজনকে বাঁয়ে ঘুরিয়ে দিলে সবাই বাঁয়েই চলে যাবে। কিন্তু যদি মিছিলটা বিশৃঙ্খল থাকে তাহলে প্রত্যেকের কাছে কোনো না কোনোভাবে বাঁয়ে ঘোরার বার্তা পৌঁছাতে হবে।
নেগেটিভ ক্যাপাসিটেন্সের ধারণাটি এতই যুগান্তকারী ছিল যে অর্ধপরিবাহীর বিকাশের রোডম্যাপে এটি সঙ্গে সঙ্গে জায়গা করে নেয়। যদিও অন্যান্য আবিষ্কারের বেলায় ‘পরীক্ষাগারে প্রমাণিত হওয়া’ পর্যন্ত সবাই অপেক্ষা করে! ২০০৮ সাল থেকে বিশ্বের প্রায় সব বড় বড় ল্যাবরেটরিতে এই তত্ত্বকে পরীক্ষামূলকভাবে প্রমাণের চেষ্টা হয়েছে। শেষ পর্যন্ত ২০১১ সালে বার্কলের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজ পরীক্ষাগারে সায়ীফই সেটা প্রথম প্রমাণ করে দেখান। এরপর তাঁর গবেষণাগারে ‘নিয়ন্ত্রিত পরিবেশেও’ এটি নিয়ে অনেক কাজ হয়েছে। অবশেষে গত ডিসেম্বর মাসে ইন্টারন্যাশনাল ইলেকট্রন ডিভাইস মিটিংয়ে (আইইডিএম) সায়ীফ দলবল নিয়ে প্রচলিত ৩০ ন্যানোমিটারের চ্যানেলে নেগেটিভ ক্যাপাসিটেন্সের সফল প্রয়োগ দেখালেন। গত বছর নেচার ম্যাটেরিয়ালস জার্নালেও এ সম্পর্কে একটি বিস্তারিত নিবন্ধ ছাপা হয়েছে। সায়ীফের ধারণা, এখন বিদ্যুতাশ্রয়ী ইলেকট্রনিকসের নতুন যুগের সূচনা হওয়ার বাধাগুলো একে একে কেটে যাচ্ছে।
ইতিমধ্যে সায়ীফের পেশাদারি ঝুলিতে জমা হয়েছে নানা পুরস্কার ও স্বীকৃতি। এর মধ্যে মার্কো-এফসিআরপি ইনভেন্টর রিকগনিশন পুরস্কার (২০০৭), যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল সায়েন্স ফাউন্ডেশনের ইয়ং ইনভেস্টিগেটর পুরস্কার (২০১০), এফোসর (এএফওএসআর) ইয়ং ইনভেস্টিগেটর পুরস্কার (২০১৩), এআরও ইয়ং ইনভেস্টিগেটর অ্যাওয়ার্ড (২০১৩) ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। আর এর সঙ্গে এখন যুক্ত হলো আর্লি ক্যারিয়ার এচিভমেন্ট পুরস্কার।
পুরস্কারের খবর দেশে ছড়িয়ে পড়ার পর থেকে অনেক অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা পাচ্ছেন সায়ীফ। তবে দুঃখ পেয়েছেন দেশীয় বিভিন্ন মাধ্যমে তাঁকে ‘কম্পিউটার বিজ্ঞানী’ হিসেবে অভিহিত করায়। ‘ছোটবেলা থেকে ইলেকট্রনিকসেই আমার আগ্রহ এবং ইলেকট্রনিকস নিয়েই কাজ করে যাব।’ জানালেন তিনি।
সায়ীফের বাবা এ এস সালাউদ্দীন বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্যশিল্প করপোরেশনের অবসরপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। মা সায়েদা সালাউদ্দিন গৃহিণী। স্ত্রী তানভীন জামান, পাঁচ বছরের ছেলে সাফী মাহির সালাউদ্দিন ও এক বছর বয়সী সামি জামান সালাউদ্দিনকে নিয়ে তাঁর সংসার। কাজের ফাঁকে অবসরের সবটুকু পরিবারের সঙ্গেই কাটে আমাদের গৌরব সায়ীফ সালাউদ্দিনের।