গরম-গরম মহিলা সিট!

মহিলা আ​সনে মহিলা কোথায়? l ছবি: প্রথম আলো
মহিলা আ​সনে মহিলা কোথায়? l ছবি: প্রথম আলো

রাজধানীর ৮ নম্বর বাস সার্ভিসের চালকের সহকারী সোহেলকে প্রশ্ন করা হলো-‘বাসের লেডিস সিট কেন ইঞ্জিনের ওপর থাকে?’ খুব সরল হাসি দিয়ে সোহেল তাঁর সাধ্যমতো ভেবেচিন্তে বলেন, ‘লেডিসরা তো চালু গাড়িতে উইঠা পিছের দিকের সিটে যাইতে পারব না। তাই উনাদের জন্য সামনে সিট রাখা হইছে। বাসে উইঠাই যেন তারা বসতে পারে। আর নামার সময় যেন জলদি গেটে আইসা পড়তে পারে। তাইলে তাদেরও সুবিধা হয়, আমাগোও হয়।’
এমন ব্যাখ্যা দিয়েছেন রাজধানীর বিভিন্ন রুটের বাস সার্ভিসের আরও বেশ কয়েকজন চালক ও চালকের সহকারী। অনেকে কথার মাঝখানে বিরক্তি নিয়ে জানান, এই ‘লেডিস সিট’ নাকি রোজকার অনেক বিবাদ আর কলহের কারণ। প্রতিদিন প্রতি ট্রিপেই লেডিস সিট নিয়ে কোনো না কোনো ঝামেলায় পড়তে হয় তাঁদের। তাই তাঁদের কাছে এই লেডিস সিটের মানে হলো উটকো এক ঝামেলা।
সরকারের বিআরটিসি বাস হোক কিংবা বেসরকারি ৬ অথবা ৮ নম্বর লোকাল বাস—সব বাসেই থাকে নারীদের জন্য নির্দিষ্ট সংখ্যক আসন। প্রতিটি বাসে নারী আসন হয়ে থাকে পাঁচ থেকে ১২টি। সেই আসন আবার শিশু ও প্রতিবন্ধীদের সঙ্গে ভাগ করে নিতে হয়। হাতেগোনা কিছু বাস সার্ভিস বাদে প্রায় সব বাসেই নারীদের সিট থাকে চালকের পাশে ইঞ্জিনের ওপর কিংবা ইঞ্জিনের কাছাকাছি স্থানে। ইঞ্জিনের কারণে সেই আসনগুলো শীতের দিনেও এত উত্তপ্ত থাকে যে কোনো সাধারণ বাসযাত্রী আসন না পেলে বাধ্য হয়ে সেখানে বসেন। কিন্তু নারী বাসযাত্রীদের সেই আসনেই বসে যেতে হচ্ছে নির্দিষ্ট গন্তব্যে। কখনো আবার সে আসনটিও জোটে না।

প্রতিদিন এই প্রতিবেদকের বাসে যাতায়াত করার অভিজ্ঞতায় দেখা যায় সকালের অফিস শুরুর সময় এবং বিকেলে অফিস ছুটির সময় সেই আসন পাওয়া আরও কঠিন হয়ে ওঠে। কারণ সে সময় রাজধানীর ‘সিটিং’ বাস সার্ভিসগুলোও লোকালের মতো যাত্রী নেওয়া শুরু করে। তাই প্রথমেই একজন নারী যাত্রীকে বাসের দরজা পর্যন্ত পৌঁছাতে হয় অনেক পুরুষ সহযাত্রীর ধাক্কা খেয়ে। বাসে ওঠার পর দরজার কাছের ভিড় ঠেলে ইঞ্জিনের ওপর এক থেকে দেড় ফুট উঁচু আসনে উঠতে রীতিমতো শাড়ি কাছা দিতে হয়। কোনো হতভাগ্য যাত্রী যদি নারী আসন না পান তাহলে তাঁকে সেগুলোর পাশেই ইঞ্জিনের কাছাকাছি কোনো জায়গায় দাঁড়াতে হবে—এটাই রাজধানীর বাস সার্ভিসের অলিখিত এক নিয়ম।

সবচেয়ে ভয়ংকর চিত্র দেখা যায় রাতে চলা বাসগুলোতে। সিটিং বাস সার্ভিস হোক কিংবা লোকাল—রাত আটটা-নয়টার পর কোনো বাসযাত্রী বোঝাই হলে তাতে নারী যাত্রীদের ওঠানো হয় না। সে সময় নারী আসনে পুরুষ যাত্রীরা বসা থাকলেও তাতে নারীদের ওঠানো হয় না। নাম প্রকাশ না করে শিকড় পরিবহনের এক চালকের সহকারী এ নিয়ে বলেন, ‘রাতের বেলা মহিলাদের না নেওয়ার কারণ আছে। লেডিস সিটে একসঙ্গে পাঁচজন যাত্রী বসতে পারে। কিন্তু একজন মহিলা যাত্রী যদি ওই সিটে বসে, তাইলে আমরা বড়জোর দুইজন পুরুষ যাত্রী বসাইতে পারি। আমাদের দুইজনের ভাড়া মাইর যায়। আর তখন পুরুষ যাত্রীরাই চিল্লায়। রাতে পাঁচজন মহিলা যাত্রী পাওয়া যায় না।’

কিছুদিন আগে রাত আটটার দিকে কারওয়ান বাজারে বাসের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকা নারী যাত্রী মিথিলাকে প্রশ্ন করা হলো তাঁর গন্তব্য কোথায়? জানান, ‘বাসাবো’। মিথিলা বলেন, ‘বাসাবোর দরকার নেই। কমলাপুর, মতিঝিল, গুলিস্তান—যেকোনো একটা রুটের বাসে উঠতে পারলেই হয়। কিন্তু কোনো বাসই তো নিতে চায় না।’ বিকেলে অফিস ছুটির সময়ও নারী যাত্রীদের এমন ভোগান্তির শিকার হতে হয়।

বাসে আসন না পেলে তো ভোগান্তি থাকে। পেলেও ভোগান্তি থাকে। গত সপ্তাহে মতিঝিল-মোহাম্মদপুর রুটের এটিসিএল বাস সার্ভিসে উঠে দেখা গেল তেমনই ভোগান্তির এক চিত্র। বাসে দাঁড়িয়ে থাকা এক নারীযাত্রী চালকের সহকারীর সঙ্গে সিট নিয়ে বাগ্‌বিতণ্ডায় লিপ্ত। পাশ থেকে অন্য আসনে বসে থাকা কয়েক জন পুরুষ যাত্রীর একজন বললেন, ‘লেডিস সিট ভরা দেইখা বাসে উঠছেন ক্যান?’ এসব শুনে নারী যাত্রীটি যখন বলেন, ‘আমি অসুস্থ। বারডেম থেকে বেরিয়ে বাসে উঠলাম মাত্র।’ তখন আরেকজন পুরুষযাত্রী বলেন, ‘ওই উনারে প্রতিবন্ধী সিটে বসা। ও ওইখানেও তো লেডিসে বইসা আছে!’ এমন ঘটনা বাসে হরহামেশাই ঘটে।

আরও যে ঘটনা নারী বাসযাত্রীদের সঙ্গে প্রায়শই ঘটে তা হলো শারীরিক হয়রানি। 

বাসে উঠলে এ ধরনের হয়রানি, রিকশায় চড়লে বাইক, মাইক্রোবাস থেকে ব্যাগ ছিনিয়ে নেওয়ার ভয় আর সিএনজি অটোরিকশায় মলম পার্টির ভয়—এসব আতঙ্ক নিয়েই প্রতিদিন জীবিকার তাগিদে পথে বের হন লাখো নারী। ইঞ্জিনের পাশে বরাদ্দকৃত ‘গরম-গরম’ নারী আসনের জন্য প্রতিদিনই যুদ্ধে নামছেন তাঁরা।