নৃত্যে নন্দিতা

এগনেস র‌্যাচেল প্যারিস
এগনেস র‌্যাচেল প্যারিস

সাধনা, একাগ্রতা ও নিষ্ঠার মাধ্যমে নতুন প্রজন্মের যে কজন নৃত্যশিল্পী বাংলাদেশের নাচের জগতে নতুন আলোর দিশাির হতে ব্রতী হয়েছে, এগনেস র্যা চেল প্যারিস তাদের অন্যতম। যে আমাদের কাছে প্রিয়াংকা নামে পরিচিত। ২০০৭ সালে নৃত্যাঞ্চল আয়োজিত ভারতের স্বপন মজুমদার পরিচালিত ‘ছৌ-নৃত্য’ কর্মশালায় প্রিয়াংকা প্রথম সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। কর্মশালা চলার সময় শেখার ব্যাপারে ওর একাগ্রতা, কর্মশালার সমাপনী অনুষ্ঠানে ওর নৃত্য পরিবেশনা সবাইকে মুগ্ধ করে।
মাত্র তিন বছর বয়সে নাচে হাতেখড়ি হয়। প্রিয়াংকা বুলবুল একাডেমিতে সাত বছরের কোর্স সমাপ্ত করে ২০০৩ সালে শিবলী মহম্মদ ও শামীম আরা নিপা পরিচালিত নৃত্যাঞ্চলে শিক্ষার্থী হিসেবে যোগ দেয়। ২০০৪ সালে নৃত্যাঞ্চল আয়োজিত ভারতের প্রফেসর মহুয়া মুখোপাধ্যায়ের পরিচালনায় গৌড়ীয় নৃত্যের কর্মশালায় অংশ নেয়। এই কর্মশালা থেকেই প্রিয়াংকার নৃত্যজীবনে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়।
এটি বাংলার শাস্ত্রীয় নৃত্য। এটি পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছেন গুরু প্রফেসর শ্রীমতি মহুয়া মুখোপাধ্যায়। এ নৃত্যটির প্রথম নামকরণ করা হয় ১৯৯৪ সালের ২১ সেপ্টেম্বর। নামকরণ করেন প্রখ্যাত ভারতত্ত্ববিদ প্রফেসর ব্রতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় এবং মহুয়া মুখোপাধ্যায়। প্রাচীন বাংলার নাম ছিল গৌড়বঙ্গ। ‘গৌড়’-এর নামানুসারে বাংলার শাস্ত্রীয় নৃত্যধারার নামকরণ করা হয়েছে গৌড়ীয় নৃত্য। মহুয়া মুখোপাধ্যায়ের দীর্ঘ ৩০ বছরের গবেষণার ফল গৌড়ীয় নৃত্য। নৃত্য, গীত, বাদ্য, নাট্যের সমন্বয় রয়েছে এতে।
গৌড়ীয় নৃত্যশৈলী প্রিয়াংকাকে মুগ্ধ করে। এই নৃত্যশৈলী প্রথাগতভাবে শেখার অদম্য ইচ্ছায় ২০০৭ সালে ভারত সরকারের আইসিসিআর বৃত্তি নিয়ে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি। সেখানে ভরতনাট্যম শেখার পাশাপাশি গৌড়ীয় নৃত্য শেখা শুরু করে মহুয়া মুখোপাধ্যায়ের প্রতিষ্ঠান গৌড়ীয় নৃত্য ভারতীতে। প্রিয়াংকার গুরু ওকে একটি কথা বলেছিলেন, ‘এক সাধে তো সব সাধে।’ এর মানে হলো একটি বিষয় অধ্যবসায়ের সঙ্গে শিখলে তার প্রতিফলন অন্যান্য বিষয়ে পড়ে। তাই মন-প্রাণ এক করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভরতনাট্যম শেখার পাশাপাশি গৌড়ীয় নৃত্য শেখা অব্যাহত রাখে প্রিয়াংকা। গুরু-শিষ্য পরম্পরায় নৃত্য-গীত-বাদ্য—এই তিনটি শিল্পের সর্বোচ্চ শিক্ষা সম্ভব হয় গুরুগৃহে বাস করলে। প্রিয়াংকার সৌভাগ্য হয়েছিল গুরুগৃহে থেকে নাচ শেখার। গুরুগৃহে থাকার ফল হলো শুধু নাচে নয়, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তার প্রভাব পড়ে। খাদ্যাভ্যাস, বেশভূষা, আচার-ব্যবহার, পড়াশোনা—সর্বোপরি মনের উন্মুক্ত দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করতে প্রিয়াংকাকে সহায়তা করেছিল গুরুগৃহে গুরুর একান্ত সান্নিধ্য।
শিক্ষা শেষ করে দেশে ফিরে এসে প্রিয়াংকা বাংলাদেশে গৌড়ীয় নৃত্যের প্রচার ও প্রসারে বিশেষ ভূমিকা রেখে চলেছে। উল্লেখযোগ্য নানা অনুষ্ঠানে নৃত্য পরিবেশন ছাড়াও প্রিয়াংকা বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে নৃত্যকর্মশালা ও সেমিনার পরিচালনা করেছে।
দেশ ছাড়িয়ে বিদেশেও প্রিয়াংকা বাংলার শাস্ত্রীয় নৃত্য গৌড়ীয় নাচ পরিবেশন করে সুনাম অর্জন করেছে। ইতিমধ্যে রাশিয়া, ফ্রান্স, নরওয়ে, ইন্দোনেশিয়া, চীন, ওমান, শ্রীলঙ্কা, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও ভারত সফর করেছে।
দেশে ও বিদেশে নৃত্যে উল্লেখযোগ্য কৃতিত্বের জন্য নানা পুরস্কারও পেয়েছে প্রিয়াংকা। নর্থ আমেরিকান বেঙ্গলি কনফারেন্স ও রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বর্ণপদক পেয়েছে সে। জাতীয় শিক্ষা সপ্তাহ, ভারতের পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য সংগীত একাডেমি, ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউটের পুরস্কারসহ আরও অনেক অর্জন আছে তার ঝুলিতে।
প্রিয়াংকা বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নৃত্যকলা বিভাগে নৃত্যশিক্ষক হিসেবে যোগ দিয়েছে এবং নৃত্যাঞ্চলে গৌড়ীয় নৃত্য শিক্ষা দিচ্ছে। প্রিয়াংকার মতে, গৌড়ীয় নৃত্যের দেহভঙ্গি, গানের সুর, তালের মিষ্টতা এবং সর্বপ্রধান এর বাংলা ভাষা ওর মাঝে এক স্বর্গীয় অনুভূতির সৃষ্টি করে। একজন নৃত্যশিল্পী হিসেবে, বিশেষ করে মেয়ে হওয়ার পরও নাচকে জীবনের নেশা থেকে পেশা হিসেবে নেওয়ার পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান রেখেছেন তার মা রোজলীন প্যারিস ও বাবা জন প্যারিসসহ পুরো পরিবার। বিশেষত, মায়ের প্রবল ইচ্ছা এবং অদম্য শক্তিই এই পথে চলার সাহস ও শক্তি জুগিয়েছে তাকে। প্রিয়াংকার জন্য রইল আশীর্বাদ। ও যেন বাংলাদেশের নৃত্যজগতে নতুন আলো এনে দিতে পারে। নতুন নতুন সৃষ্টির মাধ্যমে নৃত্যজগৎকে সমৃদ্ধ করতে পারে।
লেখক: নৃত্যব্যক্তিত্ব