হতাশ করো, চঞ্চল করো, ধাক্কা মারো হে

আবু শাহেদ । ছবি: সংগৃহীত
আবু শাহেদ । ছবি: সংগৃহীত

বুসান শহরে একটা সিফুড রেস্টুরেন্ট আছে, হেউন্দাই বিচের ওপর। ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল গেস্টদের কাছে এটি খুব জনপ্রিয়। সেখানে আমি খাবারের অর্ডার দিয়ে অপেক্ষা করছি আর্মি ক্যাম্প থেকে এক যুবকের পালিয়ে আসার অপেক্ষায়। ওই যুবকের নাম আবু শাহেদ ইমন। আর আর্মি ক্যাম্পটা আসলে এশিয়ান ফিল্ম একাডেমির হোস্টেল।
সময়কাল দুই হাজার দশ, নাকি এগারো? সাল-তারিখ খুব স্পষ্ট করে মনে থাকে না আমার। কারণ যাহাই দশ, উহাই আসলে এগারো।
এই লেখা লিখছি ছবির শুটিংয়ে যাওয়ার পথে, গাড়িতে বসে। তার ওপর সকালে আবু শাহেদ ইমনের কাছ থেকেই খবর পেলাম, টেলিভিশন ছবির অভিনেতা কোরিয়াপ্রবাসী ইমাম লি ক্যানসারের কাছে হেরে চলে গেছেন আমাদের জানা দুনিয়ার বাইরে। ফলে পাঠক, নিশ্চয়ই বুঝতে পারবেন মনের কী বিক্ষিপ্ত দশায় এই লেখা লিখছি।
কেন লিখছি তাহলে? এর বীজ লুকানো আছে ওই দশ কিংবা এগারো সালের সেই লাঞ্চ কিংবা ডিনারে।
সেদিন ইমনের সঙ্গে কথা বলতে বলতে বোঝার চেষ্টা করছিলাম ওকে। ও কী করতে চায়, কেন চায়? আমাদের দেশে নতুন সিনেমার পথ অতিশয় বন্ধুর। অনুকরণশীল তোতা না হলে এখানে টিকে থাকা মুশকিল। কিন্তু আমাদের নতুন সিনেমার গল্প তো তোতা পাখি দিয়ে হবে না। দরকার শালিক, ঘুঘু, কোকিল, ময়নাসহ বিচিত্র সব জাত। ফলে নতুন ফিল্ম মেকারদের সঙ্গে কথা বলার সময়-সুযোগ হলে প্রথমেই বোঝার চেষ্টা করি, ইঞ্জিনের কী অবস্থা। ইমনের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতেই বুঝলাম আমাদের আরেকজন সহযোদ্ধা পাওয়া গেল। তখনো ও টেলিভিশন প্রোডাকশনের বাইরে কিছু করেনি। এর আগে তারেক মাসুদ ও মোরশেদুল ইসলাম ভাইয়ের সহকারী হিসেবে কাজ করেছে কেবল। কোনো চলচ্চিত্রকারকে বোঝার জন্য এগুলো খুবই অপ্রতুল রেফারেন্স। কিন্তু ওর স্বপ্ন, সাহস, প্রতি মুহূর্তে নতুন কিছু শেখার ও প্রয়োগ করার আগ্রহই আমাকে বলেছে এবং এখনো বলছে ওর গন্তব্যের কথা।
ভরপুর ভোজনপর্ব শেষে আমরা যে যার পথে চলে গেলাম। এরপর খবরের নতুন অধ্যায়। একদিন ইমন জানাল, কোরিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে ও ফিল্মের ওপর পড়ার জন্য স্কলারশিপ পেয়েছে। বুঝলাম, কমরেড ঠিক পথেই চলেছে। তারপর একদিন জানাল, সে শর্ট ফিল্ম শুট করছে কোরিয়াতে, ইমাম লি-কে নিয়ে। নাম ‘দ্য কন্টেনার’। বানানো শেষে দেখতে পাঠাল। মুগ্ধ হয়ে দেখলাম ছবিটা। দারুণ গর্ব হলো। হ্যাঁ, বাংলাদেশ ঠিক পথেই আগাচ্ছে, হোক না তা ছোট পদক্ষেপে। এখনো আমার কাছে ইমনের সেরা কাজ ‘কন্টেনার’! যদিও আমি জানি সবে তো ওর শুরু। আরও বহু ‘সেরা’ নিয়ে সে আমাদের নাড়া দিয়ে যাবে।
এরপর আবার বুসান, আবার সেই রেস্টুরেন্ট।
‘ভাইজান, ফিচার ফিল্ম বানাইতে চাই।’
‘বানা।’
‘কেমনে?’
এই কেমনের উত্তর এখন আমি ইমনরে কেমনে দিই। বাংলাদেশে ফর্মুলার বাইরে গিয়ে ছবি করার প্রযোজক কয়জন আছে? তাহলে এত এত যুবকেরা যে ছবি করব, ছবি করব বলে ঝাঁকে ঝাঁকে বেরিয়ে আসছে, এরা যাবে কার কাছে? আমি যখন প্রথম ছবি করি তখনো যে পরিস্থিতি এর চেয়ে ভালো ছিল তা না, কিন্তু আমরা টেলিভিশনের কল্যাণে মোটামুটি একটা ব্র্যান্ড তৈরি করে তারপর ছবির প্রযোজক পেয়েছি। কিন্তু সবাই কি এই পথ ধরে আসবে? নাকি আমাদের একটা তরুণবান্ধব প্রযোজনা পরিবেশ তৈরি করা দরকার?
ওই দিনের ডিনারে আমার সামনে জারি হওয়া এই প্রশ্নগুলোর ফলাফলই বুটিক সিনেমা প্রজেক্ট, আর যার প্রথম ছবি ইমনের জালালের গল্প! ইতিমধ্যেই জালালের গল্প দিয়ে ইমন নিজের আগমনের কথা জানান দিয়েছে। আমি যেহেতু বিশ্বাস করি, ইমনকে মোটামুটি গভীরভাবে চিনি, এই কথা আমি জোর দিয়ে বলতে চাই, ওর ছবিতে সামনের দিনগুলোতে আরও নতুন নতুন বাঁক দেখতে পাবেন। জালালের গল্প ভালো লেগে থাকলে ওর পরের ছবিতে যদি একই ইমনকে খুঁজতে যান, তাহলে আমি নিশ্চিত আপনারা হতাশ হবেন। এই হতাশা আমাদের সিনেমার জন্য কত যে জরুরি!
ইমন, আমাদের হতাশ করতে থাকো, ধাক্কা দিতে থাকো, সারপ্রাইজ দিতে থাকো তোমার নতুন নতুন গল্প দিয়ে।
এই যাত্রা কষ্টের হবে, তবে শুভ হবে, ভ্রাতা।
লেখক: চলচ্চিত্র নির্মাতা